skip to Main Content

টেকসহি I সাসটেইনেবল শিরো

শোষণমূলক উৎপাদনচর্চার শিকার নারীরাই বেশি। তবু কি থমকে গেছে পথচলা। বরং বিশ্বজুড়ে টেকসই ফ্যাশন আন্দোলনের পথপ্রদর্শনে এগিয়ে গেছেন পুরুষদের পাশাপাশি

সাসটেইনেবল ফ্যাশন বর্তমানে ফ্যাশন জগতে সবচেয়ে আলোচিত এক বিষয়। পরিবেশ ও আর্থসামাজিক—দুই দিক বিবেচনায় রেখে ফ্যাশনেবল পণ্য সবচেয়ে বেশি টেকসই পদ্ধতিতে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার করার ব্যাপারটাই সাসটেইনেবল ফ্যাশন।
সাসটেইনেবল ফ্যাশনের যুগে এই কনসেপ্টের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন নারীরা। তৃণমূল পর্যায়ে উৎপাদন থেকে বিপণন, ব্র্যান্ড কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ডিজাইনার, শুভেচ্ছাদূত কিংবা মডেল—সব ক্ষেত্রেই সাসটেইনেবিলিটিকে সাপোর্ট করা নারীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এদের মধ্যে এমন কজন আছেন, যারা পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি ফেয়ার ও এথিক্যাল ট্রেডের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন বহু বছর ধরে। এমনকি পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন ফ্যাশনের বিভিন্ন সেক্টরে।
ভিভিয়েন ওয়েস্টউড
‘আমার প্রতিটি পোশাকের গল্প আছে। আছে নিজস্ব পরিচয়। তাদের স্বকীয় ধরন আর উদ্দেশ্যও রয়েছে। এ জন্য সেগুলো ক্ল্যাসিক। তাদের এ গল্প বলা নিরন্তর।’
বিশ্বজুড়ে সাসটেইনেবল ফ্যাশন তখনো পত্রিকা আর টেলিভিশনের পর্দাতেই সীমাবদ্ধ। সে সময় এটা নিয়ে জোর কাজ শুরু করেন তিনি। ৫০ বছরের ডিজাইনিং ক্যারিয়ারে সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে কাজ করছেন এক যুগের বেশি সময় ধরে। পরিবেশবান্ধব বা ইকো ফ্রেন্ডলি ফ্যাশনে ভিভিয়েনের হাতেখাড়ি রিচার্ড ব্র্যানসনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। সেই কালেকশনের প্রতিটি পোশাকে ব্যবহৃত হয়েছিল টেকসই সব উপকরণ।
এরপর থেকে ভিভিয়েনের ফ্যাশন লেবেল সাসটেইনেবিলিটির চর্চা শুরু করে। পলিয়েস্টার আর অ্যাক্রেলিকের বদলে সহজে রিসাইকেল করা যায় এমন ম্যাটেরিয়ালে তৈরি পোশাক উৎপাদনের কাজ শুরু হয়। লেদারও সোর্স করা হয় সাসটেইনেবল উৎস থেকে। ডিফরেস্টেশনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন ভিভিয়েন। তার তৈরি হ্যান্ডমেইড উইথ লাভ ব্যাগ কালেকশনের প্রতিটি ব্যাগ তৈরি হয়েছে রিসাইকেলড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে। ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল এবং মেয়র অব লন্ডনের সঙ্গে কোলাবোরেশনে ভিভিয়েনের ব্র্যান্ড ফ্যাশন সুইচ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করে। ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোকে গ্রিন এনাজিং সাপ্লাইয়ার হয়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করাই কাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
ভিভিয়েন ফ্যাশনের ব্যাপারে পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানের ওপর জোর দেন। স্বীকার করেন, তার তৈরি পোশাক ব্যয়বহুল। তারপরও বেশি দিন টেকসই হবে এমন পোশাক তৈরিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি।
এমা ওয়াটসন
‘আমি জানতে চাই, আমার পোশাক পরিবেশে কোনো নেতিবাচক চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে না…ফ্যাশন এমন একটি ব্যাপার, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আমাদের প্রতিদিনই পোশাক পরতে হয়। আমি চাই আমাকে দেখতে ভালো লাগুক, ভালো অনুভূত হোক, আর এটাই আমার কাছে বিলাসিতার সংজ্ঞা।’
পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের ক্ষেত্রে তার নাম উল্লেখ করতেই হয়। নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ফ্যাশনশিল্প ঘিরে পরিবেশগত যে উদ্বেগ, সে ব্যাপারেও বরাবরই সোচ্চার এমা। ফেয়ার ট্রেড, অর্গানিক ও এথিক্যাল ফ্যাশনে নিবেদিত যেকোনো পোশাকের ব্র্যান্ডের সঙ্গে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। এমা ফেয়ার ট্রেডে বিশ্বাস করেন; কারণ, এটা সাসটেইনেবল ফ্যাশন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা মানুষদেরও ক্ষমতায়ন করে।
বছর কয়েক আগে বাংলাদেশেও ঘুরে গেছেন এমা। যুক্তরাজ্যের ফেয়ার ট্রেড ব্র্যান্ড পিপল ট্রির হয়ে। রাজশাহীর প্রত্যন্ত এক গ্রামে নারীর ক্ষমতায়ন ও শ্রমের ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পুরো ব্যাপারটা সরেজমিনে পরখ করতেই এসেছিলেন তিনি।
স্টেলা ম্যাককার্টনি
‘প্রত্যেকের সামান্য চেষ্টাও পরিবর্তন আনতে পারে, আর সামষ্টিকভাবে এটাই একসময় বড় পার্থক্যে পরিণত হয়’।
স্টেলা ম্যাককার্টনি সব সময়ই সাসটেইনেবল আর পরিবেশগত ব্যাপারগুলো মাথায় রেখেই পোশাক তৈরি করেন। সাসটেইনেবল ও স্টাইলিশ—দুটোকে মিলিয়ে তৈরি হয় তার ব্র্যান্ডের পোশাক। এর আগে অর্গানিক কাপড় দিয়ে কাজ করতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণেই তিনি এ ধরনের পোশাক বানাতে শুরু করেন। শতভাগ ক্রুয়েলটি ফ্রি নীতি মেনে চলার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব হয়ে থাকে স্টেলার পোশাক ও অ্যাকসেসরিজের কালেকশন। ফলে ফার ও চামড়া ব্যবহার হয় না একদমই। সাপ্লাই চেইন ও ডিজাইনের সব ক্ষেত্রেই অভিনব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাসটেইনেবিলিটিকে সাপোর্ট করেন স্টেলা। তার ব্র্যান্ডের পোশাকে রিজেনারেটেড ক্যাশমেয়ারের বদলে ভাজিন ক্যাশমেয়ার ব্যবহার করা হয়। আরও ব্যবহৃত হয় সাসটেইনেবল ভিসকস, যা পরিবেশবান্ধব। ২০১৫ সালে ব্র্যান্ডের গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল প্রফিট অ্যান্ড লস রিপোর্ট পাবলিশ করার মাধ্যমে সাসটেইনেবল ফ্যাশনে নতুন মানদণ্ড তৈরি করেন স্টেলা ম্যাককার্টনি।
অলিভিয়া ওয়াইল্ড
‘এথিক্যাল ক্লদিং কেবল ফ্যাশন ফ্যান্টাসি বা রূপকথা নয়, বরং খুব সহজেই অর্জিত হতে পারে এমনই এক বাস্তবতা।’
আমেরিকান অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রকার অলিভিয়া ওয়াইল্ড। বরাবরই সোচ্চার সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে। ২০১৫ সালে জায়ান্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএমের সঙ্গে প্রথম টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কাজ করেন অলিভিয়া। হেম্প, অর্গানিক লিনেন আর লেদারের মতো সাসটেইনেবল ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘কনশাস এক্সক্লুসিভ’ নামের কালেকশনের প্রতিটি পোশাক। ক্রেতাদের সচেতন শপিংয়ে উদ্বুদ্ধ করতে ‘কনশাস কমার্স’ নামের প্রজেক্টে অংশও নিয়েছিলেন তিনি। ডুসামথিং নামে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও পার্টনারশিপ ছিল তার। প্রতিষ্ঠানটির মুভমেন্ট ‘কামব্যাক ক্লদিং’-এর মাধ্যমে তিনি তরুণদের ক্লদিং রিসাইক্লিয়ে উৎসাহ দিতেন। ২০১৯ সালে থ্রিফ্ট শপ থ্রেডআপের সঙ্গে পার্টনারশিপ করেন এ অভিনেত্রী। #চুজইউজড নামের কালেকশন তৈরি করেন, যার প্রতিটি পোশাক আগে ব্যবহৃত। এটাও ছিল কনশাস কমার্সের একটি প্রজেক্ট।
গুইনেথ প্যালট্রো
‘নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটাই আমার কাছে সৌন্দর্য।’
সাসটেইনেবল ফ্যাশন ও ডিজাইনারদের সব সময় সমর্থন দিয়ে আসছেন আমেরিকান অভিনেত্রী গুইনেথ প্যালট্রো। এমনকি ইকো-ফ্রেন্ডলি ক্লদিং লাইনগুলোর সঙ্গে নিয়মিত কোলাবোরেট করেন।
স্টেলা ম্যাককার্টনির মতো ডিজাইনারদের সঙ্গে নিয়ে এবং অ্যামো ভেটের সঙ্গে পার্টনারশিপে পরিবেশবান্ধব সব পোশাক তৈরি করে সাসটেইনেবল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন ইতিমধ্যে। অর্গানিক কাপড় আর তুলনামূলক কম ক্ষতিকর রং দিয়ে তৈরি করার পাশাপাশি গুইনেথ তার ব্র্যান্ড গুপ থেকে বিক্রীত প্রতিটি শার্টের বদলে একটি করে গাছ লাগানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের একদম উঁচু পর্যায়, অর্থাৎ বিজিএমইএ থেকে শুরু করে পোশাককর্মী, বা ফেয়ার ট্রেডের বিকল্পধারার কোনো পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান—প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে নারীর অবদান। থানাপাড়া সোয়ালোজ, বেজ, প্রকৃতি, ব্র্যাক-আড়ং, এইচবিপিএস, কোর, শ্রীপুর ভিলেজ ট্রেড, সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজের বেশির ভাগ কর্মীই নারী। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৩ দশমিক ১৬ কোটি ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ঠেকেছে প্রায় ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারে, যা সে বছরেরই মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মী বাহিনীর ৮০ শতাংশের বেশি নারী, যা বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নকে অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গেছে। এমন দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন ভিভিয়েন ওয়েস্টউড, এমা ওয়াটসন, স্টেলা ম্যাককার্টনি, অলিভিয়া ওয়াইল্ড, গুইনেথ প্যালট্রোর সঙ্গেও আমাদের দেশের নারীদের নামও তালিকাভুক্ত হবে সাসটেইনেবল ফ্যাশনে।
 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top