সাক্ষাৎকার I এক ছায়াতলে পার্বত্য উদ্যোক্তাদের মেলা—ত্রিশিলা চাকমা
চলতি পথের নানা বাধা পেরিয়ে, দৃপ্ত পায়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের অনেক নারী। নিজ নিজ সেক্টরে ইতিমধ্যে অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে। এমনই ১০ জন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতা…
এক ছায়াতলে পার্বত্য উদ্যোক্তাদের মেলা
—ত্রিশিলা চাকমা
উদ্যোক্তা, তারেঙ; প্রতিষ্ঠাতা, সাবাংগী
ক্যানভাস: উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত কখন ও কেন নিলেন?
ত্রিশিলা চাকমা: জন্ম রাঙামাটিতে হলেও উচ্চশিক্ষার জন্য ছোটবেলাতেই বাবা-মা আমাকে এলাকার বাইরে পাঠিয়ে দেন। টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমস স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকার হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করি আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে। আর দশটা গ্র্যাজুয়েটের মতোই নিয়ম মেনে আইন পেশায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। কিন্তু নিজে কিছু একটা করার তাগাদা সব সময়ই ভেতর থেকে টের পেতাম। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ঘোরাঘুরির সুযোগ আসে। তখন নিজ শহরে কাজ করার ইচ্ছা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ভিন্নতাগুলো আমি সব সময়ই উপভোগ করতাম। তবে যত দিন ঢাকায় ছিলাম, নতুন কারও সঙ্গে দেখা হলেই আমাদের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক বা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে ‘বন্য, হিংস্র’ হিসেবে উপস্থাপন করে ঠাট্টা-মশকরা করার প্রবণতা দেখে খারাপ লাগত। ভাবতাম, তারা আমাদের সম্পর্কে কত ভুল জানে। আমরা কয়েকজন মিলে নিজেদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সামাজিক নানা বিষয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সেই ভাবনা থেকেই ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর আমাদের উদ্যোগ ‘তারেঙ’-এর যাত্রা শুরু।
ক্যানভাস: ‘তারেঙ’ নামের সার্থকতা কী?
ত্রিশিলা: চাকমা ভাষার এই শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পাহাড়ের ঢালু অংশ’। এই নাম রাখার পেছনে একটা কারণ আছে। চাকরির পেছনে আমাদের বাবা-মায়েরা যেভাবে ছেলেমেয়েদের ছুটতে বলেন, ব্যবসার কথা বললে তারা সেই একই গতিতে নাক সিটকান! অথচ ব্যবসা করলে নিজের ঘরে থেকে স্বাধীনমতো কাজ করা যায়। তাই ব্যবসার উদ্যোগ যখন নিচ্ছিলাম, তখনো জানা ছিল না—ঢাল বেয়ে শিখরে উঠতে যাচ্ছি, নাকি গড়িয়ে নিচে পড়ে যাব।
ক্যানভাস: শুরুতে আর কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলেন?
ত্রিশিলা: পরিবার থেকে প্রথমে কোনো সাপোর্ট পাইনি। কীভাবে ব্যবসা শুরু কিংবা পরিচালনা করব—এসব দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। নিজেরাই মিলে ঠিক করি, যেহেতু টি-শার্ট এখন তরুণ-প্রবীণ সবার পছন্দ; তাই এর ওপর প্রিন্ট করে আমাদের উদ্দেশ্য সফল করা সম্ভব। আমরা টিম মেম্বার ছিলাম পাঁচজন। তবে কেউই কিউসি করতে জানতাম না। এ কারণে শুরুর দিকে প্রোডাক্ট সোর্সিং করতে মুশকিলে পড়তে হয়। কিউসি না থাকায় প্রোডাক্টের প্রায় অর্ধেকই ডিফেক্টেড পড়ত। ফ্যাক্টরিগুলো কোনোমতেই নষ্ট প্রোডাক্টের দায় নিতে চাইত না। ফলে বেশ কয়েক মাস নিয়মিত লোকসান গুনতে হলো। এরই মধ্যে দুজন চলে গেল অন্য পেশায়। বাকিরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।
ক্যানভাস: ‘সাবাংগী’ গড়ার উদ্দেশ্য কী?
ত্রিশিলা: তারেঙ নিয়ে ফেসবুকে মার্কেটিংয়ের সময় খেয়াল করলাম, আমার মতো অনেকেই অনলাইনে ব্যবসা করেন। তার মানে, পার্বত্য অঞ্চলের আরও অনেকে ব্যবসায় ক্যারিয়ার গড়া কথা ভাবেন। সমমনাদের মাঝে যোগাযোগ করার একটা মাধ্যম তৈরি করতে পারলে কেমন হয়? এই ভাবনা থেকেই ফেসবুকে সাবাংগী গ্রুপের সৃষ্টি। নামটি একটি বাক্যের সংক্ষিপ্ত রূপ, যার সরল বাংলা দাঁড়ায়—‘এক ছায়ার নিচে কাজ করার সঙ্গী’। একদম শুরুতে সাবাংগী অবশ্য ৭ জন পাহাড়ি নারী উদ্যোক্তার অফলাইন গ্রুপ ছিল। ঢাকার কাজীপাড়ায় অবস্থিত হবাং রেস্টুরেন্টের উদ্যোক্তা বিপলি চাকমা একদিন আমাকে তার রেস্টুরেন্টের পাশে তারেঙের একটি সেল পয়েন্ট খোলার প্রস্তাব দেন। জায়গাটা আমার একার পক্ষে বেশ বড় ছিল। তাই আরও ৬ উদ্যোক্তাকে নিয়ে একসঙ্গে সেল পয়েন্ট গড়ে তোলার কথা জানাই বিপলি দিদিকে। তিনি রাজি হয়ে যান। এভাবে আমরা ৭ জন পাহাড়ি নারী উদ্যোক্তা মিলে শুরু করি ‘সাবাংগী শপ’ নামে সম্মিলিত পাহাড়ি উদ্যোক্তা পণ্য বিক্রয় কেন্দ্র। এরপর ফেসবুকের মাধ্যমে অন্যান্য পাহাড়ি উদ্যোক্তাকে এক ছায়ার নিচে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সাবাংগী নামে পাবলিক গ্রুপের কার্যক্রম শুরু করি। বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ৩১ হাজার। এদের মধ্যে প্রতিদিন নানা পোস্টের মাধ্যমে নিজেদের উদ্যোগ ও পণ্য প্রচারণার কাজ করেন তিন শতাধিক উদ্যোক্তা।
ক্যানভাস: সাবাংগীর কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়?
ত্রিশিলা: ২৫ জন মডারেটর এই পাবলিক গ্রুপ পরিচালনা করেন। এ টিমের প্রত্যেকেই সাবাংগীর উদ্যোক্তা। তারা স্বেচ্ছাসেবী হয়ে গ্রুপটিকে উজ্জীবিত রাখছেন। এই গ্রুপের সদস্য হওয়ার বিশেষ কোনো শর্ত নেই। তবে পোস্ট করতে হলে তাকে অবশ্যই পাহাড়ি অথবা সমতলের অবাঙালি উদ্যোক্তা হতে হবে এবং সরাসরি সেল পোস্ট না দিয়ে গল্প আকারে লিখতে হবে। নানা সময়ে স্থানীয় ট্রেনিং সেন্টারগুলোর মাধ্যমে এই গ্রুপে উদ্যোক্তাদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থা করি আমরা।