সাক্ষাৎকার I ফটোগ্রাফিই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে—জয়িতা তৃষা
চলতি পথের নানা বাধা পেরিয়ে, দৃপ্ত পায়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের অনেক নারী। নিজ নিজ সেক্টরে ইতিমধ্যে অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে। এমনই ১০ জন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতা…
ফটোগ্রাফিই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে
—জয়িতা তৃষা
ফটোগ্রাফার
ক্যানভাস: ‘ব্যালেরিনা’ ফটোগ্রাফি সিরিজের আইডিয়া কীভাবে এলো?
জয়িতা তৃষা: বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে যে ধরনের ছবি তোলে, সেগুলো আমার বিশেষ ভালো লাগত না। মনে হতো, একটু আলাদা কিছু করব। বিদেশের যারা ভিন্ন জনরার ফটোগ্রাফি করেন, ইনস্টাগ্রামে আমি তাদের নিয়মিত ফলো করি। তাদের মতো কাজ করার বাসনা ছিল। আমাদের দেশে সাথারণত ডকুমেন্টারি কিংবা স্ট্রিট ফটোগ্রাফির বেশি প্রশংসা করা হয়। ওয়েডিং কিংবা ফ্যাশন ফটোগ্রাফি যারা করেন, তাদের খুব একটা মর্যাদা দেওয়া হয় না। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগত না। পোর্ট্রেট, কনটেম্পরারি কাজ আমাকে বেশি টানে। সেই ভাবনা থেকেই এই সিরিজের কাজটি করেছি।
ক্যানভাস: কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে?
জয়িতা: এখানে ক্যামেরা নিয়ে একলা রাস্তায় বের হওয়া বিশাল রিস্কের ব্যাপার। নিজের অসুবিধা হওয়ার চেয়ে বেশি ভয় পাই, ক্যামেরা কেউ ছিনিয়ে নেয় কি না। তাই সঙ্গে নেওয়ার মতো কারও সময় পেলে তখন বের হতে পারি। অন্যদিকে, ঢাকার রাস্তায় ছবি তোলা সব সময়ই ঝামেলার। বহু মানুষ চারপাশে দাঁড়িয়ে যায়, বাজে মন্তব্য করে। এগুলো এখন আর অবশ্য কানে তুলি না।
ক্যানভাস: ‘ব্যালেরিনা’ সিরিজ নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা কী?
জয়িতা: এই সিরিজের ছবি আমি দুই দিন তুলেছি। সত্যি কথা বলতে, এটা নিয়ে আর কোনো প্ল্যান নেই। অনেক দিন, অনেক রকম কাজ করব—একসময় এমন প্ল্যান ছিল। অনেক রকমের প্রেজেন্টেশন ছিল মাথায়। কিন্তু সিরিজটি নিয়ে এত প্রচার-প্রচারণা হয়েছে, মনে হয় এ নিয়ে আমার আর কাজ না করাই ভালো। তা ছাড়া ব্যক্তিজীবনে আমি খুবই অন্তর্মুখী মানুষ। নিজের মতো কাজ করতে ভালোবাসি। এত বেশি পাবলিক অ্যাটেনশন আমার ভালো লাগে না। তা ছাড়া একই জিনিসের রিপিটেশন করতে চাই না। তাই যে ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে, ব্যালেরিনাকে যদি আবারো ছবিতে দেখাইও, সেগুলো একেবারেই আলাদা হবে।
ক্যানভাস: এই সিরিজ দিয়ে কোন বার্তা দিতে চেয়েছিলেন?
জয়িতা: প্রথমত ইচ্ছে ছিল ঢাকা শহরকে একটু ভিন্নভাবে দেখানো। রাস্তার ছবি এমনভাবে তুলতে চেয়েছি, যেন দেখতে নতুন লাগে।
ক্যানভাস: সিরিজটা ভাইরাল হলেও আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে কতটুকু সফল মনে করেন?
জয়িতা: এই সিরিজ নিয়ে ভাইব ক্রিয়েট হওয়ার কারণ, বাংলাদেশে এ ধরনের কাজ আগে হয়নি। কিন্তু আমি যে ধরনের শট, মুভমেন্ট, লোকেশন, লাইট চেয়েছিলাম, নানা কারণে তা পাইনি। ভিড়ের মধ্যে চাইলেই ছবি তোলার জন্য দুই ঘণ্টার বেশি সময় নিতে পারিনি। মানুষের ভিড়, শুট করলে রাস্তা ব্লক হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে মনমতো কাজটা করতে পারিনি।
ক্যানভাস: ফটোগ্রাফি নিয়ে আপনার ভিশন কী?
জয়িতা: ২০০৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর অবসর সময়ে ভাইয়ের ক্যামেরা দিয়ে টুকটাক ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলাম। স্রেফ শখেই। তারপর বিশাল ব্রেক পড়ে যায় পড়াশোনাসহ পারিবারিক নানা কারণে। ২০১৭ সালে আবারও অবসর পেয়ে ভাবলাম, ফটোগ্রাফি সিরিয়াসলি করব। ফটোগ্রাফি আমাকে ভীষণ পজিটিভ থাকতে সাহায্য করে। বিখ্যাত হওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কিংবা নিজেকে আর্টিস্ট হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ফটোগ্রাফিতে আসিনি। পাবলিক অ্যাটেনশন কিংবা টাকা কামানোর জন্যও নয়। নিজের মনের শান্তির জন্য ফটোগ্রাফি করি।
ক্যানভাস: ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ে ফটোগ্রাফি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করেছে?
জয়িতা: ২০২১ সালের মার্চ মাসে ক্যানসার ধরা পড়ে, ট্রিটমেন্ট শুরু এপ্রিল থেকে। প্রথম তিন-চার মাস খুব আপসেট ছিলাম। মনে হতো, জীবন বোধ হয় এখানেই শেষ। ক্যামেরা বেচে দেওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। কারণ, আর তো ছবি তুলতে পারব না। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, পাঁচটা মাস একটু দেখি। পাঁচ মাস পর দেখলাম, যতটা ভেবেছিলাম—একদম বিছানায় পড়ে যাব, অত খারাপ অবস্থা হয়নি। হ্যাঁ, কেমোথেরাপিতে বেশ ভুগেছি, তবে মনের শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছি। ঠিক করলাম, কেমোথেরাপির ফাঁকে ফাঁকেই কাজ করব। একবার কেমো নিয়ে ১০ দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হতো আমাকে। এরপর একটু ভালো বোধ করতেই ফটোগ্রাফি করতাম। ক্যানসারের কথা অনেক দিন কাউকে বলিনি। কারণ, কারও সহানুভূতি চাইনি। তা ছাড়া অসুস্থ জানলে যদি কেউ কাজ না দেয়, এই ভয়ও ছিল। এর ফাঁকে ফাঁকে কাজ করে চিকিৎসার টাকা নিজে ম্যানেজ করেছি। ফটোগ্রাফি আমাকে বুঝতে দেয়নি, আমি অসুস্থ। আসলে ফটোগ্রাফিই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
ক্যানভাস: জীবনকে কীভাবে দেখেন?
জয়িতা: জীবনকে খুবই পজিটিভভাবে দেখি। প্রতিটা সময় এমন কিছুর পেছনে খরচ করতে চাই, যেটা আমাকে মানসিক শান্তি দেবে; অন্য মানুষকে, অন্য যেকোনো ক্রিয়েচারকে হেল্প করবে। জীবনটা যেন অপচয় না মনে হয় নিজের কাছে।