সাক্ষাৎকার I প্রতি পণ্যের পেছনে রয়েছে ১৮০টি গল্প—তানজিলা এলমা
চলতি পথের নানা বাধা পেরিয়ে, দৃপ্ত পায়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের অনেক নারী। নিজ নিজ সেক্টরে ইতিমধ্যে অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে। এমনই ১০ জন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতা…
প্রতি পণ্যের পেছনে রয়েছে ১৮০টি গল্প
—তানজিলা এলমা
স্বত্বাধিকারী, হাউজ অব আহমেদ
ক্যানভাস: ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার পথচলার সূচনালগ্ন সম্পর্কে জানতে চাই।
তানজিলা এলমা: বেশ আগের কথা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তখন থেকেই কাপড় দিয়ে পোশাক বানাতে ভালো লাগত। নিজের, পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের জন্য পোশাক বানিয়ে দিতাম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর আমি করপোরেটে ক্যারিয়ার শুরু করি, পাশাপাশি পোশাক বানানোও অব্যাহত রেখেছিলাম। প্রতিবছর কিছু এক্সিবিশনে অংশ নিতাম। কাস্টমারদের রেসপন্স লক্ষ করতাম। ইচ্ছে ছিল ব্যবসা কীভাবে চলে এবং একটা ব্র্যান্ড কীভাবে তৈরি হয়, করপোরেট ওয়ার্ল্ডে কাজ করার মাধ্যমে তা দেখব। আমি মার্কেটিংয়ে ছিলাম। করপোরেটে ৩ বছর কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে বাসার গ্যারেজে কারিগর নিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর আমার স্বামীও চাকরি ছেড়ে দিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হন। এভাবেই হাউজ অব আহমেদের যাত্রা শুরু।
ক্যানভাস: বর্তমানে হাউজ অব আহমেদের কাজের ধরন কী?
এলমা: আমরা আর্টিসান কমিউনিটিদের নিয়ে কাজ করি। তারা হাতের কাজ করেন। আমরা সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়েও কাজ করি। এখানে প্রতিটি কাজ খুবই ডিটেইলড। ফ্যাব্রিক, হাতের কাজ ও সেলাইয়ে অনেক মানুষ যুক্ত রয়েছেন। আমাদের প্রতিটি প্রোডাক্টের পেছনে শ্রম রয়েছে ১৮০ জন কর্মীর। তার মানে, প্রতিটি পণ্যের পেছনে আমাদের ১৮০টা গল্প থাকে।
ক্যানভাস: কর্মীরা প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি কী সুবিধা পান?
এলমা: প্রতিবছর আমরা বড় করে একটা ফ্যামিলি পিকনিক করি। কর্মীদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া কোম্পানি থেকে আমরা নিয়মিতই কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের বেনিফিট দিই। বিয়ের সময় ১০ হাজার টাকা করে ম্যারেজ অ্যালাউন্স দিই। একজন পুরুষ কর্মী বাবা হলে তাকে প্যাটার্নিটি লিভ দিই। সঙ্গে দিই ১৫ হাজার টাকা, যেন নতুন শিশুটির লাইফের ট্রানজেকশনটা খুব স্মুথ হয়। এতে কোম্পানির সঙ্গে কর্মীদের একাত্মতা বাড়ে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি এসে এখানে কাজ করতে পারছেন। আমরা তাদের জন্য বিভিন্ন রকমের ওয়ার্ক অপরচুনিটি তৈরি করি।
ক্যানভাস: একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি পারিবারিকভাবে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি না, কিংবা এ দেশে ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো সুবিধা-অসুবিধা?
এলমা: পরিবারে মেয়ে-ছেলের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ আমি দেখিনি। আমাদের সবকিছুই ইকুয়াল ছিল। তবে কাজ করতে গেলে যেকোনো ক্ষেত্রেই অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসে। প্রথমত, আমার দুটি সন্তান রয়েছে। তাই আমাকে ফ্যামিলি লাইফের সঙ্গে ওয়ার্ক লাইফের ব্যালেন্স করতে হয়। আর তা করতে গিয়ে নিজের সঙ্গেই নিজের ফাইট করতে হয়। অন্যদিকে, উদ্যোক্তা হতে গেলে আমাদের দেশে নারীদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা আছে। যদিও বিষয়গুলো অনেকেই সেভাবে জানেন না। নারী উদ্যোক্তার জন্য ভ্যাট, ব্যাংক লোনসহ সবকিছুতেই সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এ দেশে। এটিকে আমি একটি বিশেষ সুবিধা বলে মনে করি।
ক্যানভাস: নারী হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে কর্মীদের মধ্যে কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ করেছেন?
এলমা: আর্টিসান কমিউনিটিতে অনেক বয়স্ক লোকও রয়েছেন। আমার চেয়ে ১৫-২০ বছরের বড় অনেকেই হাউজ অব আহমেদের হয়ে কাজ করেন। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় কোনো নারীর নির্দেশনা মানতে অনেকেরই ভালো লাগে না। একজন পুরুষ কর্মকর্তা যদি দুটো বকা দেন, তাহলে সেটা কর্মীদের অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন নারী একটু জোরে কথা বললে সেটা তারা সহজে নিতে পারেন না। এই সমস্যা শুরুর দিকে মাঝেমধ্যেই ফেস করতাম। তবে এখন বেশ কমে এসেছে।
ক্যানভাস: যেসব তরুণী উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের প্রতি আপনার বার্তা কী?
এলমা: যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। ‘আমি কী করতে চাই’—এটা স্থির করতে হবে শুরুতে। সেই হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা চাই। নিজেকে সময় দিতে হবে। আরেকটা বিষয়, কোনো মাধ্যমেই হার্ড ওয়ার্কের বিকল্প নেই।
ক্যানভাস: হাউজ অব আহমেদের ভিশন কী, কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
এলমা: হাউজ অব আহমেদ মানে হলো বিশ্বাসের ঘর। এটা সবার জন্য বিশ্বস্ত হাউজ। আমাদের ভিশনটা অনেক বড়। প্রতিষ্ঠানটির লোগো হচ্ছে শাপলা। এটা কিন্তু বাংলাদেশের প্রতীক। আমাদের জাতীয় ফুল। আমরা আমাদের হাউজটাকে গ্লোবালি প্রেজেন্ট করব বলেই শুরু থেকে লোগোসহ সবকিছু অনেক ভেবেচিন্তে তৈরি করেছি। আমরা একটা আর্টিসান কমিউনিটি তৈরি করতে চাই। যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ এসে দেখতে পাবেন, বাংলাদেশের কারিগরেরা কত সুন্দর মানের কাজ করতে পারদর্শী। আমরা কারিগরদের জীবনমানে পরিবর্তন আনতে চাই।