সাক্ষাৎকার I পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দায়বোধ—ফাইরুজ ফাইজা
চলতি পথের নানা বাধা পেরিয়ে, দৃপ্ত পায়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের অনেক নারী। নিজ নিজ সেক্টরে ইতিমধ্যে অনেকেই নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে। এমনই ১০ জন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতা…
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দায়বোধ
—ফাইরুজ ফাইজা
সহপ্রতিষ্ঠাতা, মনের স্কুল
ক্যানভাস: মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্ল্যাটফর্ম ‘মনের স্কুল’ গড়ে তোলার নেপথ্য গল্প কী?
ফাইরুজ ফাইজা: এটি বাংলাদেশের প্রথম স্টুডেন্ট বেইজড অর্গানাইজেশন। আমরা কাজ করছি স্টুডেন্টদের মেন্টাল হেলথ নিয়ে। অনেক কারণেই শিক্ষার্থীরা মানসিক বিভিন্ন চাপে ভোগেন। তা থেকে আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত নিতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে। মানসিক চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতেই ‘মনের স্কুল’ গড়ে তুলেছি। এখন অবশ্য শুধু শিক্ষার্থীই নয়, সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ শুরু করেছি।
ক্যানভাস: এই প্ল্যাটফর্ম চালাতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন?
ফাইরুজ: এই কাজগুলো যখন শুরু করি, আমিও তখন স্টুডেন্ট। ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়তাম। শিক্ষার্থী অবস্থায় এমন একটি প্ল্যাটফর্ম চালাতে গিয়ে কিছু বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। প্রথমত ছিল পড়াশোনার চাপ। এ কারণে বাসা থেকে কিছুটা বকা খেয়েছি। সেটা বাদে পরিবারে মা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। স্বামীরও খুব সাপোর্ট পেয়েছি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট কতটা নারী উদ্যোক্তাবান্ধব বলে মনে করেন?
ফাইরুজ: বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের যে সিস্টেমটা আছে, মানে কোনো সামাজিক সংগঠন দাঁড় করানোর জন্য যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেগুলো আসলেই খুব একটা নারীবান্ধব হিসেবে এখনো তৈরি হয়নি। তার ওপর আমরা যখন মানসিক স্বাস্থ্যের মতো এমন একটা ট্যাবু টপিক নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন স্বাভাবিকভাবেই আশপাশের অনেকে ব্যাপারটি খুব সহজে মেনে নিতে চাননি। কেউ কেউ অপপ্রচারেরও চেষ্টা চালান। তবে সিদ্ধান্তে অটল থাকা এবং নিজের ওপর আস্থা রাখা জরুরি। এভাবে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
ক্যানভাস: এই প্রেক্ষাপটে আপনার স্ট্রাগলটা তুলনামূলক কেমন ছিল?
ফাইরুজ: আমি সেই তুলনায় বেশ ভাগ্যবতী বলতে হবে। সাফল্য পেতে হলে মানুষকে আরও কঠিন রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। আমি সেই তুলনায় কিছুটা সহজেই পাড়ি দিতে পেরেছি। অন্যান্য নারী যে ধরনের বাধার সম্মুখীন হন, তাদের সামনে আমারটা অনেক ছোট। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করাটা বাংলাদেশে যে কারও জন্যই কঠিন। নারীদের জন্য তো আরও বেশি কঠিন। তবে আগে যেমনটা বলেছি, সাহস থাকলে এবং ইচ্ছাটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, কিছুটা সময় হয়তো বেশি কিংবা কম লাগবে, কিন্তু সাফল্য আসাটা অসম্ভব কিছু নয়।
ক্যানভাস: কাজের স্বীকৃতি হিসেবে আপনি গত বছর একটি মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন।
ফাইরুজ: বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস গোলকিপার্স গ্লোবাল গোল চেঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড-২০২১ পেয়েছি। এই অ্যাওয়ার্ডের প্রক্রিয়া শুরু হয় গত বছরের মাঝামাঝি। নমিনেশনের জন্য বেশ কজন তরুণকে শর্টলিস্ট করা হয় ব্র্যাকের মাধ্যমে। তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে তারা আমার নামটিই পাঠায়। লাখো মানুষের মধ্য থেকে আমার নামটা তারা বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে। আগস্টে জানতে পারি, তিনজন বিজয়ীর একজন হিসেবে আমি চূড়ান্ত হয়েছি। এই অ্যাওয়ার্ড আমার জন্য অনেক সম্মানের। এটি আমার কাজের স্পৃহাও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে নিজের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আমাকে করেছে আরও বেশি শাণিত।
ক্যানভাস: ‘মনের স্কুল’ প্রসঙ্গে আবারও ফেরা যাক। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাই।
ফাইরুজ: আমরা চেষ্টা করছি যত শিশু ও তরুণ আছে, তাদেরকে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল টুল কিডসের মাধ্যমে এমপাওয়ার করতে। যেন তারা নিজেদের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং নিজেদের ডিপ্রেসিভ যে এপিসোডগুলো আছে, সেগুলো নিজেরাই সামাল দিতে পারে এবং নিজের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি আশপাশে যারা আছে, তাদের সবার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে পারে, অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট করতে পারে। আমরা স্কুলে বিভিন্ন প্রজেক্ট শুরু করছি। বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলে বাচ্চাদেরকে পজিটিভ মেন্টাল হেলথ লিটারেসির ওপর ট্রেইন করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ক্যানভাস: ‘মনের স্কুল’-এর পক্ষ থেকে পাঠকদের কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চান?
ফাইরুজ: আমরা যে জেনারেশন এখন বড় হচ্ছি, তারা ভবিষ্যতে বাবা-মা হব। আরেকটা জেনারেশনকে বড় করব। একটা জেনারেশনের দায়িত্ব কিন্তু আমাদের ওপরও আসবে। যদি পজিটিভ মেন্টাল হেলথের প্র্যাকটিসগুলো শিখি এবং চর্চা করি, নিজেরা যেমন ভালো থাকব, পরবর্তী প্রজন্মকেও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। এর মাধ্যমে আমরা আত্মহত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার হার কমিয়ে আনতে পারব বলে বিশ্বাস করি।