ছুটিরঘণ্টা I ইসলামিক কায়রোর রাজত্বে
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছাপ বুকে ধরে, শুভ্র অনুভূতির বার্তা ছড়িয়ে রেখেছে মিসরের ঐতিহাসিক মসজিদগুলো। যেমন কারুকাজ, তেমনই নির্মল আবহ খেলা করছে প্রাণ খুলে। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
মসজিদের সামনে আমার জন্য ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক ফুলের মতো মেয়ে। আমার নামেই নাম—ফাতিমা। আমার ধারণা, মিসরে প্রতি পাঁচজন মেয়ের তিনজনের নামই ফাতিমা! এতে খুব সুবিধে হয়েছে। সবার মাঝে মিশে যেতে পারছি। ওই বালিকার হাত থেকে ফুল নিতেই দৌড়ে অন্য পাশে চলে গেল। সে এসেছে তার পরিবারের সঙ্গে মসজিদ দেখতে। কায়রোর প্রাচীন মসজিদে দর্শনার্থী এসে দেখে যেতে পারেন এর খুবসুরতি, কোনো কঠোর বিধিনিষেধ ছাড়াই।
মিসর বরাবরই মসজিদের জন্য বিখ্যাত। আরব্য রজনীর পাতা থেকে কতই না কিচ্ছাকাহিনি মনে গেঁথে আছে! ইসলামিক কায়রো বা মসজিদের শহর কায়রোর অলিগলিতে কান পাতলে এমনিতেই পুরোনো আমলের ফিসফিসানি শোনা যাবে পাথুরে দেয়ালে দেয়ালে। মরুভূমির দেশ আর মরুভূমির রঙের পাথরে তৈরি আদিকালের ঘরবাড়ির মাঝে প্রাচীন নগরী ফিরে আসে, ধরা দেয়। মরুভূমির ধুলোমাটি, সোনালি বালি আর তার চেয়েও উজ্জ্বল, উচ্ছল ধুলো-মলিনতা পাশ কাটিয়ে সোনালি হাওয়ার সঙ্গে যেন গল্প করে।
গল্পের শুরু হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পর থেকে। তখন থেকেই মিসরে মুসলমানদের বসবাস। তখন থেকেই কায়রো সমৃদ্ধ ইসলামি আচারনিষ্ঠতা ও শিল্পকলায়। কায়রোর সবচেয়ে প্রাচীন জায়গাকে তাই বলা হয় ইসলামিক কায়রো। এ এক আলাদা নগরী। শহরের মাঝে থেকেও অনুচ্চ ভবনগুলোয় ভর করেছে উমায়েদ বা আব্বাসীয় জমানা। একে একে রাজত্ব বদলায়; কিন্তু বদলায় না ইসলামিক কায়রো। ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে, যেমন দেখা যায় ছবির বইয়ে, আমাদের কল্পনার খাতায়।
মসজিদের গোলাকার গম্বুজ খুঁজলেই পাওয়া যায় যেকোনো গলিতে দাঁড়িয়ে। ইসলামিক কায়রোর প্রাচীন গলিতে দাঁড়িয়ে আরও অনেক কিছু নজরে আসে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দেয়ালে দেয়ালে পাথরের ওপর খোদাই করা কারুকাজ। ইতিহাসবিদেরা এই কারুকাজকে বলেন ইসলামিক শিল্প। তবে আমি ডাকি অন্য নামে। আমার কাছে এই নকশা মরুভূমির বুকে এক শীতল পানপাত্র, লু হাওয়ায় এক টুকরো মেঘের ছায়া, দিল ঠান্ডা করে দেওয়া এহসাস।
এসব অলিগলিতে কোনো এক সময় বসত বাজার। সাদা গালাবায়া পরিহিত পুরুষেরা বিক্রি করতে আসতেন খোরমা খেজুর বা গৃহস্থালি বিভিন্ন পণ্য। নারীরা আবায়া পরে, নেকাবে মুখ ঢেকে কখনো কি আসতেন না এই সব বাজারে? আসতেন নিশ্চয়। ইরান-তুরানের রেশমি কাপড় আর নানান গয়নার আহ্বান ভুলে থাকা বোধ করি কোনো নারীর পক্ষেই সম্ভব নয়।
ইসলামিক কায়রোর অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো সিটাডেল বা প্রাসাদ দুর্গ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত এই প্রাসাদসম দুর্গ দূর থেকে দেখতে স্বর্ণ নির্মিত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক টুকরো স্বর্গ বলে মনে হয়। মিসর দেশের সোনার কেল্লা এটি। ভেতরে বিশাল প্রান্তর। একসময় এখানে বাদশাহর দরবার বসত। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে থাকত ঘোড়া। শাহি দরবারে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সমাদর করতেন সুলতান। আর প্রাসাদের শাহি মসজিদ ছিল আল নাসির মুহাম্মদ মসজিদ। মামলুক বংশের সুলতান আল নাসির মুহাম্মদ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৩১৮ সালে। সুলতান ও রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখানে নামাজ পড়তেন।
মসজিদটি বাইরে থেকে ঠিক আগের মতোই আছে। চারকোনা আকারের স্বর্ণরঙা দেয়ালে পরিবেষ্টিত। বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী আছে। শুধু নজরে আসে ভেতরের দুটো মিনার। মিহরাব আকারের বিশাল দরজা পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে সামনে আসে শুধু বিস্ময়! দেখতে আমাদের দেশের মসজিদের মতো নয় একেবারেই। চারদিকে বারান্দা ঘেরা, মাঝখানে এক টুকরো উঠোন। আর পশ্চিমের বারান্দায় নামাজ পড়ার স্থান। মূলত চারপাশের বারান্দাই নামাজ পড়ার স্থান। এ মসজিদে প্রায় পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। বারান্দা ছাদ দিয়ে ঢাকা। ভেতরের বাকি উঠোনে মরুভূমির রঙিন হাওয়ার চলছে দারুণ খেলা!
এ দেশে এখন গ্রীষ্মকাল। মামলুক সাম্রাজ্যের সময়ে তখনো বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হয়নি। খোলা বারান্দা ছাড়া স্বস্তিতে নামাজ পড়ার আর কোনো উপায় ছিল না। পশ্চিম দিকের দেয়ালে মিহরাব এক খাজানা। শ্বেতপাথর আর অ্যালাবেস্টারে বিভিন্ন রঙের দামি পাথরে ইসলামিক নকশা খোদাই করা। মূল মিহরাবের কারুকাজ দেখলে মনে হবে, সত্যি যেন কোনো প্রাসাদে চলে এসেছি। মূল মিহরাবের নকশা আরও সূক্ষ্ম ও শৈল্পিক। দূর থেকে মনে হবে সোনারুপোয় মুড়ে দিয়েছে কেউ। কিবলার পুরো দেয়ালেই একই রকম কারুকাজ। এর আরেকটু ওপরে পবিত্র কোরআনের আয়াত খোদাই করা দেয়ালজুড়ে। আরও খানিক ওপরে, ছাদের কাছাকাছি নকশাদার জালের মতো ঝারোখা; হাওয়া এখানে খেলা করে। বাইরের হাওয়া ভেতরে এসে নামাজরত মুসল্লির গায়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়।
মিম্বারের কারুকাজকে অস্বীকার করবে—এমন কুরুচি আছে কার? এ শিল্পের কোনো বর্ণনা হয় না! আবলুস কাঠের ওপর সুচারু ফুল নকশার দেয়াল করে রেখেছেন মামলুক যুগের শিল্পীরা। আর এখন সে কারুকাজের গায়ে হেলান দিয়ে, হাত ধরাধরি করে বসে আছে এক যুগল। লাল রঙের কার্পেট এদের প্রেম যেন আরও রাঙিয়ে দিচ্ছে। মসজিদই আসল প্রেমের স্থান, মসজিদেই তো হয় সকল স্বীকারোক্তি। মনের কথা বলার জন্য এর চেয়ে উত্তম জায়গা বোধ হয় হতে পারে না।
মসজিদ দর্শনে আরও অনেকেই এসেছেন। কেউ পরিবার নিয়ে; কেউ বন্ধুবান্ধব নিয়ে। বেশির ভাগই স্থানীয়। মিসরের জনগণ বেশির ভাগ দেখতে আরব দেশীয়দের মতো। এদের মাঝে একজন কালো আবায়া পরিহিত নারী জোহরের নামাজ পড়তে মিহরাবের এক কোনায় দাঁড়িয়ে গেলেন। পাশে বাচ্চারা হইচই করে খেলছে, আর এর মাঝেই সাম্য খেলা করে যাচ্ছে।
কিবলার দিকের অংশ ছাড়া মসজিদের ভেতরের অন্যান্য দেয়ালে কোনো দামি পাথর বসানো কারুকাজ নেই। সাধারণ পাথরের ওপর মহান আল্লাহর কালাম খোদাই করা আছে। এতে আবহাওয়ার কিছুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। মসজিদ সবাইকে গ্রহণ করছে যেন উদার চিত্তে। যার যখন ইচ্ছা, এসে দেখা দিচ্ছে।
আল নাসির মুহাম্মদ মসজিদ থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল মুহাম্মদ আলী মসজিদ। ইসলামিক কায়রোর সবচেয়ে উঁচু স্থানে নির্মিত এটি। বাইরে থেকে সিটাডেল দেখলে সবার আগে এই মসজিদ নজরে আসে। ওপরে-নিচে চারটি গম্বুজ আর দুটি মিনার নিজেদের জায়গা নীল আকাশের কাছাকাছি করে নিয়েছে। মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মিসরের তুর্কি শাসক মুহাম্মদ আলী পাশা, ১৮৩০ সালে। আগাগোড়া মর্মর পাথর ও অ্যালাবেস্টারে নির্মিত এই মসজিদ দূর থেকে বেহেশতের দরজা বলে ভ্রম হয়!
অটোমান নকশা পুরোপুরি এই মসজিদে মিশে আছে। সদর দরজা থেকে শুরু করে ভেতর-বাইরের সব দেয়ালই সাদা। অটোমান স্থাপত্যকলায় নির্মিত মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, কিবলার দিকে থাকে নামাজ পড়ার মূল স্থান বা মূল মসজিদ। মসজিদের বাইরে চারদিকে আয়তাকার ছাদঘেরা বারান্দা। বারান্দার মাঝখানে খোলা উঠান। আর উঠানের ঠিক মাঝখানে অজু করার জন্য ছাউনি দেওয়া ছোট গোলাকার পানির ট্যাংক। মুহাম্মদ আলী মসজিদে এসবই আছে এবং মসজিদের স্থাপত্যকলা অনুসরণ করা হয়েছে ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমেদ মসজিদ বা ব্লুমস্ক থেকে।
মরুভূমির বাতাস বয়ে যাওয়া গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে হঠাৎ করে ঠান্ডা পানির ফোয়ারার নিচে আচমকা এসে পড়লে যেমনটা লাগে, আমার অবস্থাও এখন তেমন। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি! চারদিকের দেয়াল, স্তম্ভ, বারান্দা, ছাদ, মেঝে, উঠান, পানির আধার—সবই আশ্চর্য রকমের সাদা অ্যালাবেস্টার আর মর্মর পাথরে ঢাকা। মাথার ওপরে নীল আকাশ। পানির ট্যাংক দেখলে মনে হবে কোনো রাজপ্রাসাদে এসে পড়েছি। এর ছাউনি, গোলাকার দেয়ালে সূক্ষ্ম খোদাই করা কারুকাজ—সবকিছুই জাদুমাখা। তিন দিকের আয়তাকার বারান্দার থামে, দেয়ালে অবর্ণনীয় কারুকাজ উড়ে উড়ে যেন আকাশে মিশে যেতে চাইছে। আকাশও যেন একটু সাদা মেঘ ধার চাইছে মসজিদের শরীর থেকে। মসজিদের এই উদারতা আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আসল মসজিদের অন্দরমহলে এখনো তো তশরিফ রাখিনি। বাইরে থেকেই এত মোহময়, ভেতরে না জানি কী আছে!
অন্দরমহল কল্পনার চেয়েও সাবলীল। লাল কার্পেটের হৃদয়ে লেখা আছে মসজিদের সকল মুসল্লির আনাগোনার কাহিনি। ছাদ থেকে ঝুলছে হাজারও ঝাড়বাতি। ছাদের নকশায় আল্লাহর কালাম আর ফুল-লতাপাতা লাল, নীল, সবুজ, সোনালি রঙে মুখরিত। মুখোমুখি হতে চাইছে একে অন্যের। ভেতরের ছাদের গোলাকার গম্বুজ সবটাই নিয়ে নিয়েছে নীরব ঐশ্বর্য। সেখান থেকে চোখ সরে আসতে চায় না। এই কারুকাজ খোদার মহিমাকে আরও স্পষ্ট করে; ইবাদতের দিকে টেনে নিয়ে চলে মন।
মসজিদের দেয়ালে এখন রওনক হেসে যায়। চপল কিশোরীর মনের মতো সাদা দেয়ালে অনায়াসে কারুকাজ বাড়াচ্ছে মুমিনদের পুণ্যের খাজানা। এ এমন এক মসজিদ, যেখানে এলে মন পবিত্র হয়ে ওঠে। বসে যেতে ইচ্ছে করে ইবাদতে। দু হাত তুলে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করতে চায় মন এই লা-জবাব, নিষ্পাপ ভান্ডার আমার সামনে খুলে দেবার জন্য। মসজিদের মিহরাব শ্বেতশুভ্র এক ফুলের মালা যেন। মালার মতোই জড়িয়ে আছে কারুকাজ মিহরাব আর মিম্বারে। মসজিদের দোতলা, তিনতলার দেয়ালেও অসামান্য শোভা বাড়াচ্ছে এই শ্বেতশুভ্র কুসুমদল। এই খুবসুরতি সারা দিন বসে দেখলেও শেষ হওয়ার নয়। মসজিদ থেকে বের হবার পথে, আবলুস কাঠের কারুকাজখচিত দেয়ালের অপর পাশে ঘুমাচ্ছেন স্বয়ং সুলতান মুহাম্মদ আলী পাশা। সবকিছুই রাজকীয়। সব দরজা খোলা সবার জন্য এখন।
মসজিদের নগরে, মসজিদের মহিমা দেখতে দেখতে খোদার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ থাকতে হয় এই রহমতের দরজা আমার সামনে খুলে দেবার জন্য।
ছবি: লেখক