টেকসইি I বন্য প্রাণীর বন্ধুসেতু
দুর্ঘটনার হাত থেকে বন্য প্রাণীদের রক্ষার জন্য দারুণ উদ্যোগ নিয়েছে এক তরুণ দম্পতি। জানাচ্ছেন আল মারুফ রাসেল
বাংলাদেশের ছোট এক জঙ্গল সাতছড়ি। হবিগঞ্জের এই জঙ্গলে সাতটি ছড়া আছে বলেই এই নাম। আগেকার পোশাকি নাম রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে বেরিয়ে এসে ২০০৫ সালে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান নামে পরিচিত এখন। এখানেই চলছে বাংলার প্রাইমেটদের বাঁচানোর এক প্রাণান্ত চেষ্টা।
বাংলাদেশে মানুষ ছাড়া আরও দশ প্রজাতির প্রাইমেট বসবাস করে। প্রাইমেট শব্দের আভিধানিক অর্থ সর্বোচ্চ শ্রেণির স্তন্যপায়ী প্রাণী। আরও ভেঙে বললে, তাদের ক্ষুর বা নখরের পরিবর্তে থাকে আঙুল, আর থাকে সেটা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা। প্রাণিজগতে এরা মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। অথচ বাংলাদেশে প্রাইমেটের তিন প্রজাতি মহাবিপন্ন আর পাঁচ প্রজাতি রয়েছে বিপন্ন তালিকায়। এগুলোর মধ্যে দুটি মহাবিপন্ন প্রজাতি চশমাপরা হনুমান ও উল্লুক; তিনটি বিপন্ন প্রজাতি কলু বানর, মুখপোড়া হনুমান ও লজ্জাবতী বানর এবং সংকটাপন্ন রেসাস বানরের বাস এই সাতছড়ির ২৪৩ একর এলাকায়।
মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জেরে ভালো নেই সাতছড়ির প্রাইমেটগুলো। এর শুরুতেই আছে জঙ্গল উজাড় করে কাঠ সংগ্রহ করা। অবৈধ কাঠ সংগ্রাহকদের নজর থাকে প্রচুর কাঠ মিলবে এমন বড় গাছগুলোর দিকে, ফলে চলাফেরা ও দৈনন্দিন কাজের জন্য গাছের ওপরের দিক ব্যবহার করা প্রাইমেটসহ ছোট রডেন্টও (ইঁদুরজাতীয় প্রাণী) সমস্যার মুখে পড়েছে। অন্যদিকে নরম কাঠের গাছ যেগুলো তাদের খাবার জোগায়, সেগুলোও কাটা পড়ছে বিভিন্ন কারণে। জ¦ালানি কাঠের অতিরিক্ত সংগ্রহ ও অপরিকল্পিত বনায়নও হুমকির কারণ হয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর জন্য। আবার মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাইমেটগুলোর সংঘর্ষও ঘটে, বিশেষ করে জঙ্গলের প্রান্তের বা ভেতরের কৃষিকাজের এলাকায়। সেই সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে বনের ভেতর দিয়ে তৈরি হওয়া পথ, রেলপথ আর বিদ্যুতের তার।
ধরে নেওয়া যাক, একই সারিতে তিনটি গাছ রয়েছে। প্রাইমেটগুলো প্রথম গাছ থেকে দ্বিতীয় গাছ, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় গাছে যায়। এখন মাঝের গাছটি কেটে ফেললে, প্রথম গাছ থেকে তৃতীয় গাছে যাওয়ার জন্য প্রাইমেটগুলোকে মাটিতে নেমে আসতে হচ্ছে, অথবা বিচরণক্ষেত্র কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে (উল্লুকের ক্ষেত্রে)। আবার এভাবে দুটো গাছের মাঝে যদি কোনোভাবে একটা গাড়ি চলার পথ চলে আসে, তাহলে সংঘর্ষ হতে পারে প্রায়ই। একইভাবে যদি দুটো গাছের মাঝখানে একটা বৈদ্যুতিক তারের লাইন চলে যায়, সে ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার বেশি হয় লম্বালেজের হনুমানগুলো। দুই তারের মাঝে চলাচলের সময়ে তাদের লেজ বৈদ্যুতিক তারে লেগে সার্কিট পূর্ণ করলে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়। আবার দেখা গেছে, লজ্জাবতী বানর যে গাছগুলো ধরে তাদের প্রিয় খাবার জিগা আঠা খেতে আসত, সেখানকার গাছগুলো বনবাসী কৃষিকর্মীরা লেবুবাগানে ছায়া আসার অজুহাতে কেটে ফেলেছেন। ফলে ধীরগতির লজ্জাবতী বানর মাটিতে নেমে আসে এবং বনবাসীদের গৃহপালিত কুকুরের সঙ্গে একটা সংঘর্ষ ঘটে।
এই ক্যানোপি গ্যাপ এবং তার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোকে দূর করতে এগিয়ে এসেছে এক তরুণ বন্য প্রাণী গবেষক দম্পতি—হাসান আল-রাজী ও মারজান মারিয়া। হাসান আল-রাজী গবেষণার কাজে বহুদিন ধরেই দেশের উত্তর-পূর্ব দিকের জঙ্গলগুলোয় যাওয়া-আসা করতেন, পরে মারজান মারিয়াও। তারা জানালেন, প্রায়ই লাউয়াছড়া ও সাতছড়ির জঙ্গলের গাড়ি ও রেল চলাচলের পথগুলোয় দেখা মিলত দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বন্য প্রাণীর। সাপ, ব্যাঙ তো অহরহই দেখা যেত, পাশাপাশি প্রাইমেট ও নানা ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণীও দেখা যেত মৃত পড়ে থাকতে। এর একটা সমাধান করতে ২০১৮ সালে তারা ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও নিজেদের তথ্য খোঁজেন। এতে লাউয়াছড়ায় ১৩টি ও সাতছড়িতে ১৪টি বন্য প্রাণীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংবাদ খুঁজে পান আর সেগুলো একটি জার্নালে প্রকাশ করেন। তিন বছরে এই দুই বনে ২৭টি মৃত্যুর ঘটনা কম শোনালেও বাংলাদেশে টিকে থাকা বন্য প্রাণীগুলোর জন্য সংখ্যাটি ছোট নয় মোটেও।
তাই তারা পরিকল্পনা করতে থাকলেন কৃত্রিমভাবে সেতু তৈরি করে সাতছড়ির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোয় বসানোর।
সাতছড়ির ভেতর দিয়ে পুরোনো ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে চলে গেছে আর রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন। উদ্যোগটির নাম দেওয়া হয় ‘আর্টিফিশিয়াল ক্যানোপি ব্রিজেস ফর কনজারভেশন’। মূলত মারজান মারিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে এক্সপ্লোরার ক্লাব নামের এক মার্কিন সংস্থা থেকে এক হাজার ডলারের অর্থ সাহায্য পেয়ে এটা শুরু হয়। পরে প্লামপ্লোরিজ ভি নামের এক জার্মান সংস্থাও এগিয়ে আসে। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাতছড়ির বনে রাস্তার দুপাশের গাছগুলোতে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে সংযোগ তৈরি করা, যেন প্রাইমেটগুলো নিরাপদে রাস্তা পার হতে পারে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ কাজ অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ১ নভেম্বর ব্রিজ স্থাপনের কাজ শেষ হয়, বন বিভাগের সহায়তায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে। এরপর তিন মাস অপেক্ষা করা হয় যেন বন্য প্রাণীরা ব্রিজটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে পারে। এরপর ক্যামেরা ট্র্যাপ বসানো হয় ব্রিজের পাশে, বন্য প্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। এরপর প্রতি দুই সপ্তাহ পর সাতছড়ির বনে গিয়ে ক্যামেরা থেকে ছবি নেওয়া, তথ্য সংগ্রহ আর সেতু রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। ক্যামেরা ট্র্যাপে দেখা যায়, প্রথম দিকে কাঠবিড়ালি জাতীয় প্রাণী এই কৃত্রিম সেতু ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে উল্লুক বাদে জঙ্গলের বাকি পাঁচটি প্রাইমেটও এটা ব্যবহার শুরু করে। ব্যবহার করছে বাগডাশ জাতীয় প্রাণীও। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেকটাই কমে আসতে শুরু করেছে। মোট ১৫৭ দিনের ক্যামেরা ট্র্যাপের কাজে দেখা যায়, ১ হাজার ৬০টি প্রাণী কৃত্রিম সেতুগুলো ব্যবহার করেছে।
দুর্ঘটনার হাত থেকে বন্য প্রাণীদের বাঁচানোর এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। জয়তু আর্টিফিশিয়াল ক্যানোপি ব্রিজেস ফর কনজারভেশন।
ছবি: আর্টিফিশিয়াল ক্যানোপি ব্রিজেস ফর কনজারভেশন