মনোযতন I রাগের রোগ
‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’—রাগ উঠলে এমন নীতিবাক্য মাথায় তেমন কাজ করে না, সে কথা কমবেশি সবারই জানা। তাই বলে রাগ চেপে রাখা কি স্বাস্থ্যকর? নাকি রয়েছে বিকল্প কোনো উপায়? জানাচ্ছেন জিন্নাতুল বোরাক
‘রাগ হলো অন্যের বোকামির জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়া বা নিজের বোকামির জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়া।’
‘প্রতি এক মিনিটের রাগের জন্য, আপনার ৬০ সেকেন্ড শান্তি নষ্ট হচ্ছে।’
‘রাগ এমনই এক অ্যাসিড, যা অন্যের ওপর ঢাললে যত না ক্ষতি করে, তা থেকে বেশি ক্ষতি হয় সেই পাত্রের, যাতে এটা সংরক্ষণ করা হয়।’
—‘সুখ ও অন্যান্য ছোট অতি প্রয়োজনীয় বিষয়’/ হাইম সাপিরা
এসব প্রজ্ঞাপূর্ণ উক্তি জানার পরও সত্যি করে বলুন তো, আপনার কি রাগ অনুভূত হয় না? যদি রাগ হয়ে থাকে, তবে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, রাগ মানুষের স্বাভাবিক মানবীয় আবেগ। বলা যেতে পারে বন্ধু। কারণ, রাগ সংকেত দেয় চারপাশে কিছু একটা ঘটছে, যা আমাদের ভারসাম্য নষ্ট করছে। নিরাপদ জীবনের জন্য সক্রিয়ভাবে এই ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। রাগ আরও সংকেত দেয় আমাদের কোন চাহিদা পূরণ হয়নি অথবা আমার সঙ্গে কোন অন্যায় হয়েছে। তাই রাগের অনুভূতি অনুভব করার ভেতর কোনো ভুল নেই। শুধু সচেতন হওয়া প্রয়োজন এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে। গঠনমূলকভাবে রাগ প্রকাশ যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম, নেতিবাচক প্রকাশ তেমনই করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণভাবে একজন মানুষ সপ্তাহে গড়ে তিন-চারবার রেগে যান। এ ঘটনা যদি প্রতিদিন বা দিনে তিন-চারবার ঘটে, তবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ব্যানন ও অন্যদের (২০০২) গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত রাগের কারণে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (অতি চঞ্চলতা) ও অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের (একই চিন্তা বা কাজের পুনরাবৃত্তি), এমনকি উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা থাকে। অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ছাড়াও নিজের শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় ও আত্মিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
পরিবারে রাগ
মানুষ রাগ কীভাবে প্রকাশ করবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে পারিবারিক আবহের ওপর। ছোটবেলা থেকে যদি কেউ আগ্রাসী আচরণ দেখে থাকে, তাহলে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অবচেতনভাবে একই আচরণ নিজেও করে ফেলে। অনেক সময় সামাজিকভাবে ছেলেদের রাগের আগ্রাসী বহিঃপ্রকাশকে উৎসাহিত করা হলে দুঃখ, হতাশা, হীনম্মন্যতা ও অন্যান্য আবেগও তারা রাগের মাধ্যমে প্রকাশ করতে শেখে। অপরপক্ষে, মেয়েদেরকে রাগ প্রকাশে নিরুৎসাহিত করা হলে রাগ-ক্ষোভ নিজের ভেতর বয়ে বেড়ানোর অভ্যাস তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে শারীরিক উপসর্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
প্যারেন্টিংয়ের ধরনের ওপর নির্ভর করে মানুষের রাগের অনুভূতি বা প্রকাশ কেমন হবে। যে বাবা-মায়েরা কোনো ধরনের বাছবিচার না করে চাওয়ামাত্র সন্তানকে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি দিয়ে দেন, সেসব সন্তানের ধারণা হয়—পৃথিবী তাকে ঘিরেই আবর্তিত; বড় হওয়ার পরও কোনো কিছু পেতে দেরি হলে তারা রাগে ফেটে পড়ে। আবার যে বাবা-মায়েরা নিজেদের ব্যস্ততা বা অন্যান্য কারণে বাচ্চার চাহিদা পূরণের প্রতি নির্বিকার থাকেন, সেসব সন্তান অবহেলিত, প্রত্যাখ্যাত ও পরিত্যাক্ত বোধ করে। সংগত কারণেও তারা রাগ প্রকাশ করতে ভয় পায়। এ ছাড়া সন্তানকে অত্যধিক সমালোচনা করা হলে সে ভাবতে শুরু করে, তার চাহিদাগুলো গুরুত্বহীন। বাবা-মায়ের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় সব সময় লজ্জা ও হীনম্মন্যতায় ভোগে সে। আবার বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনজনিত শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও অল্পতেই প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়।
দাম্পত্যজীবনে রাগ
মানবজীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এই সম্পর্ককে মহিমান্বিত করা হয়েছে। তারপরও অনেক মধুর সম্পর্ক অনুপযুক্ত রাগ প্রকাশের কারণে ক্রমান্বয়ে বিবাহবিচ্ছেদের দিকে গড়ায়। পরকীয়া, শিশু নির্যাতন ও হত্যা, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনা অহরহ খবরের কাগজে দেখা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন, রাগ করে চিৎকার করা, ঝগড়া বা মারামারি করা কিংবা দিনের পর দিন রাগ পুষে রেখে পরস্পর থেকে দূরে থাকা—কোনোটিই সুস্থ জীবনের জন্য সহায়ক নয়। প্রায়ই দেখা যায়, স্বামী বা স্ত্রীর ওপরে রাগ প্রকাশ করতে না পেরে অবচেতনভাবেই সন্তানের ওপর তার প্রকাশ ঘটছে, যা বাচ্চার বিকাশকে চূড়ান্তভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
দাম্পত্যজীবনে রাগের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, প্রত্যাশিত আচরণ ও বাস্তব আচরণের ভেতর বিস্তর ফারাক, জীবনসঙ্গীর আবেগ ও চাহিদা বুঝতে না পারা, যৌন অতৃপ্তি, সঙ্গীকে সময় না দিয়ে সর্বদা বন্ধুবান্ধব ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যস্ত থাকা, যেকোনো সমস্যা আবির্ভূত হলে একে অন্যকে দোষারোপ করা, ঘরের কাজে অংশগ্রহণে অনীহা, কোন খাতে কত অর্থ ব্যয় হবে, সে বিষয়ে মতপার্থক্য, খরচের বিবরণ জীবনসঙ্গীর কাছে লুকিয়ে যাওয়া, অতীতের ট্রমা ইত্যাদি।
কর্মস্থলে রাগ
কর্মস্থলে রাগের উৎস হতে পারে পক্ষপাতমূলক আচরণ, সহকর্মীর দুর্বলতা নিয়ে ব্যঙ্গ করা, কাজের দায়িত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানানো, কর্মীদের দায়িত্বশীল আচরণের অভাব, অদক্ষ সুপারভাইজার, অবমূল্যায়ন, দীর্ঘদিন বেতন ও পদোন্নতি না হওয়া ইত্যাদি।
করণীয়
রাগকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে প্রথমেই জানা দরকার কোন বিষয় আপনাকে রাগিয়ে তোলে। এটা হতে পারে কোনো ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা, স্থান, পরিবেশ ইত্যাদি। রাগের কারণ যা-ই হোক, একটা তালিকা করে ফেলুন। বাসা, কর্মক্ষেত্র, সামাজিক পরিবেশভেদে আলাদা তালিকা করা যেতে পারে। এই তালিকা রাগ অনুভূত হওয়ার আগেই সচেতন হতে সাহায্য করবে।
অতীতে রেগে গিয়েছিলেন—এমন কোনো ঘটনা পুনরায় স্মরণ করুন। ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যালোচনা করা যেতে পারে। নিচের প্রশ্নগুলো নিজেকে জিজ্ঞেস করুন:
ঘটনা শুরু হওয়ার ঠিক আগেই আপনার মুড কেমন ছিল?
ঘটনাস্থলে কোন কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন?
কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল?
সুনির্দিষ্টভাবে কোন কথা বা আচরণ আপনাকে রাগিয়ে তুলেছিল?
নিজের সম্পর্কে তখন কী চিন্তা হচ্ছিল?
অপর পক্ষ সম্পর্কে কী চিন্তা হচ্ছিল?
এই পরিস্থিতিতে আপনার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ ছিল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিশ্লেষণ করলে বুঝে যাবেন, ওই পরিস্থিতিতে আপনার চাহিদা কী ছিল যা পূরণ হয়নি। হতে পারে আপনি স্বীকৃতি চাচ্ছিলেন, নিরাপত্তার অভাব বা অসম্মানিত বোধ করছিলেন কিংবা স্নেহ-মমতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি অনুভব করছিলেন, অথবা অন্য কিছুও হতে পারে। যে চাহিদা অপূর্ণ ছিল, তা শনাক্ত করে পূরণ করুন। তা না হলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই একই অতৃপ্ত চাহিদা আপনাকে বারবার রাগিয়ে তুলবে।
দেখা গেছে, যারা সহজেই রেগে যান, তারা ব্যক্তিগত জীবনে বিশেষ করে সময় ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল হয়ে থাকেন। তাই পরিকল্পনামাফিক সময় ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জীবনকে আরও সহজ করে তুলতে পারে।
শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার, যেমন নিয়মিত ঘুমের ঘাটতি থাকলে তা খিটখিটে মেজাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এ ছাড়া সুষম খাবার বা পুষ্টির অভাবও উল্লেখযোগ্য। নিয়মিত মেডিটেশন শরীর ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সাহায্য করে।
রাগ মানুষের শরীরে কিছু অতিরিক্ত শক্তি উৎপাদন করে। সচেতন না হলে মানুষ এই শক্তিকে খরচ করে ধ্বংসাত্মকভাবে। যেমন অপর বা নিজেকে আঘাত করা, ভাঙচুর করা, গালি দেওয়া ইত্যাদি। তাই রাগ হলে এই শক্তিকে বিকল্প কোনো ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে ক্ষয় করে ফেলুন। যেমন: হাঁটতে বের হোন, বিছানা ঝাড়–ন, ঘর পরিষ্কার করুন, বড় করে নিশ্বাস নিন। মানুষকে আঘাত না করে বালিশকে আঘাত করতে পারেন। কিছুক্ষণ পর এই শক্তির বিনাশ হলে কিছুটা শান্ত লাগবে। এবার কর্মপরিকল্পনা করুন।
রেগে গিয়ে ভাঙচুর করা যেমন কাজের কথা নয়, তেমনি রাগ প্রকাশ না করে ক্ষোভ পুষে রাখাও সমাধান নয়। বরং সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক ব্যক্তির সঙ্গে সঠিক প্রক্রিয়ায় রাগ প্রকাশ করতে পারলেই ইতিবাচক সাফল্য পাওয়া সম্ভব।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চেয়ারপারসন, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: ইন্টারনেট