ফিচার I বাংলায় নওরোজ
বাংলায় নওরোজ বা পারসিক নববর্ষ শুরুর প্রথা ঠিক কবে চালু হয়ে আবার বিলুপ্তির মাধ্যমে ঠাঁই করে নিল ইতিহাসের পাতায়, তা বিস্তর গবেষণার দাবিদার। ঢাকাতেও জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব হিসেবে সেটি ছিল সমাদৃত। এর বিস্তারিত বিবরণ খুব একটা মেলে না। তবু ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু তুলে আনার এ প্রয়াস
পারস্যে আড়াই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে সন্ধান মেলে নওরোজ পালনের। আর লোকশ্রুতি রয়েছে, এই প্রথা নাকি চলে আসছে অন্তত পাঁচ হাজার বছর ধরে। ফিরদাউসির ‘শাহনামা’ থেকে জানা যায়, অসুরদের তৈরি করা রথে জামশিদ আকাশে গিয়েছিলেন, আর তাদের পরাজিত করেছিলেন লড়াইয়ে। সেই জয় স্মরণীয় করে রাখতেই পারস্যে এই উৎসবের প্রচলন শুরু। অবশ্য এ ধরনের গল্পগাথা আরও মেলে। তবে সত্যিকারের ব্যাপারটা হলো, নওরোজ কৃষিভিত্তিক এক সামাজিক উৎসব, অনেকটা আমাদের নবান্নের মতো। নওরোজ পারস্যের সাসানীয় বংশের শাসকদের সময় জরাথুস্ট্রীয় রূপ ছেড়ে সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পারস্য আর মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা এটাকে মুসলিম রূপও দিয়েছিলেন একপর্যায়ে। দিল্লিতে গিয়াস-উদ-দিন বলবনের সময় থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল পারসিক নববর্ষ উদযাপনের রীতি। বলে রাখা ভালো, দিল্লির সুলতানদের ভেতরে আলতামাশ (ইলতুৎমিশ) থেকে কায়কুবাদ পর্যন্ত সবাই জাতে তুর্ক হলেও সাংস্কৃতিকভাবে ছিলেন পারসিক। হজরত আমির খসরুর ক্বিরান উস সাদায়িন-এ কায়কুবাদের সময়ের নওরোজ উদযাপনের বর্ণনা রয়েছে। খুব সম্ভবত দিল্লি আফগান শাসনের অধীনে যাওয়ার পর এই উৎসবে ভাটা পড়ে। হুমায়ুন পারস্য থেকে ফিরে এলে বেশ কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়েছিল শাহ তামাস্পের কাছ থেকে। এর মধ্যে একটি ছিল পারস্য থেকে অসংখ্য অভিজাতকে তার দরবারে ঠাঁই দেওয়া। তখন আবারও নতুন উদ্যমে চালু হয় নওরোজ। হুমায়ুনের অকালমৃত্যু ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনে নওরোজের জাঁকজমকে ভাটা পড়ে নিশ্চিতভাবে। আকবর তৃতীয়বারের মতো নওরোজের পুনরুত্থান ঘটান ভারতীয় উপমহাদেশে, ইলাহি সন প্রবর্তনের সময়ে। আর সে সময়টাতে নওরোজ সমাজের উঁচুতলা থেকে আগ্রা-দিল্লির সর্বসাধারণের উৎসবে পরিণত হতে শুরু করে।
ভারতের প্রথম প্রধান মুফতি ও ইতিহাস-লেখক আবদ উল-কাদির বাদাউনি এই উৎসবকে বলেছেন নওরোজ-ই-জালালি। একই নাম অনুসরণ করা হয়েছে মিনহাজ-উস সিরাত ও তাবকাত-ই নাসিরিতেও। বাদাউনি অবশ্য তার লেখায় এই উৎসবের নিন্দা করেছেন এই বলে যে, এর প্রকৃতি হিন্দু ও জরাথুস্ট্রীয়। তবে বাদাউনি কিংবা আবুল ফজল—কেউই নওরোজ নিয়ে শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাসগুলোর উল্লেখ করেননি। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ্বাস করেন, নওরোজে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল, ইব্রাহিম (আ.) পৌত্তলিক প্রতিমা ভেঙেছিলেন আর হজরত মুহাম্মদ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে কাঁধে নিয়ে মক্কার প্রতিমাগুলো ভেঙেছিলেন ও আলী (রা.)-কে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। বাদাউনি এই উৎসব উদযাপনের জন্য দায়ী করেছিলেন বীরবল আর আকবরের হিন্দু স্ত্রীদের ও জরাথুস্ট্রের অনুসারীদের। অবশ্য আকবরের বন্ধু ও আইন-ই-আকবরীর লেখক আবুল ফজল নিশ্চিত করেছেন, আকবর আগেকার শাসকদের রীতি-নীতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন এবং যেগুলো প্রয়োজন মনে করেছিলেন, সেগুলো গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন এই উৎসব উদযাপনের—‘সুরাজ ক্রান্ত’ নামের একটি গোলাকার, সাদা চকচকে পাথর রাখা হতো সূর্যের আলোয়, আর একটি সাদা তুলো রাখা হতো সেটার কাছে। যখন এতে আগুন ধরে যেত, তখন এটা দিয়ে মশাল ও আলোর বাহকেরা মশাল জ¦ালাতেন, ঘরের বাবুর্চিরা ধরাতেন চুলা। এক বছর পর পর এই আগুন নতুন করে সংগ্রহ করা হতো একই উপায়ে আর সংরক্ষণ করা হতো একটি ‘আগিঙ্গির’ নামের পাত্রে। আইন-ই-আকবরীতে ১৯ দিনের উৎসবের কথা লেখা আছে; বলা হয়েছে, প্রথম ও শেষ দিন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বিভিন্ন ভোজের দিনক্ষণের পাশাপাশি উপহার বিনিময়ের কথাও উল্লেখ রয়েছে।
আকবরের পর জাহাঙ্গীরের সময়েও এই উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হতো। জাহাঙ্গীর আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরিতে এর বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন। তার বর্ণনাগুলো মিলিয়ে নেওয়া যায় উইলিয়াম হকিন্স, টমাস রো আর এডওয়ার্ড টেরির সঙ্গেও। যারা নেশাজাতীয় পানীয় ও মাদকদ্রব্য সেবন করতে চান, তাদের বাধা না দিতে সম্রাটের আদেশ ধর্মীয় প্রভাব থেকে এই উৎসবের স্বাধীন থাকার প্রমাণ দেয়। ১৬০৯ সালের নওরোজ উৎসবে মুমতাজ মহলের বাবা আবুল হাসানকে আসাফ খান উপাধি দেওয়া হয়েছিল নানা উপহারসহ। ১৬১১ সালের নওরোজের বর্ণনায় পাই, আগ্রায় ১৯ থেকে ১৮ দিনে গিয়ে ঠেকেছিল এই উৎসব। পুরো প্রাঙ্গণে থাকত সোনালি কাপড়ের ছাউনি আর সাজানো হতো ইউরোপীয়, পারসিক ও হিন্দুস্তানি পণ্য দিয়ে। প্রাঙ্গণের দেয়ালে ঝোলানো হতো ইউরোপীয় ঘরানার পেইন্টিং, যেগুলো জাহাঙ্গীরের বিশেষ পছন্দের ছিল। উঠোনের মেঝেয় থাকত পুরু পারসিক গালিচা আর সিংহাসনের চারপাশজুড়ে থাকত জাহাঙ্গীরকে দেওয়া অভিজাতদের আকর্ষণীয় সব উপহার। যেনানার মহিলারা জালির আড়াল থেকে দেখতেন দরবারের কর্মকাণ্ড। তবে যেনানার নারীদের নিজেদের আলাদা এক আকর্ষণের বস্তু ছিল নওরোজ উপলক্ষে বসা মীনা বাজার। মহিলাদের আবাসস্থলে লম্বা সারিবদ্ধ চমৎকার সব তাঁবুর স্টল বসত, যেখানে অভিজাতদের স্ত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ নারী ব্যবসায়ীদেরও দোকান ছিল। মীনা বাজারে বাদশাহ ছাড়া আর কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। বলা হয়, এই মীনা বাজারেই ৪২ বছরের জাহাঙ্গীরের দেখা হয়েছিল ৩৪ বছরের বিধবা মেহর-উন-নিসার ওরফে নূর মহলের (পরবর্তীকালে নূর জাহান) সঙ্গে। ১৬১৯ সালের নওরোজ উৎসবে দেখা যায় প্রধান উজির, নূর জাহানের বাবা মির্জা গিয়াস বেগ ওরফে ইতিমাদ-উদ-দৌলা, এক ফরাসি কারিগর উগিস্তাঁ ইয়াহিয়াকে দিয়ে আগের সিংহাসনের অনুকরণে আরেকটি রত্নখচিত সিংহাসন উপহার দেন সম্রাটকে।
শাহজাহানের সময়েও নওরোজ দরবারি উৎসব ছিল। ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে, নিকোলাও মানুচি, জ্যঁ ব্যাতিস্তে তাভেনিয়ে, সিবাস্তিয়াঁ মাঁহিকদের বর্ণনায় পাওয়া যায় সে সময়ের ‘জাশন’ আর জাঁকজমকের বর্ণনা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে অনৈসলামিক হওয়ার কারণে এই উৎসব বাধাপ্রাপ্ত হয় আর পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর বদলে ‘নিশাত আফরোজ জাশন’ প্রচলিত হয়, যা শুরু হতো রমজানের শুরুতে আর শেষ হতো ঈদুল ফিতর দিয়ে। অবশ্য পরের সম্রাটদের সময়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবক্ষয় হলেও ‘জাশন নওরোজ’ আবারও আগের মতো ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হতে শুরু করে।
১৭২২ সালের ১০ মার্চ ‘জাশন-ই নওরোজ’ আগের মতো ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হয়েছিল মুহাম্মাদ শাহের দরবারে—এমনটাই লিখেছিলেন শিব দাস লখনৌয়ি। সৈয়দ হাসান আসকারিও একমত হয়েছেন। এই উৎসব ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রাদেশিক রাজধানী, নগর, শহর আর গ্রামগুলোতে। আওধের পাশাপাশি বাংলায়ও উদযাপিত হতো এই উৎসব—তার প্রমাণ রয়েছে তারিখ-ই-বাঙ্গালাহ মহব্বতজঙ্গীতে। তবে সবচেয়ে বেশি নওরোজের বর্ণনা মেলে শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সময়কার। সৈয়দ ওয়াজির হাসান দেহলভি, মুনশী ফাইযুদ্দিন ও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের পঞ্চম প্রজন্মের প্রতিনিধি মির্জা আহমাদ সালিম ‘আরশ’ তাইমুরি অল্প অল্প করে বিবরণ দিয়েছেন তাদের লেখা বইয়ে।
ওয়াজির হাসান লাল কিল্লায় কত রং চড়ত, বাগানে ফুল ফুটত, সেখানকার বিভিন্ন ইমারত কীভাবে সাজানো হতো তার কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন। পাশের যমুনা নদীতে থাকত নওরোজি রঙ, যেগুলো প্রতিবছর আবার জ্যোতিষীরা ঠিক করতেন। সাধারণত গোলাপি, বেগুনি আর জাফরান—এই তিন রঙের ভেতরেই থাকত রংগুলো। ইমারত থেকে শুরু করে সম্রাট, রাজবংশীয় ব্যক্তি ও রাজকীয় কর্মচারীদের গায়ের কাপড় হতো সেই রঙের। দরবার শুরু হতো নিবেদন আর প্রার্থনা দিয়ে। এরপর হতো কবিদের কাসিদা পাঠ। উপহার দেওয়া হতো সম্মানের আংরাখা। শাহজাদারা পেতেন পাগড়ি, পালক দেওয়া টুপি আর মুকুট। অভিজাতদের দেওয়া হতো ‘গোশোয়ারা’ (পাগড়িতে ব্যবহারের মণি-মুক্তো বসানো জরিদার ফিতে)। তার বর্ণনায় দেখা যায়, শিয়া মতবাদ আবারও খানিক প্রভাব ফেলেছিল সুন্নি সম্রাটের ওপর। কারণ, এরপর হজরত আলীর উদ্দেশে নৈবেদ্য দিয়ে সবাইকে এক টুকরো ‘পবিত্র’ খাবার পরিবেশনের কথা বলেছেন তিনি। এরপর সোনা ও রুপার মুদ্রা আকাশে ছুড়ে দেওয়া হতো, আর বিভিন্ন সৎকাজের জন্য বিলি করা হতো অর্থ। বিকেলে বাগানের লাগোয়া নদীতে সবাই নৌভ্রমণ করতেন।
মুনশী ফাইযুদ্দিন বর্ণনা দিয়েছেন খাবার দাবারের। তিনি বলেছেন, প্রথমে জ্যোতিষীরা বছরের রং ঠিক করতেন, আর সেই রঙের কাপড় তৈরি হতো বাদশাহ, শাহজাদা, বেগমাত ও শাহজাদিদের জন্য। বাঁশের ফ্রেমে, সাতটি অভ্র-মাটির পাত্র ভর্তি থাকত সাত রঙা মিষ্টি দিয়ে। দরবার প্রস্তুত হলে বাদশাহ তার নওরোজি পোশাকে হাজির হতেন আর বাকি শাহজাদা ও অভিজাতেরা তাদের পদমর্যাদা অনুযায়ী সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতেন। দরবারে প্রধান কবি ও অন্য কবিরা কাসিদা পড়তেন। এরপরই উপহার বিতরণ দিয়ে শেষ হতো দরবারি আনুষ্ঠানিকতা। নওরোজি রঙের দস্তরখান বিছানো হতো। থালার আবরণ আর টাসেলও হতো একই রঙের। চালের বিভিন্ন পদ, মিষ্টি, কারি, বিভিন্ন পদের সবজি, শুকনো ফল ও অন্যান্য সুস্বাদু খাবার সাতটি ভিন্ন রঙে পরিবেশন করা হতো। পাশাপাশি তৈরি হতো সাতটি ভিন্ন রঙের সবজি দিয়ে এক পদ, যেটাকে বলা হতো ‘নওরতন’। আরও থাকত যবের রুটি, শাকের ভুজিয়া আর ছাতু। খাসা দারোগা দস্তরখান প্রস্তুত হওয়ার ঘোষণা করতেই বাদশাহ প্রথমে হজরত আলীর প্রতি নিয়াজ প্রদর্শন করে, অল্প একটু খাবার মুখে তুলতেন। পবিত্র খাবারের বাকিটা তার পরিবার ও অন্য অভিজাতদের ভেতরে বিলিয়ে দিতেন নিজ হাতে। সব পুরুষ চলে গেলে যেনানারা থাকতেন কেবল দিওয়ান-ই-খাসে। তখন যেনানা ও অন্যদের ভেতরে খাবার বিলিবণ্টনের পর সবাই দিনের প্রথম ভাগের অনুষ্ঠান শেষ করে মহলে ঢুকে যেতেন। বিকেলে বেগমাত ও শাহজাদারা একত্র হয়ে ভক্তদের মুঠো ভর্তি করে সোনা ও রুপার মুদ্রা আকাশের দিকে ছুড়ে বিলিয়ে দিতেন। সন্ধ্যায় আগের সম্রাটের অন্য বংশধর বা সালাতিনরা দিওয়ান-ই-খাসে এসে হাজির হতেন কস্তুরী আর জাফরানে সুরভিত সাবজোয়ারি মুরগির ডিম নিয়ে। বাদশাহ মসনদে বসার পর এই ডিম দিয়ে লড়াই শুরু হতো। একটি ডিমকে আরেকটি ডিম দিয়ে ভেঙে ফেলার এই খেলার পাঁচটি পর্ব উপভোগ করতেন সম্রাট। এরপর সালাতিনরা খেলা শেষ করে ঘরে ফিরে গেলে শেষ হতো নওরোজের উৎসব।
মির্জা আহমাদ সালিম ‘আরশ’ তাইমুরি তার পূর্বপুরুষদের নওরোজ পালনের রীতি স্মরণ করতে গিয়ে প্রাধান্য দিয়েছেন ডিম খেলার বর্ণনার প্রতি। তিনি বলেছেন, সালাতিনদের পাশাপাশি অন্য শাহজাদা ও অভিজাতেরাও ‘নেশ’ (সাবজোয়ারি মুরগির ডিম) খেলায় মত্ত হতেন। ঈদ-ই-নওরোজের কয়েক মাস আগে তিন শ রুপি দিয়ে এক জোড়া পাখি কিনতেন অভিজাতেরা, যেন ৫-৬টি ডিম সংগ্রহ করতে পারেন। সেদিন, একজন নেশকে হাতের মুঠোয় ভরে ডগা বের করে বাকিটা লুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতেন। অন্যজন আরেকটি ডিম ছুড়ে ওই ডিম ভাঙার চেষ্টা করতেন। ডিমের সংঘর্ষে প্রচুর শব্দ হতো। ভিড় থেকে জনতার চিৎকার করে দেওয়া উৎসাহের শব্দও যোগ হতো এতে। আগে যার ডিম ভাঙবে, তিনি হারবেন—এই ছিল নিয়ম। হাজার হাজার রুপি বাজি ধরা হতো। সাধারণ মানুষও এই খেলায় অংশ নিতেন, তবে সাধারণ ডিম নিয়ে। সবচেয়ে জমজমাট লড়াই হতো জামে মসজিদের সিঁড়িতে। সন্ধ্যায় সব ধরনের মজাদার খাবার দিয়ে ভোজের আয়োজন করা হতো, যেগুলো হজরত আলী (র.)-এর নামে উৎসর্গ করা হতো। সবাই এই ভোজে অংশ নিতেন, ওয়াহাবিরা ছাড়া।
মোগল সুবাহ বাংলার রাজধানী ঢাকায় নওরোজ হতো। এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ না থাকলেও ইতিহাসের পাতায় দু-একবার উল্লেখ এসেছে। মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’তে বলা হয়েছে, মির্জা নাথান দাউদ খানকে কত্রাবুতে পরাজিত করার পরই নওরোজ উৎসব শুরু হয়। আর সেদিনই ইসলাম খান মির্জা নাথানের পরিখা পরিদর্শন করতে সেখানে গিয়েছিলেন। ১৬১৩ সালে আবার দেখা যায়, ইসলাম খান যখন গাজীপুরের টোক থেকে ভাওয়ালে আসেন, তখন নির্দেশ দিয়েছিলেন ভাওয়ালের সব ঘর যেন ‘নওরোজের মতো করে’ সাজানো হয়। এ থেকে বোঝা যায়, নওরোজ বেশ ভালোমতোই পালিত হতো এখানে। তবে ঢাকায় নওরোজ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ—সাবজোয়ারি মুরগির ডিম নিয়ে খেলার বর্ণনা মেলে ১৮৯৫ সালের ঢাকাতেও, হাকিম হাবিবুর রহমানের বর্ণনায়। খুব সম্ভবত ঢাকার শেষ নায়েব নাজিম গাজী হায়দারের মৃত্যুর সঙ্গেই নওরোজ হারিয়ে ফেলেছিল তার জৌলুশ। একটি উৎসব হারিয়ে যাওয়ার চেয়েও বড় দুঃখ—সেটার ইতিহাস ধারণ করে রাখতে না পারা।
তথ্যসূত্র:
১. আবুল ফজল, আইন-ই-আকবরী (কর্নেল এইচ এস জ্যারেট অনু.), কলকাতা, ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস, ১৮৯১
২. মির্জা নাথান, বাহারিস্তান-ই-গায়বি (এম আই বোরাহ অনু.), গৌহাটি, আসাম সরকার, ১৯৩৬
৩. হাকিম হাবিবুর রহমান, ঢাকা পাচাস বারাস পেহলে, ঢাকা, প্যাপিরাস, ২০০৫
৪. ইরা মুখোটি, ডটারস অব দ্য সান, নয়াদিল্লি, রূপা পাবলিকেশন্স ইন্ডিয়া, ২০১৮
৫. রানা সাফভি, সিটি অব মাই হার্টস, নয়াদিল্লি, হ্যাশেট ইন্ডিয়া, ২০১৮
৬. বিভিন্ন জার্নাল
৭. বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ড. আবদুস সবুর খান ও গবেষক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট