মনোযতন I হীনম্মন্যতার হিরোশিমা
উৎসবে অন্যরা যখন মাতোয়ারা, আপনি কি গুটিয়ে থাকছেন একান্তই নিজের মধ্যে? অজান্তেই ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স নামের দানবটা বাসা বেঁধেছে মনে? সমাধানের উপায় জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা
মনে পড়ছে সেদিনের কথা? ওই যে, মনে মনে হীনম্মন্যতার হাত ধরে নির্জনতার খোঁজে যেদিন হাঁটছিলেন পার্কে? উদ্দেশ্য, নাগরিক চাকচিক্য থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা। আপনি নির্জনতার খোঁজে পার্কের একেবারে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলেন। সেই নির্জনে বসে ভাবেন, কত বিচিত্রই না শহরের মানুষ! বৈচিত্র্যের হাত ধরে ছুটে চলছে সবাই। ইফতার, শপিং, বাস-ট্রেন-লঞ্চ কিংবা বিমানের টিকিট—কত পরিকল্পনা নিয়ে ঈদের দিকে আগাতে থাকে একেকটি মুখ। ফুটপাত তাদের টেনে নিয়ে যায় হাইওয়ের দিকে। অথচ আপনার চোখে পড়ে কেবলই শূন্য খাঁ খাঁ গলিপথ। ভাবেন, ঈদে প্রিয়জনদের কাছে যেতে এত কেনাকাটা, এত সাজগোজ আর এত পরিকল্পনার কীই-বা আছে!
ভাবতে ভাবতে হাঁটা ধরলেন। নাগরিক সন্ধ্যা পকেটে নিয়ে বাসায় ফিরে ব্যাগ গোছালেন। মন ছুটে যায় আপনার। কানে ভেসে আসে ছুটির ঘণ্টা। খুব কাছ থেকে আয় আয় করে ডাকে ঈদ। আপনি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে খুশির বালুমাখা তীরে শুয়ে পড়েন। লুটোপুটি খান। কিন্তু কোনোভাবেই মন খারাপের কথাগুলো রোদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতে পারেন না। নিজের ভেতর কেমন একটা পিছুটান! এই পিছুটান আপনার যোগ্যতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে জীবনকে সফলতার মাপকাঠিতে দাঁড় করিয়ে ভোগাতে থাকে হীনম্মন্যতায়।
যে ভাবনা কুরে খায়
আসলে নিজের সৌন্দর্য, যোগ্যতা ও সফলতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগেন অনেকেই। আয়নায় তাকিয়ে আরেকটু সৌন্দর্যের জন্য আফসোস করেননি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। নিজের যোগ্যতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেননি, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এমনকি জীবনকে সফলতার মাপকাঠি দিয়ে মেপেও অনেকে হীনম্মন্যতায় ভোগেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই হীনম্মন্যতা এমন এক জটিল অসুখ, যার অনুভূতিগুলো আসলে কল্পিত। এই কল্পিত ভাবনার ফলে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা অন্যের চেয়ে নিজেকে অনেক ছোট করে দেয় নিজের কাছেই। শুধু তা-ই নয়; এতে আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে এবং নিজের কাছেই নিজেকে অতিরিক্ত মাত্রায় সমালোচিত হতে হয়। আর এর পেছনের কারণটা আসলে নিজের চিন্তাগুলোকে নিজেই জটিল করে তোলা। কারণ, আপনি বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে কল্পনাকেই বেশি বিশ্বাস করেন। নিজের ভালো কিছুর চেয়েও অন্যের খারাপটাকে খুব বড় করে দেখেন। এর কারণটাই হলো ওই ভুল কল্পনাকে বিশ্বাস করা। যেটি ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষক আলফ্রেড অ্যাডলার এ ধরনের মানুষ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি ‘সব সময় অনিরাপদ বোধ করা’ এসব মানুষের ভেতর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান, যাকে ‘হীনম্মন্যতা বা ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ নামে অভিহিত করেন।
হীনম্মন্যতা কী
আলফ্রেড অ্যাডলারের গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, এই জটিল বা নিকৃষ্ট অনুভূত হওয়া মানে সামাজিক, শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা মনস্তাত্ত্বিক গুণাবলি অনুসারে অপর্যাপ্ত কিংবা অন্যের চেয়ে নিজেকে খুব নিচু ভাবার এক অনুভূতি হওয়া। যেমন ধরুন, আপনার সহকর্মী বা পরিবারের কোনো সদস্য কিছু একটা করতে করতে অনেক দূর এগিয়ে গেল। সেটা কীভাবে করতে হয়, আপনি কিছুই জানেন না। আপনার মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে অন্যরা আপনার কন্ডিশন দেখলে হাসাহাসি করবে। এই হীনম্মন্যতার কারণে মনের ভেতরে ভয় ঢুকে যায়। ওরা যে লেভেলে কথা বলে, যে লেভেলে ওঠাবসা করে, সেটার ধারেকাছেও আপনি নেই। সেই কারণেও আপনি কিছু না করে বসে বসে হয়তো নিজেরই চুল ছিঁড়েন আর হীনম্মন্যতায় ভুগে দিনের পর দিন ওদের পেছন থেকে আরও পেছনে পড়ে যান। কিছুদিন পরে একেবারেই গুটিয়ে নেন নিজেকে। ওদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেন। এই হীনম্মন্যতা একটা পর্যায় পর্যন্ত তেমন সমস্যা নয়। তবে জটিল হয়ে ওঠে তখনই, যখন এমন অনুভূতির মেয়াদ হয়ে ওঠে দীর্ঘস্থায়ী। অনেকের ক্ষেত্রে এটি মূলত কোনো কারণবশত শৈশব থেকেই সৃষ্টি হয়। ফলে জীবনের প্রায় সবদিকেই হিরোশিমার বিভীষিকার মতো প্রভাব ফেলে যায় থেকে থেকে!
সাধারণত হীনম্মন্যতার জটিলতায় ভোগা মানুষগুলোর কিছুই তেমন ভালো লাগে না এবং তারা চরম সংবেদনশীলতার পরিচয় দেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এ ছাড়া জটিল পরিস্থিতিতে থাকা মানুষগুলো অন্যের সামনে নিজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেন না এবং নিজের ভেতর নিজেকে ছোট ভাবার এই অবস্থা কাটিয়ে তুলতে, নিজের চারপাশেই একটা দেয়াল তুলে রাখেন সব সময়। এই কাজ কেন করেন তারা? যেন আশপাশের মানুষের কাছে নিজের এই হীনম্মন্যতা বা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ধরা না পড়ে।
লক্ষণ দেখে যায় চেনা
এমন মানুষদের জটিলতার লক্ষণগুলো প্রায় একই রকম। তাই বৈশিষ্ট্যগুলো জানাও গুরুত্বপূর্ণ। হীনম্মন্যতায় ভোগা মানুষগুলো—
সহজেই অসম্মানিত বোধ করেন
অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন
মনে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা পোষণ করেন
সব সময় অন্যের মনোযোগ পাওয়ার বাসনায় থাকেন
প্রতিনিয়ত ভুল খোঁজার চেষ্টায় থাকেন
সামাজিকভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন
সব কাজে উদ্বেগ প্রকাশ করেন
অলস সময় কাটান
নিজেকে সময় না দিয়ে অন্যের কথা ভেবে সময় পার করেন
সৃজনশীল কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখেন
এদের আত্মবিশ্বাস নেই বললেই চলে!
সমাধানের খোঁজ
হীনম্মন্যতার জটিলতা থেকে বেরোতে সব চেষ্টা নিজেকে করতে হবে। এর বাইরে তেমন কোনো উপায় নেই এটা কাটানোর। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামালের কাছে এর সমাধান জানতে চাইলে তিনি বলেন,
আপনি যা, তা-ই হিসেবে নিজেকে গ্রহণ করার চেষ্টা করুন। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করবেন না। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে আপনার মতোই তৈরি করেছেন।
নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের মনকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করুন। বাড়ান আত্মবিশ্বাস। নিজেকে সফল ব্যক্তিদের কাতারে দাঁড় করাতে শিখুন।
গঠনমূলক কাজ করুন। যেসব কাজে আপনার দক্ষতা ভালো, সেগুলো করুন।
নিজেকে বোঝার সময় দিন। নিজেকে কীভাবে সফলতা উপহার দিতে পারবেন, সে কথা ভাবুন। কারও প্রশংসা কুড়ানোর জন্য তার কথা ধরে নিজেকে তৈরির বৃথা চেষ্টা করতে যাবেন না।
নিজেকে একটি ছকে বেঁধে নিতে পারেন। বাড়াতে পারেন ব্যস্ততা। কারণ, অলস বসে থাকলেই অপ্রাসঙ্গিক চিন্তা মাথায় ঘোরে। ফলে নিজেকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে হতাশ হয়ে পড়ার শঙ্কা থাকে।
কোনো মানুষই সব বিষয়ে পারফেক্ট হয় না। এ কথা সবাই জানে। আপনি হয়তো গান ভালো গাইতে পারেন না, অফিসে আপনার পদোন্নতি হতে দেরি হচ্ছে, আপনি ভালো লিখতে পারছেন না। এগুলো নিয়ে ভেবে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।
‘অন্যের মতো হতে পারছি না’—এমন ভাবনাই বেশি হীনম্মন্যতা তৈরি করে। আপনার যা আছে, সেটাকেই ভালো করে গড়ুন, সবার মাঝে উদাহরণ তৈরি করুন।
মানুষ কী মনে করবে—এমন দুর্ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। অনেকে আজীবন এটা ভেবেই নিজেকে শেষ করে দেয়—‘না জানি মানুষ আমাকে কী ভাবছে!’
যত গুটিয়ে থাকবেন, তত হীনম্মন্য হতে থাকবেন। লাজুক, মুখচোরা মানুষগুলো বেশি দ্বিধায় ভোগে। তাই আশপাশের সবার সঙ্গে মিশুন। এতে বুঝবেন, সবাই আপনাকে কেমন চোখে দেখে।
উড়ে যাক ধুলোয়
এবার নিশ্চয়ই নিজেকে ভালোবাসবেন আপনি? সমস্ত পিছুটান ও হীনম্মন্যতা ঝেড়ে বিদায় করে শুয়ে পড়বেন খুশির বালুমাখা তীরে? লুটোপুটি খেতে খেতে মন খারাপের কথাগুলো রোদের কাছে বেচে দেবেন চড়া দামে? গল্প জমাবেন সূর্যের আলোয় তেতে ওঠা বালুর সঙ্গে? বালুর যে শব্দ ধরে এগিয়ে যায় উচ্ছ্বাস, সেই শব্দ ধরে আগাতে থাকুন আপনিও। পেছনে রোদের পিঠে আছড়ে পড়বে নীল ঢেউ। রং-ঢঙের বেলাভূমি ধরে আপনি এগিয়ে যেতে যেতে পৌঁছে যাবেন কোনো এক অচেনা গ্রামের বটতলায়। হয়তো সেই গ্রামটাই আপনার। গ্রামের সজীবতায় আনন্দের ফানুস উড়িয়ে চলবেন আর হীনম্মন্যতা নামের দানবটাকে আগুনে পুড়ে ছাইচাপা দেবেন। কিংবা কোনো এক অজানা দ্বীপে পাঠাবেন নির্বাসনে। শরীর থেকে একে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বুকে টেনে নেবেন ঈদটাকে। সেই সঙ্গে গ্রামের সূর্যের চোখে চোখ রেখে শহুরে ক্লান্তি মুছে নতুন নিষ্পাপ সূর্য দেখে ভাববেন, শহরে কেন এমন সূর্য দেখা যায় না? কেন থাকে না তাতে এত আলো? সূর্যের আবেগী আলো গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা গ্রামের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনটা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়তই লেগে থাকে ঈদ। তবু কেতাবি ঈদ বাড়তি মাত্রা যোগ করে। বন্ধনটাকে আরও দৃঢ় করে। সেই আনন্দ টগবগ ঈদে নিশ্চয়ই গা ভাসিয়ে দিয়ে বলবেন, সব হীনম্মন্যতা উড়ে যাক ধুলোয়!
ছবি: ইন্টারনেট