পাতে পরিমিতি I ওজন কমুক দ্রুত
কখনো কখনো অল্প সময়ে বেশি ওজন কমানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। কিন্তু নিজের মনমতো ডায়েট ও ব্যায়াম করলে উল্টো অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে নির্বাচিত খাবারগুলো সঠিক সময়ে খেয়ে পরিমিত ব্যায়ামের মাধ্যমে কম সময়ে বেশি ওজন ঝরানো যায়। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
স্থূলতা বা ওজনাধিক্য বর্তমানে আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম। কাম্যের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন থাকলে শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতা যেমন ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, লিভারের পাথরসহ নানা সমস্যা হতে দেখা গেছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওজন কত থাকা উচিত, তা নির্ভর করে তার বয়স ও উচ্চতার ওপর। স্থূলতার কয়েকটি গ্রেড রয়েছে। তবে কারও ওজন স্ট্যান্ডার্ডের চেয়ে ১০ কেজি বা তার বেশি হলেই তাকে স্থূলকায় বলা হয়।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) ঠিক আছে কি না, সেটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বিএমআই হলো হাইট এবং ওজনের রেশিও; যা ১৮.৫-২৪.৯ এর মধ্যে থাকা প্রয়োজন। কোনো ব্যক্তি ওবেসিটির কোন লেভেলে আছেন, তা বিএমআইয়ের মাধ্যমে বোঝা যায়।
ওজন কেন বাড়ে
ওজন বাড়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন:
প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ফলে ওজন সঠিক লেভেলে থাকে না।
যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করেন অর্থাৎ যাদের স্যাডেনটারি লাইফস্টাইল, তাদের ক্যালরি বার্ন খুবই কম হয়। ফলে অল্প অল্প করে ওজন বাড়তে এবং ফ্যাট জমতে থাকে।
বিভিন্ন রকম অসুস্থতার জন্যও ওজন বাড়তে পারে। যেমন থাইরয়েডের সমস্যা। এ ছাড়া যারা স্টেরয়েড জাতীয় মেডিসিন গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে ওজনাধিক্য।
উপায়
ওজন বেড়ে গেলে ভয় না পেয়ে সতর্ক হতে হবে। বাড়াতে হবে সচেতনতা। সাধারণত যেসব খাবার ওজন বাড়ায়, সেগুলো এড়িয়ে চললে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। সে ক্ষেত্রে সবার আগে কিছু উপাদানকে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন:
সিম্পল সুগার: সুগার বা চিনি আসলে একরকম পয়জন। ব্রাউন কিংবা হোয়াইট—কোনো সুগারই খাদ্যতালিকায় না রাখা ভালো। ব্রাউন সুগার হোয়াইট সুগারের চেয়ে কিছুটা ভালো হলেও পুরুষ বা নারী নির্বিশেষে ৩০ বছরের পর থেকে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা স্বাস্থ্যসম্মত। যারা খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত সুগার বা মিষ্টিজাতীয় খাবার রাখেন, তাদের সব সময়ই ওজন বেশি হতে দেখা যায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত সুগার, এমনকি অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণেও ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যেতে পারে রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড।
ট্রান্স ফ্যাট: আমাদের দেশে ট্রান্স ফ্যাট খুবই সহজলভ্য, যা পাওয়া যায় ভাজাপোড়া খাবার ও স্ট্রিট ফুডগুলো থেকে। সাধারণত স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিদের বাইরের ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে দেখা যায়। কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে সবারই স্ট্রিট ফুড বাদ দেওয়া দরকার। কেননা একই তেলে বারবার ভাজার কারণে তেলের নিজস্বতা হারিয়ে ট্রান্স ফ্যাট তৈরি হয়, যা গ্রহণে হার্ট ডিজিজ, লিভারের সমস্যাসহ পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগ হওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই খাদ্যতালিকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে বাইরের খোলা খাবার ও জাঙ্ক ফুড।
আলোর ইশারা
আশার কথা হলো, আজকাল স্থূলতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচেতন ব্যক্তিরা ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। তবে সে ক্ষেত্রে ভুলটি হলো, অনেকেই নিজে নিজে ডায়েট করার চেষ্টা করেন; আবার অনেক সময় একই ডায়েট চার্ট অন্যজন ফলো করেন। ফলে ওজন তো কমেই না, বরং শরীরে ফ্যাটগুলো আরও জমে যায়, স্থায়ী হয়। আবার, কারও কারও ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ওজন কমলেও বডিতে নিউট্রিশনাল ইমব্যালেন্স হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ওজন কমাতে হলে অবশ্যই প্রপার গাইডলাইন ফলো করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যাদের খুব দ্রুত ওজন কমানো দরকার, তাদের আরও জোরালোভাবে মানতে হবে ডায়েট।
স্বল্প সময়ে ওজন কমানোর জন্য খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে এই উপাদানগুলো:
গ্রিন টি: যারা দ্রুত ওজন কমাতে চান, তারা প্রতিদিন সকালে এক কাপ এবং বিকেলে এক মগ গ্রিন টি গ্রহণ করতে পারেন। তবে অবশ্যই এতে চিনি যোগ করা যাবে না। প্রয়োজনে আধা চা-চামচ মধু দিয়ে নিতে পারেন।
বাদাম: প্রোটিন, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ কাঠবাদাম ওজন কমাতে খুবই কার্যকর। প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় স্ন্যাকস হিসেবে এক মুঠো কাঠবাদাম রাখা যেতে পারে। এটি লো ক্যালরির হওয়ায় ক্ষুধা নিবারণে একটু বেশি খেয়ে ফেললেও ক্ষতি নেই। এ ছাড়া কাঁচা চিনাবাদাম সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন রাখা যেতে পারে। এতে রয়েছে প্রচুর গুড ফ্যাট; যা রক্তের এইচডিএল বাড়িয়ে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
ওটস: যারা ওজন কমাতে চান, তাদের কাছে ওটস খুবই পরিচিত নাম। ওটস খাওয়ার বিভিন্ন রেসিপি রয়েছে। অনেকেই পছন্দ করেন দুধের সঙ্গে কিছুটা ফল নিয়ে খেতে। আবার অনেকেরই দুধ হজম হয় না। সে ক্ষেত্রে ফলো করতে পারেন এই রেসিপি: হাফ কাপ ওটস নিন। এর সঙ্গে এক কাপ টক দই ও ৫-৬টি কাঠবাদাম ওভার নাইট একটি পাত্রে নিয়ে ঢেকে রাখুন। সকালে ওটস নরম হয়ে গেলে এটি সরাসরি খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। এতে কোনো মিষ্টি উপাদান যোগ করার প্রয়োজন নেই। তবে যারা দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খেতে চান না, তারা ওটসের খিচুড়িও তৈরি করে নিতে পারেন।
চিয়া সিড: চিয়া সিড বর্তমানে মোটামুটি সবার পরিচিত। তবে অনেকেই একে তোকমা দানার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। চিয়া সিড একটু চিকন দানাদার আকৃতির। প্রতিদিন ১ টেবিল-চামচ চিয়া সিড এক গ্লাস পানিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ভিজিয়ে গ্রহণ করতে পারেন, যা দ্রুত ওজন কমাতে সাহায্য করবে। চিয়া সিড প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও আয়রন সমৃদ্ধ।
খাদ্যতালিকা
ওজন কমাতে অনেকেই ফলো করেন বিভিন্ন ধরনের ডায়েট; যেমন: কিটো ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ডায়েট ইত্যাদি। তবে ব্যালেন্স ডায়েট দিয়েও ওজন কমানো যায়। বিষয়টি অনেকেরই ধারণার বাইরে। ডায়েটের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ওজন কমানোর জন্য ৭ থেকে ১০ দিন ফলো করতে পারেন এই খাদ্যতালিকা:
সকালের নাশতা: ব্রাউন ব্রেড বা লাল আটার রুটি একটা। সঙ্গে সবজি ১ কাপ (তেল আধা চা-চামচ দিয়ে সবজি রান্না করতে হবে)।
মধ্য সকাল: অরেঞ্জ জুস বা আপেল জুস।
দুপুর ও রাতের ডায়েট: হাফ কাপ ওটস, স্টিম ফিশ অথবা ডিম সেদ্ধ। সঙ্গে ব্রকলি বা জুকিনি মিক্সড সবজি।
বিকেলের নাশতা: ১ কাপ লো ফ্যাট মিল্ক বা টক দই অথবা টমেটোর স্যুপ।
ডায়েটের সঙ্গে সঙ্গে লাইফস্টাইলকে অবশ্যই ব্যালেন্স রাখতে হবে। শুধু খাবার কমিয়ে দিলেই যে ওজন কমে যাবে, তা নয়। সময়মতো হাঁটা ও এক্সারসাইজ করাও জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন নিয়ম করে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট করে দুই বেলা দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানো এবং তার সঙ্গে ব্যায়াম করা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, ওবেসিটি বা স্থূলতা কোনো রোগ নয়; বরং ওবেসিটির কারণে নানা রকম রোগের সৃষ্টি হয়। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে হলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যা সঠিক লাইফস্টাইলের মাধ্যমেই সম্ভব।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট