স্বাদশেকড় I হলুদের হদিস
ভারতবর্ষ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে বলে ধারণা। রঞ্জক পদার্থ থেকে ঔষধি, তারপর মসলা হয়ে ওঠা। লোকজ থেকে আধুনিক চিকিৎসা—সবেতেই এর অবদান
পশ্চিমা বিশ্বে দারুণ কদর পেয়েছে ভারতবর্ষের একটি মসলা। হলুদ। বর্তমানে এটি সুপারফুড। পশ্চিমা নানান রেসিপিতে যোগ হচ্ছে মসলাটি। ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু রেস্তোরাঁয় এখন ‘গোল্ডেন লাতে’ কিংবা ‘গোল্ডেন মিল্ক’ নামে মেলে হলুদের পানীয়। রোগসারাই গুণের কারণে সেসব দেশের লোকেরা একে সুপার ফুড বলা শুরু করেছে। হলুদের কদর খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি সেখানে। মোটে এক দশক আগে মসলাটির মূল্য বুঝতে শুরু করেছে তারা। তবে ভারতবর্ষ এর গুরুত্ব বুঝেছে অনেক আগে।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই মসলাটি ‘হলুদ’ নামে পরিচিত। সংস্কৃত ‘হরিদ্রা’ থেকে এই শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। শুধু সংস্কৃত ভাষাতেই হলুদের ৫৩টি আলাদা নাম আছে—অনিষ্ঠ, ভদ্র, বহুলা, দীর্ঘরাজা, গন্ধপ্লশিকা, গৌড়ি, ঘর্ষণী, হরিদ্রা, হারিতা, হেমারাগী, হেমারাগীনি, হৃদয়াভিলাষীনি, জয়ন্তি, জয়ারান্তিকা, কাঞ্চনি, কাভেরি, কৃমিঘ্নি, লক্ষ্মী, মঙ্গলপ্রদ, মঙ্গলা, মেহাগ্নি, নিশা, নিশাখা, নিশওয়া, পাতওয়ালুকা, পবিত্র, পিঙ্গ, পিঞ্জ, পিত, পিতিকা, রভংগভাসা, রঞ্জনি, রাত্রিমনিকা, শিফা, শোভনা, শিভা, শ্যামা, শুভাগত, সুর্ভানা, সুর্ভানাভারা, তমস্বিনী, উমাভারা, বৈরাগি, বারাভার্নিনি, বর্ণদাত্রী, বর্ণিনি, বিষগ্নি, যামিনী, যোশিতাপ্রিয়া, যুবতি ইত্যাদি। বিভিন্ন লোকজ বিশ্বাস ও চিকিৎসা থেকেই হলুদের এই বিচিত্র নামগুলোর উদ্ভব।
ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষ থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে হলুদ। এই অনুমান সঠিক না-ও হতে পারে। উৎপত্তি যেখানেই হোক, প্রথম দিকে রসনায় হলুদের ব্যবহার ছিল অজানা। এটি ছিল মূলত রঞ্জক পদার্থ। তা দিয়ে বসন রাঙাতেন তৎকালীন মানুষ; বিশেষ করে ধর্মীয় সাধু-সন্ন্যাসীরা। ধারণা করা হয়, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এটি ব্যবহার করে তাদের বসন রাঙাতেন। পরে মানুষ এর ঔষধি গুণ খুঁজে পান। মূলত রোগনাশী স্বভাবের ওপর ভিত্তি করেই ধীরে ধীরে রসনায় এর সংযোজন। তরকারি ও চায়ের এখন এর উপস্থিতি। প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রে হলুদের ব্যবহার উল্লেখ রয়েছে।
হলুদের সুলুক সন্ধানে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার উল্লেখ করা যেতে পারে। জার্মানির লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ানস ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ববিদ ফিলিপ স্টকহ্যামার একটি গবেষণা চালিয়েছিলেন। তাতে উঠে এসেছে, এশীয় অঞ্চলের এই মসলা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছিল আরও ৩ হাজার ৭০০ বছর আগে। গবেষণার বিষয়ে সায়েন্সডেইলির প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিপ স্টকহ্যামার নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় গবেষক দল লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন ও জর্ডান নিয়ে গঠিত লেভান্তে অঞ্চলের পুরোনো শহর মেগিদ্দোর কিছু তৈজসপত্র খুঁজে পান, যা ৩ হাজার ৭০০ বছরের পুরোনো। সেসব পাত্রে হলুদের ছাপ মিলেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, সেসব অঞ্চলে হলুদ বিক্রি হতো। তা ছাড়া কিছু কঙ্কাল পরখ করে সেগুলোর দাঁতে হলুদের ছাপও পাওয়া গেছে। এসব গবেষণা মেনে নিলে বলা চলে, লেভান্তে অঞ্চলে হলুদের ইতিহাস প্রায় ৩ হাজার ৭০০ বছরের।
রঞ্জক পদার্থ থেকে রসনায় চলে আসার মধ্যখানে প্রাচীনকালে হলুদ দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল লোকজ ওষুধ হিসেবে। সেকালে, এমনকি একালেও মসলাটি বেশ কিছু রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রোগ সংক্রমণ এড়াতে হলুদ ব্যবহার করতেন সেকালের চিকিৎসকেরা। বিভিন্ন কাটাছেঁড়া ও ব্যথা উপশমেও মসলাটির ব্যবহার ছিল। ক্ষতস্থানে এটি অ্যান্টিসেপটিকের কাজ করে। হাড়ের সমস্যা দূর করতেও সেকালে ছিল হলুদের ব্যবহার, বিশেষ করে কাঁচা হলুদ। বর্তমানে যে তরিকায় পশ্চিমারা গোল্ডেন লাতে তৈরি করে পান করেন, অনেকটা সেই কায়দাতেই তৈরি হতো হাড়ের যন্ত্রণা উপশমকারী হলুদের পানীয়। কৃমি সমস্যা দূর করতেও হলুদের ব্যবহার প্রাচীন। তা ছাড়া সর্দি-কাশির চিকিৎসায় লোক চিকিৎসকেরা হলুদকে পথ্য হিসেবে ব্যবহার করেন। এখনো রক্তশূন্যতা দূর করতে কাঁচা হলুদের রস পান করেন অনেকে। ত্বক পোড়া চিকিৎসাতেও কাজে লাগে হলুদ। ডায়রিয়া নিরাময়েও কার্যকর এটি।
বর্তমানে লোকজ ছাড়াও আধুনিক চিকিৎসায় হলুদের ব্যবহার হচ্ছে। গত দশকের মাঝামাঝি এই মসলা থেকে ক্যানসারের ওষুধও আবিষ্কৃত হয়েছে। কাজটি করেছে ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্র। সেখানকার গবেষকেরা পলিমারভিত্তিক ন্যানো বাহকের মাধ্যমে ক্যানসার কোষকলায় ক্যানসারবিরোধী কারকিউমিন ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করার গুণাগুণ রয়েছে হলুদের এই উপাদানে। এটি প্রস্টেট, স্তন ও অন্ত্রের ক্যানসার রোধ করতে সক্ষম।
তা ছাড়া হলুদে থাকা আরও কিছু উপকারী উপাদান শরীরের নানা রোগ সারাই করতে পারে। যেমন শিশুদের লিউকেমিয়া দূর করতে ভূমিকা রাখে এটি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চর্বি বিপাকে ভূমিকা রাখে বলে রান্নায় নিয়মিত হলুদ খেলে ওজন কমে। চীনে বিষণ্নতা দূর করতে এটি পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চোখের অসুখও সারাতে পারে এই মসলা। কাঁচা হলুদ শুকিয়ে খাওয়ালে তোতলামি দূর হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও হাঁপানি দূর করতেও বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে হলুদ। শরীরের অভ্যন্তরীণ রোগবালাই দূর করার পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই হলুদ ত্বকচর্চায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশেষ করে ব্রণ, বলিরেখা ও চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতে এর জুড়ি নেই। পা ফাটা সমস্যা দূর করতেও এর ব্যবহার আছে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট