ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I আরব আবর্তে
প্রভাবিত বিশ্ব ফ্যাশন। কারণ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঐতিহ্যে থমকে না থেকে নতুন প্রজন্মের ডিজাইনাররা পোশাকে অবাধ মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত
ভৌগোলিক আর সাংস্কৃতিক প্রভাবে প্রভাবিত হয় ফ্যাশন। আর্থসামাজিক অবস্থাও ফ্যাশনকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করে। আরবের ফ্যাশনও এর বাইরে নয়; বরং কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যে তা সুস্পষ্ট। যেমন আঁটসাঁট নয় পোশাকগুলো। বেশ ঢিলেঢালা। এর কারণ সেখানকার ভৌগোলিক অবস্থান আর আবহাওয়া। মাথায় অনুষঙ্গ বরাবরই জনপ্রিয়। সঙ্গে রঙিন হেড স্কার্ফ। আর পোশাকের দীর্ঘ বহর, অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বেশ খানিকটা লম্বা ও দীর্ঘ ঝালর। সেটা মুসলিম কালচার মেনে। আরবের ফ্যাশনে মূলত ইস্টার্ন ফ্যাশন আর মুসলিম বিশ্বের মিশেল দেখা যায়। পোশাক বেশ জমকালো নকশার হয়ে থাকে। সৃজনশীলতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মিশেল দেখা যায়। থাকে সূক্ষ্ম নকশায় অলংকরণ।
তবে সময়ের বিবর্তনে কতিপয় ডিজাইনারের প্রভাবে ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে আরবের ফ্যাশন। বর্তমান সময়ে এই অঞ্চলের পোশাকের প্যাটার্নে পষ্ট পশ্চিমা ফ্যাশনের প্রভাব। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আরব ফ্যাশন নিজস্বতা হারাচ্ছে; বরং পূর্ব আর পশ্চিমা ফ্যাশনের নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে আরব ফ্যাশনে। বিশ্বায়নের প্রবল প্রতাপ গোটা ফ্যাশন দুনিয়ায়। সবাই সবার কাজের ধরন জানার সুযোগ পাচ্ছে। একই সঙ্গে পছন্দমতো নিজের নকশা নিয়ে নিরীক্ষাও করে নেওয়া যাচ্ছে। তাই নিজস্বতা ছাপিয়ে বেশ কিছু দেশের ফ্যাশন প্রভাবিত হয়েছে অন্যদের ফ্যাশনে। আরব ফ্যাশনের ক্ষেত্রে এই প্রভাব খানিকটা ব্যতিক্রম বিধায় তাদের ফ্যাশনধারা নিয়ে আলাদা করে আলোচনার জায়গা তৈরি হয়েছে বিশ্বজুড়ে।
আরবের ফ্যাশন ডিজাইনারদের মাঝে নিজস্ব ধারাকে বিশ্ব ফ্যাশন দুনিয়ায় পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। বরাবরই তারা নিজেদের নিপুণ নকশার পোশাক তুলে এনেছেন আন্তর্জাতিক ফ্যাশন অঙ্গনে। তাদের নকশা করা পোশাকে রেড কার্পেট মাতিয়েছেন বহু নামিদামি তারকা। আরব ফ্যাশনের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে ক্রমেই। কলেবরে বেড়েছে তাদের ফ্যাশন লাইন।
জুহায়ের মুরাদ
আরব ডিজাইনার ওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন ১০ বছর বয়স থেকে। নিজেকে ওয়ান ম্যান আর্মি হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন ৪৮ বছর বয়সী এ লেবানিজ ফ্যাশন ডিজাইনার। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি পশ্চিমের সঙ্গে পূর্বের ফ্যাশনের সন্ধি করে ডিজাইন করেছেন। তার লেবেলের পোশাক পরতে মুখিয়ে থাকেন হলিউডের সেলিব্রিটিরা। ‘জুহায়ের মুরাদ ওমেন’ মানেই অভিজাত, রুচিশীল আর অন্যদের থেকে একদম আলাদা। এই ডিজাইনারের পোশাক যেন এক ধাপ বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তোলে পরিধানকারীকে। সেটাই সুস্পষ্ট তার মডেল আর ক্রেতাদের দৃপ্ত পদক্ষেপে। জুহায়েরের লেবেলের প্রতিটি পোশাক বরাবরই খবরের পাতার খোরাক। রাশিয়ার বিজনেস টাইকুন মুসা বাজোভের মেয়ের বিয়েতে এই ফ্যাশন ডিজাইনার যে পোশাকটি নকশা করেছিলেন, সেটির দাম ছিল চার লাখ মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক অঙ্গন আর তারকাদের উইশলিস্টেও জুহায়ের মুরাদ ব্র্যান্ড একটি কাঙ্ক্ষিত নাম। অ্যাডেলে, জেনিফার লোপেজ, প্রিয়াংকা চোপড়া জুহায়েরের নকশা করা পোশাক পরেছেন। জুহায়ের মুরাদ বিশ্বদরবারের ট্রেন্ড সেটারদের জন্য পোশাক নকশা করার ক্ষেত্রে বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছেন নিজের দেশের ফ্যাশনকে। আইকনিক এই ডিজাইনারের হাত ধরে আরব ফ্যাশন আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। জুহায়েরের পোশাকে আন্তর্জাতিক তারকারা আরব ফ্যাশনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, করে যাচ্ছেন।
এলি সাব
লেবানিজ ফ্যাশন ডিজাইনার। আরব ফ্যাশনের বিশ্বময় যাত্রায় তার নাম নিতেই হবে। ১৯৮০ সাল থেকে বিয়ের পোশাক নকশা করে আসছেন। বিয়ের কনের পোশাক তার ব্র্যান্ডের বিশেষত্ব। নকশায় লেইস ওয়ার্ক করেন নিয়মিত। এর সঙ্গে থাকে জেম স্টোন এবং মুক্তোর মিশেল। হ্যান্ড এমব্রয়ডারিতে পরিপূর্ণ করেন নকশা। এখানে ডিটেইলিং প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। মিহি সুতোর সূক্ষ্ম ফোঁড় দিয়ে যা পরিস্ফুট হয় পোশাকে। রাজকীয় পোশাক নকশা করেছেন এই ডিজাইনার। ২০১৯ সালে বিলেতের প্রিন্সেস কেট মিডলটনের রয়্যাল অ্যাসকোটের পোশাক তৈরি করেছিলেন তিনি। এলি সাবের ডিজাইনে ভেইল এবং হুডের ব্যবহার বিশেষ গুরুত্ব পায়। ২০১৭ সাল থেকে এলি সাব সিগনেচার ব্র্যান্ডের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে বিশ্বব্যপী। নিজস্ব বুটিক ছাড়াও প্যারিস, লন্ডন, বৈরুতে অন্তত ১৬০ জন রিটেইলারের কাছে এই ডিজাইনারের তৈরি পোশাক মিলবে। তিনি প্রথম আরব ডিজাইনার হিসেবে অংশ নেন গভর্নিং বডি অব ফ্যাশন, সম্বর স্যান্ডিকল দ্য লা ওত কতুরে।
জর্জেস হোবিকা
১৯৯৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে নকশা করা পোশাক বিক্রি শুরু করেন এই আরব ফ্যাশন ডিজাইনার। লেবাননের বৈরুতে অবস্থিত নিজস্ব অ্যাটেলেয়ারের মাধ্যমে। হোবিকার ডিজাইনের পোশাকে উজ্জ্বল রঙের থেকে ডাউন টোনের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। আর অলংকরণে জেম স্টোন ব্যবহার তার বিশেষত্ব। প্যাটার্নে তিনি ইস্টার্ন ফ্যাশনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। যুগের পর যুগ ধরে হোবিকার ডিজাইনের প্রতি আগ্রহ ধরে রেখেছেন ফ্যাশন-সচেতনেরা। ফ্যাশন উইকে তাই এই ডিজাইনারের সরব উপস্থিতি নিয়মিত। জর্জেস হোবিকা তাই সব সময়েই ইন ট্রেন্ড। ওত কতুর নিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ। গঠনগত নকশা থেকে শুরু করে অলংকরণ—সবখানেই হাতের জাদুতে ফুটিয়ে তোলা হয় অনবদ্য সব নকশা। সেই সঙ্গে রেডি টু ওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পশ্চিমা ফ্যাশন ও প্রাচ্যের ফ্যাশনের পার্থক্য হোবিকার প্রতিটি নকশায় প্রবলভাবে দৃশ্যমান। আলাদা করা যায় দুটির স্বতন্ত্রতা।
মিরোশা মিজন
‘বি ইউর সেলফ, বি দ্য ফ্যাশন’ এই মন্ত্রে বিশ্বাসী দুবাই বেসড এ ডিজাইনার। ওত কতুর ধারায় কাজ করেন। হ্যান্ড পেইন্ট ও সুই-সুতোর কাজের মাধ্যমে দৃশ্যকল্পকে তুলে আনেন পোশাকে। পোশাক হয়ে ওঠে ক্যানভাস। মোটিফে প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেন। বিভিন্ন রকম বন্য প্রাণী স্থান পেয়েছে এই ডিজাইনারের কাজে। বাঘ থেকে শুরু করে ফ্লেমিঙ্গো—মিজনের তুলিতে সবই প্রাণবন্ত। পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্ব দেন উৎপাদনপ্রক্রিয়া। শুরু থেকে শেষ অবধি। চেষ্টা থাকে সূক্ষ্ম সবকিছুকে উৎকর্ষমণ্ডিত করার। ডিজাইনার মিজন তার ক্রেতাদের গুরুত্ব দিয়ে নকশা করেন। চেষ্টা করেন তার প্রতিটি পোশাকেই যেন পরিধানকারী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফ্যাশন ডিজাইনার মিজনের নকশা করা পোশাকে মূর্ত হয় আরব্য রজনী। ধূলি ধূসরিত প্রান্তর থেকে সেখানকার গাছপালা অব্দি ফুটে ওঠে নকশায়। মিরোশা মিজনের থিমনির্ভর প্রথম কাজ ‘ফ্রম দ্য গাফ ট্রি টু বুরজ খলিফা’। এই কালেকশন প্রকাশ করা হয় ২০১৯ সালে। দ্য ইয়ার অব টলারেন্সের অনুপ্রেরণায়। ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করেন এই ডিজাইনার। নজর থাকে সেলাইনৈপুণ্যের দিকেও। সবের মিশেলে তৈরি হয় একেকটি মাস্টারপিস।
আরব এখন ফ্যাশনবিশ্ব জয় করার পথে। লেয়ারিং, ওত কতুর, মূল্যবান রত্নের ব্যবহার, পোশাকের দীর্ঘ বহর—এ সবকিছুই এখন ট্রেন্ডি। ফ্যাশন-বাণিজ্যে দুবাই হয়ে উঠেছে একটি কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচ্য আর পশ্চিমা ফ্যাশনের মেলবন্ধনে দারুণ জমজমাট। আরব ফ্যাশন মানেই ‘মডেস্ট ওয়্যার’। এই সংস্কৃতিকে আরব ডিজাইনাররা সৃজনশীলতার মাধ্যমে নিয়মিত নান্দনিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন। ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেরাটাই নিচ্ছেন। নিজস্বতা ভুলে যাওয়ার এই সময়ে স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছেন আরব ডিজাইনাররা। নিজেদের কৃষ্টিকে আধুনিকতার সঙ্গে মিশিয়ে করে তুলেছেন সর্বজনীন। আরব ফ্যাশন কোনো গ্লাস সিলিংয়ে আটকে নেই; বরং ফ্যাশনের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট