ফরহিম I অন্ত্র মন্ত্র
ত্বকের সুস্থতা রক্ষার মূল উৎস। সেই সঙ্গে সমস্যা সারাইয়েও। ঝামেলা এড়াতে নজর দিতে হবে সবার আগে
বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষকেরা বুঝতে শুরু করেছেন, শরীরের পুরো নিয়ন্তা মস্তিষ্ক নয়! বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, পেট (ভদ্র ভাষায় অন্ত্র) আমাদের শরীরে একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। সুস্থ পেট মানুষের শরীরকে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি মনের জোরও নাকি বাড়িয়ে তোলে।
নিয়মিত পরিচর্যা, এমনকি এর বাইরে বাড়তি যত্ন নেওয়া সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ নানা ধরনের ত্বকের সমস্যায় ভোগেন। সব পেটের দোষ। প্রমাণিত। পেট খুশ তো দুনিয়া খুশ। শুনতে খটকা লাগলেও এটাই ধ্রুব সত্য বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে।
জনপ্রিয় গাট হেলথ এক্সপার্ট কার্লা ওটিসের মত, পেট আর ত্বক—একে অন্যের সঙ্গে এতটাই সম্পর্কিত যে এটাকে ‘গাট-স্কিন এক্সিস’ নামকরণ করা হয়েছে। তিনি আরও যোগ করেন, ‘এটা শুনতে খুব একটা গ্ল্যামারাস না হলেও সত্যি এটাই যে, আমাদের ইমিউন সিস্টেমের পুরোটাই এই পেটের ওপর নির্ভরশীল। এখানেই পুষ্টি, হরমোন মেটাবোলাইজ ও ডিটক্সিফায়িং এনজাইম তৈরি হয়, সেই সঙ্গে প্যাথোজেনগুলো সাম্যাবস্থায় আসে আর নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি হয়। তাই ভালো বোধ করার পাশাপাশি পরিষ্কার উজ্জ্বল ত্বক পেতে পেটের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা অতি জরুরি।’
সেলিব্রিটি নিউট্রিশনিস্ট, ওয়েলনেস এক্সপার্ট কিম্বার্লি স্নাইডারও এ ব্যাপারে সহমত। তার থিওরি অনুযায়ী, পেট কেবল পেট নয়—এটা বেশ জটিল এক উপনিবেশ। পেটের মধ্যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আর মাইক্রোবের স্ট্রেইন রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় গাট মাইক্রোবায়োম। এই মাইক্রোবায়োম পুরো শরীরের হোমিওস্ট্যাটিস বজায় রাখে, তবে এর ভারসাম্যে তারতম্য ঘটলেই তার প্রভাব সরাসরি ত্বকে দেখা যায়।
ভারতীয় ইন্টিগ্র্যাটিভ গাট মাইক্রোবায়োম হেলথ কোচ ও ফাংশনাল মেডিসিন নিউট্রিশনিস্ট জানভি চিতালিয়া ত্বকে পেটের দুরবস্থার প্রভাব নিয়ে বেশ অনেক দিন কাজ করছেন। তার ভাষ্যমতে, ‘ত্বক হলো পেটের সমস্যার সবচেয়ে দৃশ্যমান সূচক। অসামঞ্জস্যপূর্ণ পেটের ব্যথা, অ্যালার্জি বা হরমোনজনিত পরিবর্তনে ত্বক বিভিন্নভাবে তার প্রভাব দেখায়। যেমন অ্যাকনে, ত্বক জ্বালাপোড়া, একজিমা, র্যাশ, ত্বকে অস্বস্তি, লালচে ভাব, ফেটে যাওয়া বা রং ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।’ তার গবেষণায় জানা গেছে, কীভাবে পেটের সমস্যা ত্বকের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বেশ কয়েকভাবে পেটের সমস্যা ত্বককে প্রভাবিত করতে পারে এবং ত্বকের সমস্যাকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলতে পারে—
পেটের সমস্যা থেকে ইন্টেস্টাইনে জ্বালাপোড়া হতে পারে, যা ত্বকেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
স্ট্রেস, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যালকোহল, সিগারেট, অতিরিক্ত চিনি ও বিভিন্ন দূষণ পেটের উপকারী ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দেয় আর ত্বকের পুষ্টিতে ঘাটতি তৈরি করে, ফলে নানা ধরনের ত্বকের সংক্রমণ হতে পারে।
পরিবেশে আর খাবারে মিশে থাকা পলিউট্যান্ট আর টক্সিনের সংস্পর্শ, আর মাত্রাতিরিক্ত ব্যথার ওষুধ ও অ্যান্টাসিড আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম) সংক্রান্ত ঝামেলা আরও বাড়িয়ে তোলে, যার কারণে মুখে ব্রণ বা মুখের ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে বিশেষত চিবুক, কপাল এমনকি পিঠেও।
পাকস্থলীর অ্যাসিড কমে যাওয়ার কারণে এসআইবিও (স্মল ইন্টেস্টাইন ব্যাকটেরিয়াল ওভারগ্রোথ) বেড়ে যেতে পারে, যা সরাসরি রোজাশিয়া (মুখের ত্বকে অমসৃণ, লালচে ভাব) সৃষ্টি করে।
অসুখী পেট থেকে কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলো তো জানা গেল। এবার এর থেকে রক্ষার উপায়ও জানা প্রয়োজন। জীবনযাপনের তরিকায় একটুখানি বদল পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে, ফলাফলে সুখী পেট আর ত্বক—দুটোই নিশ্চিত হবে।
কিছু নির্দিষ্ট খাবার যেমন প্রসেস করা খাবার, ভাজাপোড়া, ডেইরি, সুগার বা শর্করা আছে এমন খাবার, গ্লুটেন আর যেকোনো অস্বাস্থ্যকর, জাঙ্ক খাবার নিত্যদিনের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এগুলো পেটের উপকারী ব্যাকটেরিয়া আর অপকারী ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে, যা শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া পেটের এই ভারসাম্যহীনতা ত্বকে ড্রাই স্কিন প্যাচ; সোরাইসিস (রুপালি ঝিল্লি দিয়ে ঢাকা ত্বকে লাল, ঝুরঝুরে, ফ্লেকি অবস্থা); একজিমাসহ ত্বকের রোগ—বুলিস পেম্ফাগোয়িড (মূলত বয়স্ক মানুষদের হওয়া জটিল চর্মরোগ; যেটা চুলকানি ও র্যাশ দিয়ে শুরু হয় আর পরে পরিণত হয় বেশ বড় ফুসকুড়িতে); লাইকেন প্ল্যানাস (ত্বকের সাধারণ রোগ যেটায় চুলকানি ও র্যাশ হয়) সৃষ্টি করে।
প্রচণ্ড শুষ্ক ত্বক নিয়ে বরাবরই কমবেশি অভিযোগ থাকে সৌন্দর্যসচেতনদের মাঝে। যেটার প্রধান কারণ হতে পারে পরিমিত পানি পান না করা বা খাবারে ‘ভালো’ ফ্যাটের অভাব। যেগুলো ত্বককে ভেতর থেকে পুষ্টি দেয়, আর ত্বকের শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে।
শরীর ইনসুলিন প্রতিরোধী অবস্থায় চলে গেলে বা প্রি-ডায়াবেটিস হলে—লক্ষণ হিসেবে ত্বকের রং পরিবর্তন হয়। বিশেষত বাহুমূলের নিচে, কাঁধে, কপালে এমনকি ভ্রুর নিচেও। ইনসুলিন ও রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রেখে এই পিগমেন্টেশন কমানো সম্ভব।
প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় এমন সব খাবার ঢোকাতে হবে যেটা ত্বককে সহায়তা করবে। কিছু স্বাস্থ্যকর প্রোবায়োটিকস (ব্যাকটেরিয়া ও ইস্ট) রয়েছে যেমন দই, কাঞ্জি বা চালের পানি ও কিমচি থাকতে পারে নিয়মিত মেনুতে। ‘ভালো’ ফ্যাট হিসেবে রয়েছে অ্যাভোকাডো তেল, নারকেল দিয়ে বা নারকেল তেল দিয়ে তৈরি খাবার। এগুলোও খুব উপকারী। অলিভ বা অলিভ অয়েল, বোন ব্রথ বা মাছের কাঁটা, মুরগি অথবা খাসির হাড় দিয়ে তৈরি কোলাজেন ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় দারুণ কার্যকর। সেই সঙ্গে প্রচুর ফল ও সবজি রাখতে হবে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায়।
এগুলোর পাশাপাশি কিছু টোটকা মেনে চললে পেটের সমস্যারও সমাধান হবে আর ত্বকও থাকবে সুস্থ সুন্দর।
অটোইমিউন ঠিক রাখতে কুসুম গরম পানিতে আদা ও হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে পান করা।
কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যা কমাতে জিরা, আজোয়ান ও ধনিয়া পানিতে সেদ্ধ করে সেই পানি পান করা বা মূল খাবার খাওয়ার ২০ মিনিট আগে আদাকুচি ও লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া।
নিয়মিত যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, হাঁটা বা ব্যায়াম পেট ও ত্বক—দুটোই সুস্থ রাখে অনেকাংশে। এটা ত্বককে বিষমুক্ত করে স্বস্তি দেয় এবং ত্বকের স্বাস্থ্য দিনে দিনে আরও ভালো পর্যায়ে নিয়ে আসতে থাকে।
আল মারুফ রাসেল
মডেল: জামি
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: তানভীর খান