টেকসহি I নিরীহ কুমিরের জীবনযুদ্ধ
ভুল, সবই ভুল! প্রাণীটি কুমির গোত্রের হলেও মানুষ বা গবাদিপশুকে আক্রমণ করে না। অথচ ভুল অনুমান আর নিষ্ঠুরতার কারণে ওরা হারিয়ে যেতে বসেছে। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
ঘড়িয়াল এক বিস্ময়কর প্রাণী। সেই ডাইনোসরের যুগ থেকে এখনকার সময় পর্যন্ত তারা টিকে আছে, তবে ভালো নেই। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এতগুলো বছর পার করে দেওয়ার পরও এখন যুঝতে হচ্ছে মানুষের সঙ্গে। আদি ঘড়িয়াল বা গাভিয়ালিস গাঞ্জেটিকাস টিকে ছিল ক্রিটেশাস যুগের শেষ পর্যায় (৬৫ মিলিয়ন বছর আগে) থেকে ইয়োসিন (৫৫ মিলিয়ন বছর আগে) পর্যন্ত। আমরা এখন যে ধরনের ঘড়িয়াল দেখি, সেটাও প্রায় একই সময়ে বিবর্তিত হয়েছিল আফ্রিকার জলা আর উপকূলের পানিতে, তারপর ছড়িয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে।
কুমির (ক্রোকোডাইলিয়ান) গোষ্ঠীর এই নিরীহ প্রাণীকে খুব সহজেই আলাদা করা যায় লোনাপানি ও মিঠাপানির কুমিরের থেকে। হালকা মাথা আর লম্বাটে সরু চোয়াল সহজেই অন্য কুমিরগুলোর থেকে একে অনন্য করে তুলেছে; পাশাপাশি পুরুষ ঘড়িয়ালের লম্বা নাকের ওপরে ‘ঘড়া’র আকৃতি বেশ সহজে চোখে পড়ে। বলা বাহুল্য, এই ‘ঘড়া’ বা পানি রাখার পাত্রের নাম থেকে বাংলায় ঘড়িয়াল নামের উৎপত্তি।
নিরীহ প্রাণী ঘড়িয়াল মূলত রাক্ষুসে মাছ খায় বলে নদীতে অন্যান্য মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। ঘড়িয়ালের খাবারের তালিকায় রয়েছে পচা জৈব পদার্থ; ফলে নদীর পরিবেশও দূষণের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পায়। তবে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, ঘড়িয়াল নাকি মানুষ বা গবাদিপশুকে আক্রমণ করে। অথচ প্রাকৃতিকভাবেই ঘড়িয়ালের লম্বা ও পাতলা চোয়ালের কারণে এরা গবাদিপশু বা মানুষকে বাংলাদেশের অন্য দুই প্রজাতির কুমিরের মতো আক্রমণ করতে অক্ষম।
ইংরেজ অভিযাত্রী ও প্রকৃতিবিদদের লেখনী থেকে জানা যায়, অতীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘড়িয়ালের অভাব ছিল না। পাকিস্তানের সিন্ধু নদ, নেপালের গান্দাক নদী, ভারতের উত্তর প্রদেশের যমুনা নদী আর বিহারের কোসি নদীতে এ প্রাণী ছিল অসংখ্য। মার্কিন প্রাণিবিদ উইলিয়াম হরনাডে ১৮৮৫ সালে যমুনা নদীর তীর ধরে মাত্র দুই ঘণ্টায় ৬৪টি ঘড়িয়ালকে রোদ পোহাতে দেখেছিলেন। পশ্চিমে পাকিস্তানের সিন্ধু নদ থেকে পূর্বে ইরাবতী নদী পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার নদীজুড়ে, মোট ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত ছিল ঘড়িয়ালের বিচরণ। বর্তমানে ভারতে চম্বল, গিরওয়া ও সোন নদ-নদীতে তিনটে আলাদা উপদল আর নেপালে রাপ্তি-নারায়ণী নদীতে একটি উপদল রয়েছে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও ভুটানের প্রধান নদ-নদীগুলো মিলিয়ে ২০ শতকের শুরুতে পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার ঘড়িয়াল ছিল। এরপর দ্রুত এ সংখ্যা কমতে থাকে। ২০০৭ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, পৃথিবীতে ঘড়িয়ালের সংখ্যা ২০০-এর বেশি নয়। পাকিস্তান থেকে মিয়ানমারের এই সুদীর্ঘ এলাকায় আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপও পড়েছে। আর এখানে সর্বশেষ জরিপটি পরিচালনা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (আইইউসিএন) বাংলাদেশ, ২০১৫-১৬ সালে। পদ্মা ও যমুনা নদীর বাংলাদেশে প্রবেশমুখ, অর্থাৎ যথাক্রমে রাজশাহী ও কুড়িগ্রাম থেকে শুরু করে আরিচায় দুই নদীর সঙ্গমস্থল পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে জরিপ, মৎস্যজীবী আর নদীর সঙ্গে যারা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে দলীয় আলোচনা এবং পুরোনো নথি ঘেঁটে পাওয়া যায় ঘড়িয়াল সম্পর্কে প্রচুর তথ্য। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৯ সালে মোট ২৫টি ঘড়িয়াল দেখা গিয়েছিল পদ্মা, যমুনা আর তিস্তা নদী মিলিয়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে ৪০টি ঘড়িয়াল দেখা গেছে পদ্মা ও যমুনায়। আর ২০০০ থেকে ২০১৫ সালে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র আর মহানন্দা মিলিয়ে এই সংখ্যা ছিল ৫৮। এই বিশদ জরিপের সময়েই ঘড়িয়ালের ৩৭টি সম্ভাব্য প্রাপ্তিস্থান চিহ্নিত করা হয়, আর সেখান থেকে পদ্মায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বকর আলী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, গহমাভনা ও খিদিরপুর এবং যমুনায় বগুড়ার কাজলা এলাকাকে ঘড়িয়ালের হটস্পট বলে ধরে নেওয়া হয়।
এত কথা বলা হলো ঘড়িয়াল নিয়ে এবার আসল কথায় আসা যাক। বাংলাদেশে ঘড়িয়ালের কোনো বংশবৃদ্ধির চিহ্ন এখনো পাওয়া যায়নি। তাহলে যে ঘড়িয়ালগুলো জেলেদের জালে আটকা পড়ে, যেগুলো দেখা যায় পদ্মা আর যমুনার চরগুলোতে; সেগুলো আসে কোথা থেকে? এর উত্তর দিলেন আইইউসিএন, বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার এবং ঘড়িয়াল প্রকল্পের নেতৃত্ব দেওয়া কনজারভেশন বায়োলজিস্ট এ বি এম সারোয়ার আলম। এগুলো সবই আসে বর্ষাকালে বন্যার পানিতে ভেসে, চম্বল এলাকা থেকে। দেশে যেসব ঘড়িয়াল জেলেদের মাছ ধরার জালে আটকা পড়ার খবর আসে, বেশির ভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এমনকি দেশে মাদি প্রাপ্তবয়স্ক ঘড়িয়ালের দেখাও সেভাবে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে এই প্রাণীর বিলুপ্তির দিকে যাওয়ার প্রধানতম কারণ হলো মাছ ধরার গিল নেট বা কারেন্ট জালে তাদের আটকে যাওয়া। ঘড়িয়ালের লম্বা নাক ও চোয়াল বেশ সহজে জালের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, ফলে শ্বাস নেওয়ার জন্য আর ভেসে উঠতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে পানির নিচেই মৃত্যু ঘটে ওদের। নিষিদ্ধঘোষিত হলেও এ ধরনের জালের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে; আর তাতে অন্য অনেক মূল্যবান মাছ আর জলজ সম্পদের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঘড়িয়ালও। এর বাইরেও ধারণা করা হয়, প্রজনন মৌসুমে ঘড়িয়ালের বাসা ও ডিমের ওপর অন্য প্রাণী এবং মানুষের আক্রমণ এ প্রাণীর সংখ্যা কমার অন্যতম প্রত্যক্ষ কারণ। এ ছাড়া পরোক্ষ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে নদীভাঙন, নদীতীরবর্তী এলাকায় কৃষিকাজ ও গোচারণ, ইঞ্জিন বোটের সংখ্যাধিক্য, বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়া, বড় আকারে বালু উত্তোলন কার্যক্রম প্রভৃতি। এসবই ঘড়িয়ালের চলাচলে বা বংশবৃদ্ধিতে বিঘœ ঘটাচ্ছে, নয়তো মৃত্যুর কারণ হচ্ছে।
বাংলাদেশের নদী-প্রকৃতিতে যদি ঘড়িয়াল না-ই থাকে, তাহলে এ প্রাণী রক্ষা পাবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার চারটি ও গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের একটি পুরুষ ঘড়িয়াল; আর রাজশাহী চিড়িয়াখানার তিনটি ও রংপুর চিড়িয়াখানার চারটি মাদি ঘড়িয়াল।
ঘড়িয়ালের জন্য ১০ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা আর নীতিমালা প্রণয়ন করেছে আইইউসিএন। ঘড়িয়াল সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও পরিবেশ রক্ষায় এর গুরুত্ব বোঝাতে জনসচেতনতার উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ার সাহায্যে। পাশাপাশি বিভিন্ন চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের সংগ্রহে থাকা ঘড়িয়ালগুলো বিনিময় করে বদ্ধ অবস্থায় বংশবিস্তার করিয়ে, সেগুলোকে পরবর্তীকালে উন্মুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশে আবারও ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব এলাকা হটস্পট বলে চিহ্নিত, সেগুলোকে ঘড়িয়ালের জন্য নিরাপদ বা সংরক্ষিত ঘোষণা করে বাংলার নদীর ‘নিরীহ দানব’কে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আশার কথা, ইতিমধ্যেই বিনিময় কার্যক্রম আংশিকভাবে শুরু হয়েছে। সেদিন হয়তো আর দূরে নয়, যখন ‘মেছো কুমির’কে আবারও দেখা যাবে উত্তরবঙ্গের কোনো এক চরে রোদ পোহাতে। তখন উইলিয়াম হরনাডের মতোই হয়তো কোনো বাঙালি প্রকৃতিপাঠক দুই ঘণ্টায় ৬৪টি না হোক, ৬টি ঘড়িয়াল দেখে দিনলিপিতে তা লিখে রাখবেন কিংবা ক্যামেরার শাটার টিপে তা ধরে রাখবেন স্মৃতিতে।
ছবি: ইন্টারনেট