skip to Main Content

মনোযতন I ব্যাধির নাম দ্বিপ্রান্তিক

একই মানুষ। একেক সময় মন-মেজাজ একেক রকম। কখনো একটানা ফুরফুরে; কখনো আবার বিষণ্নতায় অন্ধকারে ধুঁকতে থাকা। তা-ও ভীষণ তীব্রভাবে

‘দ্বিপ্রান্তিক ব্যাধি’। কী সুন্দর নাম! অথচ এর ভেতরে নিহিত রয়েছে ভয়ানক বিপদের ইশারা। এর ইংরেজি নামটিই বেশি চেনা—‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’। এ এমনই এক মানসিক ব্যাধি, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি দিনের পর দিন কখনো তীব্র বিষণ্নতা, আবার কখনো ভীষণ উচ্ছ্বাস অনুভব করেন। তার মানে হরদম আবেগ পরিবর্তন ঘটে তার। আর সেই পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে আক্রান্ত মানুষটি খেই হারিয়ে ফেলেন। জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
বাংলাদেশে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কী হাল? জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, এ দেশে গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে এ রোগে ভুগছেন চারজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘মনের খবর’-এর সম্পাদক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব জানান, বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা মানে হলো একই মাথার দুই রকম আচরণ। এতে আক্রান্ত রোগী কখনো ম্যানিয়া এপিসোডে থাকেন। তখন হয়তো প্রচুর অবান্তর কথা বলেন, মাত্রাতিরিক্ত রঙিন পোশাক পরেন, নানাবিধ বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন। আবার একই মানুষ কখনো ভোগেন মারাত্মক ডিপ্রেশনে। তখন তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
ম্যানিয়া এপিসোড
বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে যখন সর্বোচ্চ শক্তিস্তরের দেখা মেলে, সেটিকে বলা হয় ম্যানিয়া। এ রকম মেজাজের সময়কালে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ ও ইতিবাচক মানসিকতার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এমনকি তার স্বতঃস্ফূর্ত কাজকর্মেও থাকে বাড়াবাড়ি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হয়তো তিনি ভীষণ উদ্দীপনা নিয়ে কেনাকাটা করতে থাকেন কিংবা উপহার দিতে থাকেন উদারভাবে।
ম্যানিয়া অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তি যে শুধু উচ্ছ্বাস বা ইতিবাচকতার প্রকাশ ঘটাবেন, তা নয়। কখনো কখনো তার মেজাজ ভীষণ রকমের খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। এমনকি হ্যালুসিনেশনেও আক্রান্ত হতে পারেন। এ সময়ে অবাস্তব কোনো কিছু দেখা কিংবা সেগুলোর ওপর বিশ্বাস জন্মাতে পারে তার মনে।
ডিপ্রেশন এপিসোড
সেই একই মানুষ আবার ডুবে যেতে পারেন চূড়ান্ত বিষণ্নতায়। জগতের কোনো কিছুর প্রতিই উৎসাহ বোধ না করা, সারাক্ষণ মনমরা হয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতারও দেখা মিলতে পারে তার লক্ষণে। বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনের দিনগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত কারও সঙ্গে মিশতে চান না। এমনকি প্রাত্যহিক কাজকর্মের প্রতি তীব্র অনীহা কাজ করতে পারে তার মধ্যে।
উত্তরণের উপায়
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব জানান, বাইপোলার ডিসঅর্ডার নিয়ে সমাজে কিছু ভ্রান্ত ধারণার প্রচলন রয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, প্রতারিত হওয়া, কোনো কারণে মারাত্মক মানসিক ধাক্কা খাওয়া প্রভৃতি কারণে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন রোগী। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সঠিক কারণ জানতে পারেনি। তবে জেনেটিকস, পরিবেশ, মস্তিষ্কের গঠন ও রসায়ন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে বলে আশঙ্কা করা হয়।
গবেষণায় জানা গেছে, যাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন এ রোগে আক্রান্ত, তাদেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার বেশ ঝুঁকি থাকে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সবাই যে এতে আক্রান্ত হবেন, সেই আশঙ্কা কম। অন্যদিকে, মানসিক চাপ ও ট্রমার মতো পরিবেশগত কারণেও এ রোগ বাসা বাঁধতে পারে আপনার মনোজগতে।
অধ্যাপক বিপ্লব আরও জানান, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন ম্যানিয়া পর্যায়ে থাকেন, তখন তাকে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন করা গেলে সেটির চিকিৎসা সম্ভব। আবার, ডিপ্রেশন পর্যায়ে থাকলেও একই কথা প্রযোজ্য। নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে ম্যানিয়া কিংবা ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পেতে পারেন আক্রান্ত ব্যক্তি। এমনকি যথেষ্ট সুস্থ হয়েও উঠতে পারেন। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বাইপোলার ডিসঅর্ডার যে তার জীবনে ফিরে আসবে না, সেই নিশ্চয়তা দেওয়া অসম্ভব। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়মিতই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের চেকআপে রাখা উচিত। তার পর্যাপ্ত সাইকো-এডুকেশন দরকার।
এ রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে:
 বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে কোনো শারীরিক উপসর্গ না থাকায় এবং ভিন্ন ব্যক্তির মেজাজ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হওয়ায় রোগ নির্ণয় বেশ কঠিন। তবে মনোরোগ চিকিৎসক সাধারণ বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে রোগীর মেজাজ-সম্পর্কিত তথ্য প্রাত্যহিক ভিত্তিতে লিখে রাখা গেলে বেশ কাজে দেয়।
 মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের উপসর্গ সম্পর্কে বোঝা সম্ভব।
 এ রোগের চিকিৎসায় সাধারণত মেজাজ পরিমার্জনা করার জন্য ওষুধ, থেরাপি, লাইফস্টাইলে সংশোধনীর মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
 ডিপ্রেশন দূর করার ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
 থেরাপির অংশ হিসেবে ঘুমানো, খাওয়া, বিশ্রামের মতো প্রাত্যহিক কাজকর্মে ডিসিপ্লিন আনার চেষ্টা চালানো হয়।
 আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন মানসিক থেরাপিও দেওয়া হয়ে থাকে।
কোনো মানসিক রোগই হেলাফেলার বিষয় নয়। বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বিপ্রান্তিক ব্যাধি তো নয়ই। তাই নিজের কিংবা পরিচিত কারও এ রোগের কোনো ধরনের লক্ষণের দেখা পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

 লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top