এডিটর’স কলাম I নিঃশর্ত আশ্রয়
জীবনের সকল ঝড়-বৃষ্টি-রোদের দুঃশাসন থেকে সুরক্ষা দিয়ে যান আমাদের, একেবারেই নিঃশর্তে
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রকৃতির এক হেঁয়ালি সময় এখন। বরাবরের মতোই। গ্রীষ্মের বিদায় আর বর্ষার আগমনী লগ্ন। কখনো কাঠফাটা রোদের শাসন, কখনো মুষলধারে বৃষ্টির রিনিঝিনি। দুই বিপরীত ঋতুর এমন সন্ধিক্ষণে, দুটিরই তীব্রতা থেকে একটি অনুষঙ্গ আপনাকে-আমাকে দিতে পারে সুরক্ষা। বহুকাল দিয়েও এসেছে। ছাতা। খুবই মামুলি এই জিনিস, তবু এক দারুণ আশ্রয় আমাদের। রোদে পোড়া আর বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া থেকে নিরাপদ রাখার।
দুই
কে কখন কীভাবে ছাতা আবিষ্কার করেছিলেন, সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নেই। তবে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ছাতা আবিষ্কারের অন্তত চারটি সাক্ষ্য পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ থেকে ২৪০০ অব্দের দিকে রাজা ও দেবতাদের ছায়া দেওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের চারকোনা সমতল ছাতার ব্যবহার ছিল—এমন সাক্ষ্য মেলে মিসরের প্রাচীন চিত্রলিপি ও সমাধি-মন্দিরে আঁকা ছবিগুলোতে। অন্যদিকে, প্রাচীন যুগের চীনা গ্রন্থ ‘দ্য রাইটস অব জো’তে উল্লেখ রয়েছে গোলাকার সিল্কের ছাতার। শোভাযাত্রার রথে ছায়া দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত ওই সব ছাতার প্রচলন খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দেও ছিল। তা ছাড়া প্রত্ন তাত্ত্বিক গবেষকেরা নিরলস গবেষণার মাধ্যমে মাটি খুঁড়ে ছাতাওয়ালা বেশ কিছু তামার মূর্তি আবিষ্কার করেছেন। জানা যায়, একসময় অসংখ্য ছাতার ছবি আঁকা থাকত চীনা রাজদরবারগুলোতে। বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো লিখে গেছেন, ১২৭৫ সালে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খানের দরবারে গিয়ে সেনাপতির মাথার ওপর সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছিলেন তিনি। মূলত চীন থেকেই জাপান ও কোরিয়ায় রাজছত্রের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিমত ইতিহাসবিদদের।
আফ্রিকায়ও প্রাচীনকাল থেকেই ছাতার প্রচলনের হদিস মেলে। দ্বাদশ শতাব্দীতে আঁকা ইথিওপিয়ার বিভিন্ন ছবি ও প্রাচীন গ্রন্থে রয়েছে রাজছত্র ব্যবহারের সাক্ষ্য। অন্যদিকে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে লেখা বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষে রাজছত্রের ইতিহাসও বেশ পুরোনো।
ইতিহাসের আক্ষরিক পাঠ থেকে বরং চিরকালীন রূপকাত্মক পাঠে ফেরা যাক! আমাদের জীবনেও বিশেষ কিছু মানুষ ছাতা হয়ে থাকেন। জীবনের সকল ঝড়-বৃষ্টি-রোদের দুঃশাসন থেকে সুরক্ষা দিয়ে যান আমাদের, একেবারেই নিঃশর্তে। এমনই দুই মানুষ মূলত—বাবা ও মা।
তিন
বিশ্বনন্দিত রাশিয়ান চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি তার ডায়েরির একপর্যায়ে লিখেছিলেন, ‘গত সপ্তাহে আমার মা মারা গেছেন। জীবনে তার মতো এত ভালো আমাকে আর বাসবে না কেউ।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘মা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মায়ের মত আহা/ একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,/ মায়ের মতন এত আদর সোহাগ সেতো/ আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।/ হেরিলে মায়ের মুখ/ দূরে যায় সব দুখ/ মায়ের কোলেতে শুয়ে জোরায় পরান/ মায়ের শীতল কোলে/ সকল যাতনা ভুলে/ কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।’
আবার, জনপ্রিয় রকস্টার জেমসের গানে ঝরে পড়তে দেখি পিতৃবিয়োগের বেদনার্ত হাহাকার: ‘এ তো রক্তের সাথে রক্তের টান/ স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে,/ হঠাৎ অজানা ঝড়ে তোমায় হারালাম/ মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো:/ বাবা কতদিন কতদিন দেখি না তোমায়,/ কেউ বলে না তোমার মতো/ কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়…।’
বলা হয়ে থাকে, মা-বাবা মানবজীবনের এমনই অতুলনীয় সম্পদ, যারা থাকাকালে আমরা অনেকেই তাদের মর্যাদা ঠিকমতো বুঝতে পারি না। কিংবা বুঝতে পারলেও অনভ্যস্ততার কারণে তাদের প্রতি প্রকাশ করতে পারি না যথার্থ ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা। তাদের রাখতে পারি না যথাযোগ্য মর্যাদায়। অথচ যাদের বাবা কিংবা মা, অথবা উভয়েই বেঁচে নেই—তারা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেন এই দুই মানুষের অভাব। তখন আর কিছুই করার থাকে না, আফসোস ছাড়া। তাই মা-বাবা দুজনেই, কিংবা তাদের মধ্যে অন্তত একজন বেঁচে আছেন—এমন সৌভাগ্যবান সন্তান যারা, তাদের উচিত বাবা-মাকে সযতনে, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও মমতা দিয়ে আগলে রাখা; ঠিক যেভাবে আগলে রেখে তারা বড় করে তুলেছেন আমাদের।
চার
কিছুদিন আগেই, মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ছিল বিশ্ব মা দিবস। অন্যদিকে, এ মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস। আবারও ইতিহাসের দরজায় কড়া নেড়ে জানা যায়, মানব সম্প্রদায়ে মায়ের প্রতি ভক্তির প্রথা আদিকাল থেকেই রয়েছে। তবে বছরের বিশেষ একটি দিনে তা উদযাপনের প্রচলন ঘটে প্রাচীন গ্রিসে। বিশিষ্ট গ্রিক দেবী সিবেলের উদ্দেশে উদযাপন করা হতো এই উৎসব। অন্যদিকে প্রাচীন এশিয়ার কিছু জায়গায় এবং পরবর্তীকালে রোমে তা উদযাপিত হতো ‘আইডিস অব মার্চ’ নামে।
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে মাকে ঘিরে বিশেষ দিবস উদযাপনের রেওয়াজ থাকলেও আধুনিক মা দিবসের আবির্ভাব বেশি পুরোনো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরে ‘মাদার ডে’ উদযাপনের মাধ্যমে এর সূচনা ১৯০৭ সালের ১২ মে। স্থানীয় শান্তিবাদী সমাজকর্মী অ্যানের একটি উদ্যোগের সূত্র ধরে। ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করতে। একদিন নিজের ছোট কন্যা অ্যানার সঙ্গে হাতজোড় করে বলেছিলেন, ‘প্রার্থনা করি, কেউ না কেউ একদিন কোনো মায়ের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুন। কারণ, তারা মনুষ্যত্বের জন্য প্রতিদিন নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন।’ অ্যানের মৃত্যুর পর অ্যানা নিজ মায়ের মৃত্যুদিবস স্মরণীয় করে রাখতে মা দিবসের প্রবর্তন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ঘোষণা করেন ‘মা দিবস’ হিসেবে, ১৯১৪ সালে। সেই থেকে শুরু। এখন বিশ্বের অনেক দেশে দিনটি ‘মা দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়।
অন্যদিকে, বাবা দিবসের আদি প্রচলন মধ্যযুগে, ইউরোপে। ওই মহাদেশের ক্যাথলিক দেশগুলোতে মার্চের ১৯ তারিখ এটি ‘সেন্ট যোসেফ’ নামে পালিত হতো। আমেরিকায় পালিত হতো জুনের তৃতীয় রোববার। ধর্মীয় বৃত্ত থেকে একে আধুনিক ও সর্বজনীন করে তোলার পেছনে জোরালো ভূমিকা রাখেন আমেরিকান নারী গ্রেস গোল্ডেন ক্লেটন। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে ভার্জিনিয়ার মোনোংয়াতে খনি বিস্ফোরণে তিন শতাধিক পুরুষ প্রাণ হারান। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সন্তানের বাবা। তাই ওই দুর্ঘটনা সহস্রাধিক সন্তানকে এক মুহূর্তে পিতৃহারা করে দেয়। নিহতদের স্মরণে স্থানীয় মেথোডিস্ট গির্জার যাজককে ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই রোববার বাবা দিবস হিসেবে উৎসর্গ করার অনুরোধ জানান ক্লেটন। সেদিন ছিল তার প্রয়াত পিতার জন্মদিন। এরপর বাবা দিবসের প্রচলন বেশ দারুণভাবে ঘটে যায়। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুনের তৃতীয় রোববারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাবা দিবস ঘোষণা করেন। সেই রেওয়াজ এখন ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে।
পাঁচ
শুধু বিশেষ দিবস নয়, জীবনের প্রতিটি দিনই বাবা-মাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সম্মান জানানো উচিত আমাদের। এমন অমূল্য রত্ন হেলায় হারানো কাম্য নয়। আজীবন সন্তানের মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকা পৃথিবীর সকল বাবা-মা ভালো থাকুন, যত্নে থাকুন—সেটি নিশ্চিত করা প্রত্যেক সন্তানের একান্ত দায়িত্ব।
পৃথিবীর সব মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা; সন্তানদের প্রতি রইল শুভকামনা।