মনোযতন I আহার বালাই
ইটিং ডিজঅর্ডার। হয় খুব বেশি খাওয়ার ঝোঁক, নয়তো একেবারেই না খাওয়ার। শুনতে নির্দোষ মনে হলেও এর প্রভাব মারাত্মক। লিখেছেন আশিক মুস্তাফা
ভালো কিংবা প্রিয় খাবারের লোভ কজনই-বা সামলাতে পারে! ধরুন, ডিনারের নিমন্ত্রণ পেলেন নামী কোনো রেস্তোরাঁর বুফেতে। সামনে সাজানো প্রিয় খাবার কিংবা কেবলই প্রিয় ফ্লেভারের আইসক্রিম। আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন! আশপাশে কে আছে, কে কী খাচ্ছে আর আপনারই-বা কতটুকু খাওয়া উচিত—সাত-পাঁচ না ভেবে ঘড়ির কাঁটার মতো মুখ চালিয়ে যান টি-ক—ট-ক, টি-ক—ট-ক! বলি, খাবার গ্রহণে কোথায় থামা প্রয়োজন, তা যদি আপনি বুঝতে না পারেন, আর তা কেবল একবার-দুবারই নয়, বারবার হতে থাকে, তখন বুঝতে হবে, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। মানে, আপনি হয়তো ইটিং ডিজঅর্ডারের শিকার!
আবার একই মুদ্রার উল্টো পিঠও দেখা যায়। আরেক ধরনের লোক আছেন, যারা একদম খেতেই চান না। খেলে ওজন বেড়ে যাবে, তারা যে ওজন কমাতে মরিয়া! দুনিয়াজুড়ে প্রায় ৯ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন। এ ক্ষেত্রে ৬ শতাংশের মতো মানুষের ওজন থাকে প্রয়োজনের তুলনায় কম। তার মানে, বেশি খাওয়া এবং একেবারে কম খাওয়া—দুটোই ইটিং ডিজঅর্ডারের লক্ষণ।
ডাক দিয়ে যান ডায়ানা
চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, ইটিং ডিজঅর্ডার তিন ধরনের—অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়া নার্ভোসা ও বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার। এই সেদিনও ইটিং ডিজঅর্ডার আমাদের কাছে ছিল অচেনা! মানে, আমরা বলতাম, এটা পশ্চিমা রোগ। শোনা যায়, প্রিন্সেস ডায়ানাও এই রোগ পুষতেন নিজের মনোজগতে। সে যাক, সময় পাল্টেছে। এখন আমাদের দেশেও ইটিং ডিজঅর্ডারে ভুগছেন অনেকে। হয়তো আপনার খাবার টেবিলেও হানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এই একচোখা দানব! চলুন, তার আগে ইটিং ডিজঅর্ডারের তিন ধরনের চরিত্র জেনে নিই।
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা
অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসায় আক্রান্তরা হুটহাট রুটিন পাল্টে খাওয়া কমিয়ে দেন। তারা ভাবেন, অতিরিক্ত খেয়ে লাভ নেই। তাই খুবই কম খেয়ে থাকেন। যেকোনো ওজনের মানুষের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। ওজন যতই থাকুক, এরা অতি দ্রুত তা কমাতে চান।
বুলিমিয়া নার্ভোসা
শুরুতে যাদের কথা বলছিলাম, এরা সেই গোত্রেরই নাগরিক! মানে, এরা খেতে ভালোবাসেন খুব। কথায় কথায় রাজ্যের খাবার টেনে পেটে পুরে ক্যালরির ডিপো খুলে বসেন! বুলিমিয়া নার্ভোসায় আক্রান্তরা আরেকটা কাজও করেন, তা হচ্ছে, অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের পর বমি করে দেন! কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত খাবার খেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এক্সারসাইজ করতে বেরিয়ে পড়েন।
বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার
এই শ্রেণির লোক আরেক কাঠি সরেস! খাবারের ওপর থেকে এদের সব নিয়ন্ত্রণ উঠে যায়। ফলে একবার খাওয়ার পর, দ্রুত আরেকবার খেয়ে নেন। মাত্রাতিরিক্ত খাবার গ্রহণের পর শামুকের মতো যেন শরীরটা টেনে টেনে চলেন! তবে অতিরিক্ত খাবারের পর তাদের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে।
কীর্তি-কারণ
কিছু পারিপার্শ্বিক কারণ জড়িত থাকলেও ঠিক কী কারণে ইটিং ডিজঅর্ডার হয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানে তা এখনো অজানা। তবে বিশেষজ্ঞরা বংশগত কারণসহ বেশ কিছু কারণ বের করে এনেছেন। বিশেষজ্ঞ মতে—
জিনগত সমস্যা: জিনগত কারণে অনেকের এই সমস্যা হতে পারে। নিকটাত্মীয়, বিশেষ করে বাবা-মা, ভাইবোনের মাঝে যদি এই সমস্যা থাকে, তবে আপনারও আক্রান্ত হবার ঝুঁকি রয়ে যাবে।
মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা: দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখা হয় মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাকে। এরা সাধারণত কম আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হওয়া, তীব্র আবেগপ্রবণ আচরণ করা, ত্রুটিপূর্ণ সম্পর্ক, দেহের আকার-আকৃতি ও অতিরিক্ত ওজন নিয়ে বিদ্রূপের সম্মুখীন।
সমাজব্যবস্থা: জনপ্রিয় সমাজব্যবস্থায় সাফল্য ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় জিরো ফিগারের জয়জয়কার। কর্মক্ষেত্রের ঊর্ধ্বতনদের চাপে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে অনেকেই ক্ষীণকায় হবার আশায় এতে আক্রান্ত হন।
পরিস্থিতির দেয়াল: স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির চাপ সামলাতে গিয়েও অনেকে এর মুখোমুখি হতে পারেন।
ঝুঁকির ঝক্কি
সাধারণত কিশোর-কিশোরী এবং কম বয়সী নারী-পুরুষ ইটিং ডিজঅর্ডারের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরাও এই রেডলাইটের ছায়ায় ঘোরাফেরা করেন। খেলাধুলা, কাজ এবং শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে মগ্ন অ্যাথলেট, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী ও মডেলরা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। ওজন কমানোর ব্যাপারে কোচ ও অভিভাবকদের অজ্ঞাত উৎসাহদানের ফলে অ্যাথলেটরা ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হন।
লক্ষণ দেখে যায় চেনা
আপনার একান্ত কাছের কেউ কিংবা আপনি নিজেই ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত কি না, তা পরখ করে নিতে পারেন যেসব লক্ষণ দেখে—
কোনো অজুহাত তৈরি করে খাবার বাদ দেওয়া বা না খাওয়া;
মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত নিরামিষভোজী হয়ে যাওয়া;
স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে অতিরিক্ত নজর দেওয়া;
পরিবারের সবার সঙ্গে একই খাবার না খেয়ে নিজের জন্য আলাদা খাবার তৈরি করে খাওয়া;
স্বাভাবিক সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে যাওয়া;
বেশির ভাগ সময় নিজের বেশি ওজন নিয়ে অভিযোগ করা এবং কীভাবে ওজন কমানো যায়, সেই বিষয়েই সারাক্ষণ কথা বলা;
বারবার আয়না দেখা এবং নিজের ওজনসম্পর্কিত শারীরিক ত্রুটি খুঁজতে থাকা;
অতিরিক্ত ব্যায়াম করা;
বারবার মিষ্টি বা উচ্চ চর্বিজাতীয় খাবার অধিক পরিমাণে খাওয়া;
ওজন কমানোর জন্য ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট, ল্যাকজেটিভ বা ভেষজ ঔষধ খাওয়া;
মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ইচ্ছাকৃত বমি করা;
অতিরিক্ত বমির ফলে দাঁতের এনামেল ক্ষয় হয়ে যাওয়া;
খাওয়ার মাঝে উঠে টয়লেটে যাওয়া;
সকালের নাশতা বা যেকোনো বেলায় খাওয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া;
খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বিষণ্নতা, বিতৃষ্ণা, লজ্জা বা অপরাধবোধ প্রকাশ করা;
জনবহুল জায়গায় বিশেষ করে রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে অস্বস্তিবোধ করা বা খেতে না চাওয়া।
এসব লক্ষণের সিংহভাগ কারও মাঝে আঁচ করতে পারলে অবশ্যই তাকে ডাক্তারের সামনে বসান। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
সমাধানের খোঁজে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘ইটিং ডিজঅর্ডারের চিকিৎসায় ওষুধ ও কাউন্সেলিং—দুই-ই কার্যকর। রোগের মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। মাত্রা যত বাড়বে, আনুষঙ্গিক উপসর্গগুলোও তত বেশি হবে। স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে। শারীরিক নানা অসুবিধাও শুরু হতে পারে। এই রোগের মূল থেরাপি হলো কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি। অর্থাৎ রোগীর চিন্তাভাবনাগুলো পরিবর্তন করা। যেমন রোগীর মনে হচ্ছে, ওই খাবার খেলে তিনি আরাম বোধ করছেন, আবার পরক্ষণেই অপরাধবোধে ভুগছেন বেশি খাওয়ার জন্য। এই চক্রটাকে ভেঙে দেওয়া থেরাপির একটা অংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই রোগ নিরাময়যোগ্য। তবে এর জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে ভালো হওয়ার ইচ্ছে দৃঢ়ভাবে পোষণ করতে হবে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের ভূমিকাও এখানে ব্যাপক। এই রোগের চিকিৎসায় সাধারণত শারীরিক সমস্যা সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থাও মনিটর করা হয়। তাই সমাধান পেতে হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করার বই, স্বাস্থ্য পরিচর্যাকারী ও থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে হবে। রোগীর অবস্থার গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে সম্পর্কভিত্তিক বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়—এমন থেরাপি নিতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার জন্য ডায়েট কাউন্সেলিং করতে হবে। ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ কীভাবে তাদের নিজেদের ও পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলে, তা আলোচনা করার পারিবারিক থেরাপিও নিতে হবে।’
‘ইটিং ডিজঅর্ডার রোগটি নিরাময়যোগ্য; তবে এটা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। কারণ, যত দ্রুত শনাক্ত করা যাবে, আক্রান্ত ব্যক্তির তত দ্রুত সেরে ওঠার সম্ভাবনা বাড়বে। তাই যখনই কোনো ব্যক্তির মাঝে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়, দেরি না করে প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে,’ যোগ করেন ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু।
দোলাচলে দোল
সাধারণত ইটিং ডিজঅর্ডারে আক্রান্তরা স্বীকার করতে চান না, তারা কোনো সমস্যাক্রান্ত কিংবা তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা না নিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, পরিবার কিংবা বন্ধুদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সঠিক সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তির অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং আচরণ শনাক্ত করার মাধ্যমেই খাবার টেবিলের এমন একচোখা দানবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর এই মুক্তি কেনই-বা চাইবেন না আপনি?
ছবি: ইন্টারনেট