টেকসহি I বেঁচে থাক বাঘ
বাংলার বাঘ। পৃথিবীর বুকে বাঙালির গর্ব করার মতো ব্যাপার। কিন্তু ওরা ভালো নেই। একটা সময়ে দেশজুড়ে রাজত্ব করা বাঘ এখন কোণঠাসা হয়ে গেছে কেবল সুন্দরবনের এক কোণে। অথচ গত শতকের পাঁচের দশকেও মধুপুর, সিলেট, উত্তরের শালবনে, দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ে এদের দেখা মিলত। ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। দিবস-মোড়া আয়োজনে আসলেই কেমন আছে বাংলার বাঘেরা? লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
বাঘের কথা তুললেই মনে আসে কিছু রথী-মহারথীর নাম—জিম করবেট, কেনেথ অ্যান্ডারসন, পচাব্দী গাজী, আর্জান সর্দার। অবশ্য আমার আরও দুটো নাম মনে আসে—প্রথমটা সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি আর দ্বিতীয়টা সারোজ রাজ চৌধুরী। প্রথম তালিকার সবাই বিখ্যাত শিকারি, তবে প্রথম দুজন জাতে ইংরেজ-ভারতীয়, তবে বিনা কারণে বাঘ শিকার করতেন না। আর শেষের দুজনের একজন মোগল রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে তিনি ভাওয়ালের জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে গিয়ে আহত হয়ে ফিরে আসেন; আর দ্বিতীয়জন উড়িষ্যার সিমলিপালের বন বিভাগের কর্মকর্তা, যিনি বনের বাঘিনীকে পোষ মানিয়ে নিজে মেয়ের মতো করে আদর দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমলেও বাঘ শিকারকে উঁচু মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ১৮৭১ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফ্রাঙ্ক শেফিল্ড, এক ব্রিটিশ সাহেব বাঘ শিকারের ঘটনা নিয়ে লিখে ফেলেন একখানা আস্ত বই—‘হাউ আই কিল্ড দ্য টাইগার: বিয়িং অ্যান অ্যাকাউন্ট অব মাই এনকাউন্টার উইথ আ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’। এরপরই অবশ্য আরেকখানা বই পাই ‘থার্টিন ইয়ারস অ্যামং দ্য ওয়াইল্ড বিস্টস অব ইন্ডিয়া’—মাইসোর বা মহীশুরের সরকারি হাতি খেদা দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক জিপি স্যান্ডারসনের লেখা। তিনি ১৮৭৬ সালের মে মাসে ঢাকার বাঘ শিকারের বর্ণনা দিয়েছেন সেখানে। পাশাপাশি গারো পাহাড়, আসাম-সিলেট আর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার বাঘেরও কথা বলেছেন। এই শিকার প্রথা, শিকারিকে পুরস্কৃত করার প্রথা পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বহাল ছিল, এমনকি পচাব্দী গাজীকে তো পাকিস্তানের বেসামরিক খেতাব সনদ-ই-খিদমাতও দেওয়া হয়েছিল।
এই নির্বিচার বাঘ শিকার, বন আবাদ আ বন ধ্বংস করার ব্রিটিশ নীতি বাংলার বাঘকে একেবারে বিলুপ্তির দ্বারে নিয়ে এসেছে। আবার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, এই ব্রিটিশরাই প্রথম বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গত ২২ বছরে সুন্দরবন থেকে বাঘের মৃত্যুর খবর এসেছে অন্তত ৪০টি। বন বিভাগের থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জান যায়, চোরা শিকারির হাতে, লোকালয়ে এসে জনরোষে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে, নানা ধরনের অসুখ আর বার্ধক্যের কারণে মৃত্যু হচ্ছে বাঘের। গত এপ্রিলে সংসদে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানান, ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে ২০১৫ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ১০৬টি, ২০১৮ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১১৪টিতে। এ ছাড়া সুন্দরবনে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার বানর, ১৬৫ থেকে ২০০টি কুমির আর এক লাখ থেকে দেড় লাখ হরিণ রয়েছে। ২০২২ সালের শুমারিতে বাঘের পাশাপাশি গণনা করা হবে হরিণ ও শূকরের সংখ্যাও। তবে স্থানীয় খবরে জানা গেছে, সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে শিকারও। সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, জঙ্গলের ভেতরে শিকারের মাত্রা কমে আসবে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেখানে এখন সুন্দরবনের সীমানার গ্রামের লোকেরাই বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করছে। আবার করোনার প্রকোপে প্রায় দুই বছর সুন্দরবন পর্যটক ও বনজীবী মানুষের কোলাহল থেকে মুক্ত ছিল। এ সময়ে নিরুপদ্রব পরিবেশে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ ও অন্যান্য প্রাণী যে বেশ ভালোই ছিল, তার প্রমাণ মেলে হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি আর ঘন ঘন বাঘ দেখা দেওয়ায়। আবার এ কারণেই বাঘ-মানুষে সংঘাতের ঘটনাও আগের তুলনায় বেশি ঘটছে। খুলনার প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, ‘সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে এতটা ছিল না। সুন্দরবনের জন্য এটা অবশ্যই ভালো খবর। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখছেন পর্যটকেরা। সুন্দরবন আগের তুলায় এখন অনেক ভালো আছে, এটা সে কথাই বলে।’
তবে উল্টো প্রশ্ন তুলেছেন বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. আলী রেজা, ‘বাঘ রক্ষায় বন বিভাগ এখনো প্রস্তুত নয়। আলাদা করে একটা ওয়াইল্ডলাইফ বিভাগের কথা বহুদিন ধরেই বলে আসছি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালে আটটি বাঘ বেড়েছে বললেও, এটা আসলে সবাইকে ভ্রান্ত ধারণা দেয়; ২০১৮ সালের জরিপে শুমারি এলাকার জায়গা বেশি ছিল।’ ২০০৪ সালে পাগমার্ক বা পায়ের ছাপ গুনে বলা হয়েছিল সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এক যুগে আমাদের বাঘের সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল দ্বিগুণ। নতুন করে বলা হচ্ছে, ২০২৭ সালের ভেতরে দ্বিগুণ হবে এ সংখ্যা। সেটা দূরে থাক, সুন্দরবনে টিকে থাকা বাঘগুলো আদৌ শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলতে হবে। সরকারের উচিত, বাইরের সহায়তার দিকে না তাকিয়ে নিজ উদ্যোগে বাঘের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া।’ বন্য প্রাণিবিষয়ক সংস্থা ওয়াইল্ডটিমের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে বাংলাদেশকে বন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। প্রথমত চোরা শিকার বন্ধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাঘের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি চোরা শিকারিদের বাঘ হত্যা ও পাচার। বাংলাদেশে এখনো সেটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিশ্বব্যাপী বন্য পশুপাখির চোরাচালান নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা প্রতিষ্ঠান ট্র্যাফিকের মতে, সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের অবাধ বিচরণ বাঘের হুমকির কারণ। ২০১২ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হলেও এর সফল প্রয়োগ হয়নি এখনো। এই আইনে বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন আর সর্বোচ্চ সাত ও সর্বনিম্ন দুই বছর মেয়াদে কারাভোগ এবং ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরও প্রতিবছর একাধিক বাঘ শিকারির হদিস পাওয়া যায়। কিন্তু বাঘ শিকার ও পাচারের প্রকৃত সংখ্যা তারও কয়েক গুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ কারণে সুন্দরবনে কঠোর নজরদারিসহ স্মার্ট প্যাট্রলিংয়ের কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেছেন, সুন্দরবনের অপরাধপ্রবণ এবং চোরাকারবারিদের রুট হিসেবে ব্যবহৃত এলাকাগুলোয় নিরাপত্তা জোরদার করে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। বাঘ শিকার, ফাঁদ বা বিষটোপ ফেলা এবং ডাকাতের উপদ্রব বন্ধ করতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পুরো সুন্দরবনে নিয়মিতভাবে যৌথ অভিযান পরিচালনা করতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল হাসান খান।
প্রতিবছর বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও শাবক পাচার হয়ে থাকে। সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের প্রধান লক্ষ্য বাঘ বা বাঘের শাবক ধরে বিভিন্ন দেশে পাচার করা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব বাঘ মেরে ওদের শরীরের চামড়া, হাড়সহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কালোবাজারে বিক্রি করা হয়। বাঘের চামড়া ও দাঁত অনেকে ঘর সাজাতে ব্যবহার করেন; আবার বিভিন্ন দেশে (বিশেষত চীনে) ওষুধ হিসেবে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহৃত হয়। যদিও বিশ্বের কোথাও বাঘের অঙ্গ দিয়ে ওষুধ বানানোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিংবা আইনগত বৈধতা নেই বলে জানিয়েছেন এ বিষয়ে গবেষণা করে ফিউচার ফর নেচার পুরস্কার পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ড. সামিয়া সাইফ। তিনি তার গবেষণায় সুন্দরবনের বাঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে তৈরি লোকজ ওষুধ তৈরি এবং এর কারণে বাঘ হত্যার সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশে বাঘের চামড়া, হাড় ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে তৈরি পণ্য আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও চোরা পথে এসব পাচার এবং কালোবাজারে কেনাবেচা হয়। চোরা শিকার বন্ধ করতে পারলে বাঘের সংখ্যা এমনিতেই বেড়ে যাবে।’
বাঘ বাড়াতে যেমন বন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, একইভাবে বন রক্ষা করতেও বাঘের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, শিকারি প্রাণী বাঘ বনের সার্বক্ষণিক পাহারাদারের কাজ করে। যেখানে বাঘ আছে, সেখানে মানুষের আনাগোনা কম হয়। পাশাপাশি বাঘের খাবার, হরিণ ও অন্যান্য প্রাণীও রক্ষা করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামের মানুষেরা, বনদস্যুরা মিলে প্রতিবছর ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার ৩০০টি হরিণ হত্যা করে। প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল হাসান খান জানান, প্রতিটি বাঘের জন্য বনে অন্তত ৫০০টি প্রাণী থাকতে হবে, যেন বাঘ সেগুলো শিকার করতে পারে। সে হিসাবে বাঘের সংখ্যা ২০০ করতে হলে বনে অন্তত ১ লাখ প্রাণী থাকা প্রয়োজন। সুন্দরবনে বাঘের খাবারের তালিকায় রয়েছে হরিণ, শূকর, বানর, বুনো মোষ ইত্যাদি। বনের হরিণ শিকারের খবর প্রায়ই মূলধারার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায়ও দেখা যাচ্ছে। অথচ বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে এসব প্রাণীর সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাঘের খাবার কমে গেলে মহাবিপন্ন প্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে জলদিই হারিয়ে যাবে। নজরদারি ও টহল জোরদার করে এসব প্রাণীর পাচার রোধ করা সম্ভব।
এ ছাড়া চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন সঠিক ও দ্রুত কার্যকর করার ব্যবস্থা নিয়ে নজির সৃষ্টি করা জরুরি বলে মনে করেন ড. সামিয়া সাইফ। সুন্দরবন ও তার আশপাশে যত্রতত্র নৌ চলাচল ও শব্দদূষণ বন্ধ করতে হবে। বাঘের সংখ্যা বাড়াতে হলে এই প্রাণী যেন তার স্বাভাবিক পরিবেশে থাকতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দূষণ এবং নদীনালা দিয়ে লাগামহীনভাবে নৌযান চলাচল। সার, তেল ও অন্যান্য মালবাহী জাহাজ চলাচলের শব্দ যেমন আছে, তেমনি যেকোনো দুর্ঘটনায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। যেমনটা হয়েছিল ২০১৫ সালে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে গিয়ে। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কমিয়ে বিকল্প পথে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, সুন্দরবনের একটি নির্দিষ্ট অংশজুড়ে জাহাজ বা ছোট-বড় নৌযান চলাচল সীমিত করে আনতে হবে। যেসব নৌযান চলবে, সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে চালানোর পাশাপাশি শব্দ এবং আলো নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে হবে যেন রাতের বেলা বাঘ নদীগুলো দিয়ে নির্বিঘ্নে চলতে পারে। অবশ্য, জাহাজ চলাচল কমার সম্ভাবনা অচিরে নেই। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও অন্যান্য শিল্পকারখানা সেখানে গড়ে ওঠায় সংরক্ষিত এলাকা দিয়েও জাহাজ চলে, যা শুধু বাঘের নয়, সুন্দরবনের পানিতে বাস করা লোনাপানির কুমির, হাঙর, আর কয়েক প্রজাতির ডলফিনের পাশাপাশি মাছেরও সমস্যা করছে। আবার বনাঞ্চল ধ্বংস করে ভারী শিল্প অবকাঠামো, কলকারখানা, জনবসতি, হাটবাজার, বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাছের ঘের, রাস্তাঘাট গড়ে তোলার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে বাঘের আবাসস্থল ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে বলেও তারা মনে করছেন। এই অবস্থায় সুন্দরবনের পাশে যেকোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা যেন গড়ে উঠতে না পারে, সে বিষয়ে নজর দেওয়া চাই। অপরিকল্পিত পর্যটনেরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাঘের ওপর। তাই সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ বছরের শুরুর দিকের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, প্রায় দুই বছর পর্যটন বন্ধ থাকায় সুন্দরবনে বাঘ দেখার সংখ্যা আগের থেকে বেড়েছে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন মানুষের বসতি ক্রমেই বনের কাছাকাছি চলে আসায় বন ও লোকালয়ের মাঝের খাল-নদী ভরাট হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে বনের বাঘ খাবারের সন্ধানে ঘন ঘন ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। তাতে বাঘে-মানুষে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়রা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি তারা বাঘকে পিটিয়ে আহত কিংবা হত্যা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের কাছাকাছি যদি মানুষের বসবাস থাকে, তাহলে ওই লোকালয় সুন্দরবন থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে হবে। সুন্দরবন ও লোকালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মানুষ ও বাঘকে আলাদা রাখতে হবে, যেমনটা ভারতীয় সুন্দরবনে করা হয়েছে। লোকালয়ে আসা বাঘ যেন নিরাপদে বনে ফিরতে পারে, সে বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে ওয়াইল্ডটিমের ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম ও ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিমের কথা উল্লেখ করেন, যারা গ্রামে বাঘ এলে নিরাপদে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং বনে বনজীবীরা বাঘের আক্রমণের শিকার হলে তাদের লোকালয়ে ফিরিয়ে আনে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের ওপর স্থানীয়দের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বাঘের সংখ্যা কমার আরেকটি কারণ। এই অঞ্চলে লবণাক্ত পানির কারণে চাষবাস না হওয়ায় অধিবাসীরা জীবন-জীবিকার জন্য প্রধানত বনের ওপর নির্ভর করেন। কাঠ, গোলপাতা, মধু, মাছের লাগামহীন সংগ্রহে বন উজাড় হয়ে সংকটে পড়ছে বাঘের আবাস। এ ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় বিকল্প জীবিকা তৈরির সুযোগও তৈরির কথা বলছেন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
এ ছাড়া গত ১০ বছরে সুন্দরবনে ১৫ বারের বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ, কাইন মাগুর সংগ্রহকারীদের অপতৎপরতা, ভূমি দখলের প্রবণতাসহ আরও নানা কারণে এমনটা হয়ে থাকে। আগুনের ঘটনাসহ এসব কারণে বাঘের বংশবিস্তার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
বাঘের বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে জেনেটিক্যাল ডাইভারসিটি বা বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ানোও বেশ জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। যেমন খুলনায় কোনো বাঘ উদ্ধার হলে সেটি চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কিংবা পটুয়াখালীর সোনার চরে ছেড়ে দিলে বাঘের জেনেটিক্যাল ডাইভারসিটি বাড়বে। বাঘ যদি তার আবাসস্থলে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার পায়, তাহলে ওরা সাধারণত নিজ অঞ্চল ছেড়ে যায় না। এর মাঝেই কয়েক বছর আগে, পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিনে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়ার পর, ২০২০ সালে সেখানে বাঘ পুনরায় ‘রিইনট্রোডিউস’ করার জন্য সমীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য এলাকায় বাঘের অস্তিত্ব আছে—এমন প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। বাঘের জন্য উপযোগী আবাস ও খাদ্য রয়েছে কি না, সেটা যাচাই করার পাশাপাশি সেখানে বাঘের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে কি না, সেটাও আমাদের বিবেচনায় আছে।’ এখানে বলে রাখা ভালো, সাঙ্গু-মাতামুহুরী, মাইনিমুখ, কাসালং, চুনাতি জঙ্গলে বাঘের অস্তিত্ব ছিল কয়েক দশক আগেও। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে বাঘের আনাগোনার খবর পাওয়া যায় আদিবাসীদের কাছ থেকে। ২০০৩ সালে কাসালং আর ২০০৬ সালে রেমাক্রিতে বাঘ মারা হয়। ২০০৯ সালে রাইক্ষঙে জীবিত একটি বাঘ দেখেছিলেন স্থানীয় কার্বারি (পাড়াপ্রধান)।
এ ছাড়া পৃথিবীজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, ফলে সুন্দরবনের জলাশয়ে ক্রমেই লবণাক্ততা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে স্থানীয় প্রজাতির গাছপালায়ও। তাই সুপেয় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকানোরও ব্যবস্থা করা জরুরি।
পৃথিবীতে মানুষের পাশাপাশি বন্য প্রাণীরও টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গলে শীর্ষ পর্যায়ের শিকারি প্রাণী না থাকলে সে জঙ্গল টেকে না বেশি দিন, এর প্রমাণ তো আমরা পেয়েছিই।
ছবি: লেখক