skip to Main Content

কভারস্টোরি I আঠারো আস্বাদন

শুধু সংখ্যা নয়, এ হলো নিজ সত্তা গড়ে তোলার এক দুর্নিবার পর্যায়। তার জন্য খানিকটা বোঝাপড়া করে নেওয়া চাই নিজের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গেও। লিখেছেন রুদ্র আরিফ

‘আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি…’
—সুকান্ত ভট্টাচার্য

আঠারো বছর বয়স। এক বিস্ময়কর ও বৈচিত্র্যময় সময়। একজন মানুষের মনে ও শরীরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার কাল। কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখার বয়স। এতকাল ধরে বসত করে আসা কল্পরাজ্য থেকে বাস্তব পৃথিবীর বাস্তবতার সকল রূঢ়তা ও মাধুর্যের সঙ্গে বোঝাপড়া শুরুর ক্ষণ। ‘১৮’ তাই শুধু একটি সংখ্যা নয়, এর তাৎপর্য অনেক বিশাল।

হাওয়া বদলের হাওয়া
মানবদেহের পরিপূর্ণ বিকাশের প্রসঙ্গ এলে বোধ করি কম-বেশি সবার মাথায় প্রথমেই আসে, কিশোরকালের বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক বা সাবালক হয়ে ওঠার কথা। এ সময়ে শারীরিক গঠন একটা বিরাট রূপান্তরের ভেতর দিয়ে পৌঁছে যেতে থাকে কাঙ্ক্ষিত গড়নে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া মানেই কি শারীরিক বিকাশের পূর্ণতা লাভ? মানসিক ও আবেগাত্মক পরিবর্তনগুলোর ছাপ পড়ে কতটুকু? শরীরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মন ও আবেগেরও যদি বিকাশ না ঘটে, সে ক্ষেত্রে জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ—এমনটাই অভিমত মনোবিজ্ঞানীদের। ফলে বড় হতে হতে, আঠারোর সীমানা ছুঁয়ে তা ছাড়িয়ে যেতে যেতে আমরা যত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার ভেতর দিয়ে যাই, তা আমাদের মানসিক ও আবেগাত্মক পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে শারীরিক বিকাশও থাকে চলমান; যদিও পরিবর্তনের এই সামগ্রিক প্রক্রিয়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো নেতিবাচকও হয়ে উঠতে পারে।

শরীর বদল
শরীরের নাটকীয় বিকাশগুলো একটু আগেই, কিশোরকালেই ঘটতে শুরু করে দেয়, সে কথা কম-বেশি জানা আমাদের। ফলে আঠারোয় পড়ার পর যেসব বিকাশ ঘটে, সেগুলো হয়তো আমরা গভীরভাবে খেয়াল করি না। স্বাভাবিক ধরে নিই। তবু বিজ্ঞান বলে, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার বেলায় শারীরিক বিকাশগুলো মূলত তিনটি পর্যায়ে ঘটে থাকে। প্রথমটি প্রাথমিক প্রাপ্ত বয়সে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি যথাক্রমে মধ্য ও শেষ প্রাপ্ত বয়সে। বয়সের হিসাবে প্রথমটি কৈশোর পেরিয়ে ৩৫ বছর পর্যন্ত; দ্বিতীয়টি ৩৫ থেকে ৬৫ এবং তৃতীয়টি ৬৫-ঊর্ধ্ব সময়কালে। এর মধ্যে বয়স ১৮ ছুঁলে, মানে প্রাথমিক সাবালকত্বে একজন ব্যক্তিমানুষের শারীরিক উচ্চতা ও ওজন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এ সময়ে হরমোনাল পরিবর্তনগুলোও থাকে চলমান। তবে সেগুলোর প্রভাব কৈশোরের তুলনায় পড়ে খানিকটা কম। প্রাপ্তবয়স্কতার অন্য দুটি পর্যায়ের তুলনায় এ সময়ের বিরাট আশীর্বাদ হলো, সাধারণত শরীর যেহেতু তুলনামূলক আনকোরা ও ক্রমবিকাশমান, তাই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থাকে বেশি, ব্যাধি ও বালাইয়ের উপদ্রব কম। ফলে শারীরিকভাবে পৃথিবীকে, জীবনকে উপভোগ করার এ এক দুর্দান্ত সময়।

মনোজগতে ঢেউ
সাবালকত্বের কালে আবেগাত্মক ও মানসিক পরিবর্তনও ঘটে। এর প্রথম পর্যায়ে শারীরিক পরিবর্তনের তুলনায় অন্তস্তলীয় পরিবর্তনগুলো তুলনামূলক চোখে পড়ে বেশি। পরিণত বয়স্ক হিসেবে আবেগাত্মক ও মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের এই পর্যায়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের এ পর্যায়েই বাস্তব দুনিয়ায় আমরা নিজেদের জায়গা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালাই। সাধারণত এ সময়েই ক্যারিয়ার, কর্মজীবনসহ সামগ্রিক জীবন গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকি, আর সেই মতে আগ বাড়াই। আমাদের নিজস্ব স্বাধীনতা, নিজস্ব স্বাধীনতাবোধ অর্জন করার মাধ্যমে নিজ রাস্তা খুঁজে নিয়ে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নিজ দৃষ্টিভঙ্গির এক গভীরতর প্রভাব তৈরি হয় এ বয়সে। ফলে নিজের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতা ও অন্য মানুষদের সম্পর্ক ঠিকঠাক গড়ে তোলার এ উপযুক্ত সময়। তা ছাড়া সদ্য উপলব্ধি করা ব্যক্তিস্বাধীনতার যথাযোগ্য প্রয়োগও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

উদযাপনের দায়
চলতি একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘তোমার যৌবনকে লুটের মাল মনে করো না!’ সাধারণত গুণীজন ও মুরব্বিরা তরুণ প্রজন্মকে হামেশা এ ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এর আক্ষরিক ব্যাখ্যা দাঁড় করালে বোঝা যায়, উঠতি বয়সে সবকিছুকেই বেশ উচ্ছল ও গতিময় লাগে। বর্ষায় খালে-বিলে আসা নতুন পানির ছোঁয়ায় দেশি মাছ যেমন খলবল করতে থাকে, তেমনি আঠারোতে পা রাখা সদ্য যুবক বা সদ্য যুবতী জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই প্রবল উচ্ছলতায় উদযাপন করতে চায়। তাতে কখনো কখনো বাড়াবাড়ি যে হয়ে যায় না, তা নয়। আর কিছু কিছু বাড়াবাড়ি তো তার নিজের বটেই; অন্যের, সমাজের, এমনকি স্বয়ং পৃথিবীর জন্যও বয়ে আনতে পারে মারাত্মক ক্ষতি। এমনতর বাড়াবাড়ির নেপথ্য হিসেবে মনোবিজ্ঞানীরা দায়ী করে থাকেন ওই তরুণ বা তরুণীর একদিকে অভিজ্ঞতার অভাব, অন্যদিকে টগবগে প্রাণ-প্রাচুর্যকে। তাই তা সামলে চলার পরামর্শ তাদের।

আয়নার সামনে
নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, নতুন নতুন সম্পর্কের উদয়, পুরোনো মানুষ ও পুরোনো সম্পর্ককে কখনো কখনো নতুন বাঁকে দাঁড় করানোর বয়স এটা। সতেজ চোখে এ সময়ে সবকিছুই যে ভালো লাগে, তা নয়; খারাপ লাগাও করে কাজ। তবে ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগা—যেটিই কাজ করুক, দুটোর অনুভূতিই থাকে তীব্র। তাই সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর আগে চলুন, নিজেকে কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানো যাক—
১. অন্যদের সঙ্গে মিশতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
২. অন্যদের ওপর নির্ভর করতে খুব একটা স্বস্তি লাগে না।
৩. অন্যরা আমার ওপর নির্ভর করলে বেশ স্বস্তি লাগে।
৪. অন্যরা আমাকে পাত্তা দিল কি না, তাতে সাধারণত কিছু যায়-আসে না।
৫. কেউ খুব কাছে আসুক, তা ভালো লাগে না।
৬. অন্যদের খুব কাছাকাছি যেতে একধরনের অস্বস্তি হয়।
৭. অন্য কাউকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারি না।
৮. কেউ আমার খুব বেশি কাছে চলে এলে নার্ভাস হয়ে যাই।
৯. যতটুকুতে স্বস্তিবোধ করি, কেউ কেউ হরদম এর চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে চায়।
১০. যতটা ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে চাই, কেউ কেউ হরদম ততটুকু মিশতে রাজি হয় না।
১১. ভালোবাসার মানুষটি আমাকে আসলে ভালোবাসে না—এই ভয়ে হুটহাট ভুগি।
১২. ভালোবাসার মানুষটি একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কি না—এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
১৩. হরদমই অন্যদের সঙ্গে একেবারেই তাদের মতো হয়ে যেতে চাই, কিন্তু তা কখনো কখনো তাদেরকে ভয় পাইয়ে দেয়।
১৪. আমাদের সম্পর্কের আচমকা ইতি টানার মাধ্যমে অন্যরা আমাকে কষ্ট দিতে পারবে না—এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
১৫. অন্যরা আমার সঙ্গে যতটুকু ঘনিষ্ঠ, তাদেরকে আরও ঘনিষ্ঠরূপে চাই।
১৬. অন্যরা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে—এই ভয় মনে সচরাচর আসে না।
১৭. প্রিয়জনকে যতটা ভালোবাসি, সে-ও আমাকে ততটাই ভালোবাসে—এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
এবার নিজ বিবেচনায় প্রতিটি প্রশ্নের স্কোর লিখে নিন ১ থেকে ৭-এর মধ্যে যেকোনোটি। এ ক্ষেত্রে ‘১’ মানে আপনি ‘পুরোপুরি দ্বিমত’ এবং ‘৭’ মানে আপনি ‘সম্পূর্ণ একমত’। তারপর যোগফল মিলিয়ে নিন।
 ১ থেকে ৩ এবং ৫ থেকে ৭-এর জবাবের সঙ্গে মিলিয়ে বের করে নিন আপনার এড়িয়ে চলার প্রবণতার হার। স্কোর যত বেশি হবে, তার মানে আপনার মধ্যে এড়ানোর প্রবণতা তত বেশি।
 ৪ এবং ১০ থেকে ১৭-এর জবাবের সঙ্গে মিলিয়ে বের করে নিন নিজের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা অ্যাচাটমেন্ট অ্যাংজাইটির প্রবণতা। এ বেলাও স্কোর যত বেশি, আপনি ততটাই এই অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত।
না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। প্রয়োজনে বিজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করুন। পরামর্শ নিতে পারেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের। এই ফাঁকে বলে রাখি, এ বয়সে সাধারণত এসব বিষয়-আশয় নিজের মধ্যে চাপা রাখার প্রবণতা থাকে অনেকের। তা ছাড়া, বিশেষজ্ঞের চেম্বারে হাজির হওয়ার প্রতিও থাকে অনীহা। কিন্তু তা আখেরে ভালো ফল বয়ে আনে না।

বাড়লে বয়স…
‘বাড়লে বয়স সবাই মানুষ হয় কি?’—মহীনের ঘোড়াগুলির গানটি নিশ্চয়ই মনে আছে? থাক বা না থাক, সেই সুরে চলুন প্রশ্ন তুলি: বয়স ১৮-তে পৌঁছলেই সাবালক হওয়া যায় কি? না বোধ হয়। এর সঙ্গে ব্যক্তিত্ব গঠনের রয়েছে নিগূঢ় সম্পর্ক। তবে আইনিভাবে সাবালকত্বকে সাধারণত বয়স দিয়েই বিবেচনা করা হয়। কোনো কোনো সমাজে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো মেয়ে কিংবা ২১ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো ছেলে বিয়ে করার অধিকার পায় না। আবার, কোথাও কোথাও বয়স ১৬ হওয়ার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স, ১৮ হওয়ার আগে ভোটাধিকার, ২১ হওয়ার আগে পানাধিকার বৈধ নয়। সে যা-ই হোক, বেশির ভাগ মনোরোগবিদ অবশ্য কলেজ পাস করা শিক্ষার্থীদের, বিশেষত ১৮-তে পা রাখা তরুণ-তরুণীদের সাবালক হিসেবে গণ্য করে থাকেন। অনেক দিক থেকে ব্যাপারটি তা-ই। এ সময়েই সাধারণত ব্যক্তিত্বের বিকাশ পুরোদমে ঘটতে শুরু করে। আর তা চলমান থাকে আরও বেশ কয়েক বছর। গবেষণায় দেখা গেছে, এ সময়ে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের বিকাশ পরবর্তীকালে ঘটতে থাকলেও তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন সচরাচর ঘটে না।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন গবেষক এলিজাবেথ হার্টকা, আর. মিলস্যাপ এবং এন. হান ১৯৮৬ সালে যৌথভাবে ‘অ্যাজ টাইম গোজ বাই: চেঞ্জ অ্যান্ড স্ট্যাবিলিটি ইন পারসোনালিটি ওভার ফিফটি ইয়ারস’ শীর্ষক গবেষণায় প্রকাশ করেছেন, মূলত হাইস্কুলে পড়ার দিনগুলোতে, অর্থাৎ কৈশোরেই একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে। তারপর সেটি একটি নির্দিষ্ট আকার লাভ করে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখার দিনগুলোতে। তাদের ভাষ্য, ‘ব্যক্তিত্বের বড় ধরনের পরিবর্তনগুলো সাধারণত কৈশোরকালেই ঘটে। তবে সেগুলো সেই বয়সে কাঙ্ক্ষিত পথ খুঁজে পায় না; বরং সেটি পায় সেই বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পর। আর বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই পূর্ণতা পায় ওই মানুষ পুরোদমে কর্মজীবন ও সংসারজীবন শুরু করার পর।’ তার মানে, ব্যক্তিত্ব ঠিকঠাক গড়ে ওঠার সময়ের সূচনাও আঠারোতেই ঘটে, বলা চলে।

বৈষম্যের তীব্রতা
প্রচলিত ব্যবস্থায় বেশির ভাগ সমাজেই নারী-পুরুষের মধ্যে বিবিধ বৈষম্যের ছড়াছড়ি। আর ১৮ বছর বয়ে তা যেন সুতীব্র হয়ে ওঠে। এ বয়সী একটি ছেলে রঙিন চোখে দেখা দুনিয়ায় অনেকটাই স্বাধীন বিচরণের স্বাদ পেলেও সমবয়সী মেয়েটির জন্য থরে থরে সাজানো থাকে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিভীষিকা। অনেকেই নিজের অনিচ্ছায় বাধ্য হয় সংসারজীবনে প্রবেশ করতে। চলাফেরায়ও নানা বিধিনিষেধ। কখনো নিরাপত্তার প্রশ্নে, কখনো কথিত শালীনতার প্রশ্নে! তবু কেউ কেউ সেই সব বেড়াজাল, সেই সব ট্যাবু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, অন্যদেরও বেরিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়। এটিও ১৮ বছর বয়সের একটি অপার্থিব সৌন্দর্য। কবি সুকান্ত যেমনটা লিখেছেন কবিতায়, ‘আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,/ এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,/ বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী/ এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।’

সীমানা পেরিয়ে
ধরা যাক এই দুর্দমনীয় বয়সের আপনি একজন প্রতিনিধি। ফুরফুরে মেজাজে বেরিয়েছেন ঘুরতে। সবল দেহ। হাতে সেলফোন। টিকটক করার কোনো আইটেম বা কনটেন্ট খুঁজছেন মনে মনে। চোখে পড়ল, বয়সের ভারে ন্যুব্জ একটা লোক, শীর্ণ দেহ, জীর্ণ পোশাক, একা ঠেলাগাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ঘেমে একাকার। কিন্তু গাড়ির চাকা হুট করে বালিতে আটকা পড়ায় কিছুতেই তুলতে পারছেন না। নির্জন পথ। ল্যান্ডস্কেপ দারুণ। ভিডিওর জন্য চমৎকার ‘কনটেন্ট’। কী করবেন আপনি? টিকটক বানাবেন? ভিডিও করবেন মানুষটির? ‘মানবিক’ সাক্ষাৎকারের আড়ালে তার দারিদ্র্যকে পুঁজি করে ভিউ বাড়াবেন আপনার পোস্টের? নাকি সেলফোন রেখে, কনটেন্ট তৈরির ভাবনা সরিয়ে, নিজের তারুণ্যের শক্তি দিকে তাকে সাহায্য করবেন চাকাগুলো সচল করার? হ্যাঁ, ১৮ বছর বয়স আপনাকে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা এনে দিয়েছে। আর নিজ সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনও আপনি। এবার কোন সিদ্ধান্ত নিলেন—তার ভেতর দিয়েই প্রকাশ পাবে আপনার ব্যক্তিত্ব। তার ভেতর দিয়েই জানা যাবে, ১৮ আপনার কাছে কোন নিগূঢ় বার্তা বয়ে এনেছে। আপনাকে করে তুলেছে কতটা ‘সাবালক’। ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জন ফাউলস যেমনটা বলে গেছেন, ‘সাবালকত্ব কোনো বয়সের ব্যাপার নয়, বরং নিজেকে জানার একটি পর্যায়।’

পরিশেষে
জীবনদর্শন সম্পর্কে রাশিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি বলেছিলেন, ‘যা কিছুর পরিকল্পনা করেছেন, সেগুলো সত্য করে তুলুন। সেগুলোর ওপর আস্থা রাখুন। সেগুলোর অনুরাগ ঘিরে হাসাহাসি হোক। কেননা, লোকে যাকে অনুরাগ বলে, সেটি আসলে কোনো আবেগাত্মক শক্তি নয়, বরং স্রেফ তাদের আত্মা ও বাহ্যিক পৃথিবীর মধ্যকার সংঘাত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেগুলোকে সেগুলোর ওপর আস্থা রাখতে দিন। সেগুলোকে শিশুদের মতো অসহায় হতে দিন। কেননা, শক্তিহীনতা খুব ভালো জিনিস; অথচ শক্তি দেখানো কোনো কাজের জিনিস নয়। একজন মানুষের যখন জন্ম হয়, তখন সে থাকে দুর্বল ও নমনীয়। যখন মারা যায়, তখন সে শক্ত ও অবশ। একটা গাছ যখন বেড়ে ওঠে, তখন সেটা থাকে নরম ও নমনীয়। কিন্তু যখন শুকিয়ে ও শক্ত হয়ে যায়, তখন সেটার মৃত্যু ঘটে। কঠোরতা ও শক্তিমত্তা আসলে মৃত্যুরই অনুচর। নমনীয়তা ও দুর্বলতা হলো তরতাজা প্রাণের বহিঃপ্রকাশ। কেননা, কঠোরতা কখনো জিততে পারে না।’
১৮ বছর বয়সে পা রেখে, শৈশব-কৈশোরের কোমল দিনগুলো পেরিয়ে সদ্য অর্জিত যৌবনে জীবনকে তারকোভস্কির মতো একটু গভীর ধ্যানে দেখা যেতে পারে। সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা চাই। বাইরের পৃথিবীর সমানতালে নিজ অন্তস্তলেও দেওয়া চাই উঁকি। মনে রাখা চাই, সেলফ-ফোকাস বা নিজের প্রতি মনোযোগ দেওয়াটা কোনো স্বার্থপরতা নয়। হ্যাঁ, অন্যের প্রতিও দায় রয়েছে; তবে ভুলে যাবেন না, আপনার গুরুত্বও সমান। তাই ভবিষ্যতে হয়তো মুশকিল, এমন কিছু মনের ইচ্ছে পূরণ করে ফেলতে পারেন এ বয়সে। যেমন ভ্রমণ, বন্ধুদের সঙ্গে কোয়ালিটিফুল সময় ব্যয়, নিজের কোনো বিশেষ দক্ষতার চর্চা প্রভৃতি। আরও মনে রাখুন, জীবনকে ১০০ মিটারের দৌড় নয়, বরং ম্যারাথন হিসেবে ধরে নেওয়া ভালো। তাই দীর্ঘ যে পথ পড়ে রয়েছে সামনে, তাড়াহুড়ো না করে, লক্ষ্যে স্থির থেকে সেদিকে এগিয়ে চলার হোক শুরু।
পরিশেষে আরেকটি উদাহরণ টানা যাক। ইরানি মাস্টার ফিল্মমেকার আব্বাস কিয়ারোস্তামি প্রায় সারাক্ষণ সানগ্লাস পরে থাকতেন। ‘আপনি কি ঘুমানোর সময়ও সানগ্লাস পরে থাকেন’—একবার এমন এক রসিকতার জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, পৃথিবীকে একটু কোমল রূপে দেখার জন্যই তার এই অভ্যাস। হ্যাঁ, ১৮ এক স্পর্ধিত বয়স। তবে সেই স্পর্ধার ভাষান্তর উদ্ধত না হলে খানিকটা কোমল হলে, খানিকটা মানবিক হলে তা নিজের জন্য, অপরের জন্য, মানবসভ্যতার জন্য, এককথায় সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর জন্যই মঙ্গলকর।

গ্রন্থসূত্র
১. অ্যাটাচমেন্ট ইন অ্যাডাল্টহুড/ মারিও মিকুলিনসার এবং ফিলিপ আর. শেভার; ২০০৭
২. পারসোনালিটি ইন অ্যাডাল্টহুড/ রবার্ট আর. ম্যাকক্রে এবং পল টি. কস্টা; ১৯৯০
৩. স্কাল্পটিং ইন টাইম/ আন্দ্রেই তারকোভস্কি; ১৯৮৪

কভার
আরিফিন শুভ, নাজিফা তুষি, সিয়াম আহমেদ, তাসনিয়া ফারিণ, ইয়াশ রোহান, জান্নাতুল ফেরদৌস ঐশী, মীম মানতাশা, সাফা কবির, এফ এস নাঈম, সারিকা সাবরিন ও আজমেরী হক বাঁধন
মেকওভার
পারসোনা
ওয়্যারড্রোব
মেহের
এ জে (আরিফিন শুভ)
জুয়েলারি
আমিশে
ছবি
হাদী উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top