পাতে পরিমিতি I কোলেস্টেরলের রক্তচক্ষু
স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রসঙ্গ উঠলেই অনেকের ভাবনায় শুরুতে চলে আসে কোলেস্টেরল সমস্যার কথা। কীভাবে একে সামাল দেওয়া যায়? জানাচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি
আমরা সারা দিনে যা করি, যা কিছু খাই, তার ওপরেই অনেকাংশে নির্ভর করে রক্তের কোলেস্টেরলের অবস্থা। তার মানে, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণে ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি রক্তে বাড়তি চর্বি বা কোলেস্টেরল জমে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। কোলেস্টেরল বলতে অনেকেই নির্দিষ্ট একটি চর্বির কথা ভাবেন। কিন্তু রক্তের লিপিডকে মূলত চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়—কোলেস্টেরল, হাই-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এইচডিএল), লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এলডিএল) এবং ট্রাই গ্লিসারাইড (টিজি)। এই লিপিডগুলোর মধ্যে কোনোটা ভালো, আবার কোনোটা খারাপ। সব কোলেস্টেরলই যে শরীরের জন্য খারাপ তা নয়। যেমন এইচডিএল-কে বলা হয় ‘গুড কোলেস্টেরল’। রক্তে এর পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলে হার্ট ডিজিজ ও স্ট্রোক থেকে অনেকটা দূরে থাকা সম্ভব। অন্যদিকে এই চার ধরনের কোলেস্টেরলের মধ্যে সবচেয়ে ‘খারাপ’ বলা হয় এলডিএল-কে।
কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে সব সময়ই যে কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা দেবে, এমনটা না-ও হতে পারে। তবে সাধারণত রক্তে চর্বি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, চেস্ট পেইন, টায়ার্ডনেস, শরীরে অসাড়তা ভাব প্রভৃতি। এ ছাড়া যাদের দীর্ঘদিন ধরে রক্তে লিপিড প্রোফাইল হাই, তাদের ক্ষেত্রে ঘাড়ের পেছনে, গলায় কালো ছোপসহ স্কিনের বিভিন্ন জায়গায় রঙের পরিবর্তন হতে দেখা যেতে পারে।
রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে নানা সমস্যার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে হৃদপিণ্ড। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বা চর্বি হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ গলব্লাডার বা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া দেখা দিতে পারে লিভারের নানান অসুখ; যেমন ফ্যাটি লিভার। ফলে অনেক সময় রোগী স্বাভাবিকভাবে খাবার হজম করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয় কিছু খাদ্য উপাদান; যেমন দুধ, শাক এবং উচ্চ আঁশযুক্ত খাদ্য।
যাদের রক্তে ইতিমধ্যে চর্বির পরিমাণ বেশি, তাদের জন্য কিছু পরামর্শ:
সিম্পল কার্বোহাইড্রেট: যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেই আমরা সাধারণত চিনি, মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলোকে নিষেধ বলে মনে করি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণও রক্তে একধরনের কোলেস্টেরল বাড়ায়। আর সেটি হলো টিজি। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকা থেকে কার্বোহাইড্রেটকে পুরোপুরি বাদ না দিয়ে বরং বাদ দিতে হবে সিম্পল সুগার বা মিষ্টিজাতীয় খাবার। অনেকেই মেইন কোর্স, যেমন দুপুর বা রাতে খাবারের পর একটা মিষ্টি, দই কিংবা কোনো মিষ্টান্ন না খেলে তৃপ্তি পান না। ফলে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা হয়ে যায়, যা ধীরে ধীরে জমে রক্তে ট্রাই গ্লিসারাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মিষ্টান্ন খাওয়ার অভ্যাস বদলে ফেলতে হবে।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট: কোলেস্টেরল বৃদ্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ। যারা অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি বেশি গ্রহণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে চর্বি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই ইতিমধ্যে যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেছে, তাদের অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য যেমন বিরিয়ানি, তেহারি, নেহারি, গরু-খাসির চর্বি, মেয়োনিজ প্রভৃতি গ্রহণ সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে।
ট্রান্স ফ্যাট: রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে বাইরের খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উত্তম। অনেকেই সকালের নাশতা হিসেবে শিঙাড়া, পুরি, এমনকি কুকিজ পছন্দ করেন। এসব খাবার যেসব তেল দিয়ে ভাজা হয়, সেগুলো গ্রহণে দেহে ট্রান্স ফ্যাটের আধিক্য দেখা দেয়। তাই রক্তে অতিরিক্ত চর্বির পরিমাণ কমাতে বাইরের খোলা খাবার, দোকানের খাবার বাদ দিয়ে ন্যাচারাল ফ্রুটস, ফলের রস ইত্যাদি রাখা চাই খাদ্যতালিকায়।
সত্যি কথা বলতে প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় আমরা অনেক সময়ই ভুলে যাই, ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। আর শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র হলো শৃঙ্খল ফুড হ্যাবিট ও লাইফস্টাইল। অর্থাৎ আমরা যে ধরনের খাবার গ্রহণ করব, তারই প্রভাব পড়বে শরীরে। কায়িক পরিশ্রম যদি কম হয়, আর অতিরিক্ত ক্যালরি যদি আমরা গ্রহণ করি, সে ক্ষেত্রে সেই ক্যালরিগুলো ধীরে ধীরে শরীরে জমে রূপান্তরিত হবে কোলেস্টেরলে। তাই বডি মুভমেন্ট বা কায়িক পরিশ্রম যেন প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে হয়, সেটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিশ্রম যেমন ডেকে আনতে পারে অসুখ, তেমনি কম পরিশ্রমও আমাদের এনার্জিকে লুজ করে। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন দুই বেলা কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট দ্রুত হাঁটার প্র্যাকটিস থাকলে ওজন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, হার্টের সুস্থতা, এমনকি মনের সুস্থতাও বিদ্যমান থাকে।
কিছু কিছু খাদ্য রক্তে চর্বির মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তাই আপনার খাদ্যতালিকায় এসব খাদ্য যুক্ত করে নিতে পারেন:
মিক্সড নাট: কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম ও পামকিন সিডসের সংমিশ্রণে তৈরি মিক্সড নাট রক্তের চর্বি কমাতে বেশ কার্যকর। বাদামে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, প্রোটিন ও ফাইবার। বাদাম রক্তের কোলেস্টেরল কমিয়ে হার্টের সুস্থতা রক্ষা করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া যারা ওবিসিটি বা ওজন বেশি নিয়ে চিন্তিত, তারাও প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন মিক্সড নাট। অন্যদিকে, কাঁচা বাদাম থেকে প্রচুর এইচডিএল পাওয়া যায়। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে কাঁচা বাদাম গ্রহণে রক্তে এইচডিএলের মাত্রা বাড়ে।
গ্রিন টি: ওজন কমাতে গ্রিন টি খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন মধ্য সকালের স্ন্যাকস কিংবা বিকেলের নাশতা হিসেবে এক মগ গ্রিন টি হতে পারে সুপার পানীয়। গ্রিন টিতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এতে থাকা ক্যাটেচিন নামক উপাদান ওজন কমানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তের চর্বি কমাতেও দারুণ কাজের।
অলিভ অয়েল: রান্নায় ভোজ্যতেলের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি তেলের ধরন পাল্টে নিলে অতিরিক্ত চর্বি কমানো বেশ সহজ হয়। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে পারেন অলিভ অয়েল। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ই রক্তের ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে খারাপ কোলেস্টেরল, অর্থাৎ এলডিএলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে।
রসুন: মেডিসিনাল ফুড হিসেবে সুনাম আছে রসুনের। রক্তে চর্বির পরিমাণ কমাতে এর ব্যবহার বহুকাল ধরে ঘটে আসছে। রসুনে রয়েছে সেলেনিয়ামসহ বেশ কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। প্রতিদিন এক কোয়া রসুন গ্রহণে রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের দেশীয় পদ্ধতিতে রান্নার সময় প্রায় প্রতি ঘরেই রসুনের ব্যবহার রয়েছে। তবে রান্নার ধরনগুলো প্রয়োজনমতো পাল্টে নিলে, তার মানে অতিরিক্ত মসলা কষানো ও তেল-ঝালের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে ব্যবহৃত মসলাগুলো সঠিকভাবে দেহে কাজ করতে পারবে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে কাঁচা রসুন খালি পেটে চিবিয়ে খেলে এসিডিটি বা আলসারের মতো সাইড ইফেক্টের আশঙ্কা থাকে। তাই যেকোনো মেডিসিনাল ফুড গ্রহণ করার আগে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
রক্তের চর্বি কমাতে যা-ই গ্রহণ করা হোক না কেন, দৈনন্দিন পানি গ্রহণ যেন পর্যাপ্ত হয়, সেটি খেয়াল রাখা জরুরি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পানের দরকার পড়ে। যাদের বারবার ক্ষুধা লাগার প্রবণতা রয়েছে, পর্যাপ্ত পানি গ্রহণের ফলে সেটি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্যালরি কিংবা ক্যালরিবহুল খাদ্য গ্রহণের ক্রেভিং কমে আসে। ফলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হয়। তবে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে শুধু ডায়েট নয়, ওষুধেরও প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযোগ্য চিকিৎসক কিংবা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া চাই।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট