skip to Main Content

স্বাদশেকড় I বিস্কুট বার্তা

বিস্কুট কে না ভালোবাসে? তা হতে পারে যেকোনো রকম—ছোট কিংবা বড়, নরম কিংবা কুড়কুড়ে, আইসড কিংবা চকোলেট দিয়ে আবৃত। চায়ের সঙ্গে চুবিয়ে বা চাবিয়ে বিস্কুট খাওয়া যেন এখন সামাজিক রেওয়াজ!

প্রাচীনকালের বিস্কুট বলে যেগুলোকে ধারণা করা হয়, সেসব নিওলিথিক যুগে পাথরে বেক করে বানানো হতো। বেক করা শস্যের প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশগুলো কী ছিল, সে ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিস্কুট শব্দটি ইংরেজিতে এসেছে ফরাসি বিস-কুই থেকে, যা দুবার রান্না করা রুটিকে বোঝায়। রোমানদের মাঝে একধরনের বিস্কুটের প্রচলন ছিল, যাকে রাস্ক বলা হতো। এটি এমন এক ধরনের বিস্কুট, যাকে একাধিকবার সেঁকে শক্ত করা হতো। তারপর অনেক দিন ধরে সংরক্ষণ করা হতো। সেই সময় তা ছিল ভ্রমণকারী ও সৈন্যদের জন্য বেশ অপরিহার্য আহার।
বিস্কুটের জন্মস্থান সবাই ইতালিকে মনে করে। এর অন্যতম কারণ, খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতকে, ৭৯ সালের দিকে সে দেশের পম্পেই শহর যখন ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সেখানে বিস্কুটের বেশ কয়েকটি কারখানা ছিল। ২০০০ সালেরও পরে প্রত্নতত্ত্ববিদদের খননে বেরিয়ে আসে সেই বিস্কুট। অন্যদিকে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর তীরে বসবাসকারীরা বুনো ফসল থেকে বার্লি ও গম তৈরি করতেন। এর সঙ্গেও বিস্কুটের সংযোগ রয়েছে বলে ধারণা প্রত্নতাত্ত্বিকদের।
এদিকে চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘বিস্কুট’ শব্দটি ইংরেজিতে আবির্ভূত হয় এবং ক্রমান্বয়ে এর সংজ্ঞা বিস্তার লাভ করে। দুবার সেঁকা সুস্বাদু ও মিষ্টি বিস্কুটগুলো তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। পেনকেকের মতো খাবার সে সময় জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ওয়েফারগুলো ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মধ্যযুগীয় বিস্কুটগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা মিষ্টি বাটার দিয়ে তৈরি করা হতো। পরবর্তীকালে প্রযুক্তির উন্নয়নে এর প্রক্রিয়াজাতকরণ ভিন্নতর হয়।
বলে রাখা ভালো, জাহাজ নির্মাণের কৌশল পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং তা সারা বিশ্বে বিস্তৃত হওয়ার ফলে নৌব্যবস্থা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক সময়ে বিভিন্ন ভূখণ্ড জয়ের পরে নাবিকেরা সমুদ্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে থাকেন। আদি বিস্কুটের চাহিদা তখনো ফুরোয়নি। তবে তখনকার বিস্কুটগুলো এখনকার বিস্কুটের তুলনায় ছিল যেন অখাদ্য! এতই শক্ত, দাঁত দিয়ে সেগুলো ভাঙা ছিল রীতিমতো কষ্টসাধ্য কাজ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নাবিকেরা শক্ত বিস্কুটকে পোস্টকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতেন। ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ আর্মাডারদের জন্য খাদ্য বরাদ্দ ছিল এক পাউন্ড বিস্কুট ও এক গ্যালন বিয়ার। ক্যানবদ্ধ খাবার প্রচলনের আগে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভিতে বিস্কুটের বেশ সমাদর ছিল। তবে ১৮৪৭ সালে ক্যানে সংরক্ষিত গরুর মাংস প্রচলনের পর থেকে বিস্কুটের ব্যবহার কমতে থাকে।
বিস্কুটের বড় ধরনের বিবর্তনের শুরু সপ্তদশ শতাব্দীতে। তার আগে চিনি ছিল খুব দামি পণ্য; শুধু ধনী ব্যক্তিরা এটি খেতেন এবং নিকটবর্তী ভূখণ্ড থেকে তা আমদানি করা হতো। ১৬৬০-এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে উপনিবেশ গড়ে ব্রিটেন। বিশ্ব ইতিহাসে শুরু হয় এক কালো অধ্যায়। অবশ্য ব্রিটেন দাস ব্যবসায় অংশগ্রহণকারী একমাত্র ইউরোপীয় দেশ ছিল না, তবে ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। দাস ব্যবসার সূত্র ধরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আমেরিকায় বৃক্ষরোপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং মানুষের দুর্দশার ওপর ভিত্তি করে চিনির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে দেশটি। সে সময় ব্রিটেনে চিনির দাম কমে এসেছিল এবং যে খাবারগুলোতে এর ব্যবহার হতো, তা হয়ে উঠেছিল তুলনামূলক সস্তা এবং আরও সহজলভ্য। এর ফলে বিস্কুটের ধরন বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়তে থাকে এই মজাদার খাদ্যের উপস্থিতি। যদিও ১৮০৭ সালে ব্রিটেন ক্রীতদাস-বাণিজ্য এবং ১৮৩৩ সালে দাসপ্রথা বাতিল করে, তবু বহু দশক ধরে মানবেতর পরিস্থিতিতে উৎপাদিত হতে থাকে চিনি। এদিকে ১৮৬৫ সালের আগ পর্যন্ত আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়নি।
যাহোক, সহজে ভালো উপাদানপ্রাপ্তি সপ্তদশ শতাব্দীতে বিস্কুটের বিকাশের একমাত্র কারণ ছিল না। ইতালি ও ফ্রান্সের প্রভাবে উৎপাদন প্রযুক্তিতে নতুনত্ব আসছিল এবং একটি নীরব বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছিল। পুরোনো গিল্ড সিস্টেম ভেঙে পড়ছিল। শত চেষ্টায়ও রুটির কারখানাগুলো জনসাধারণকে বাসায় বিস্কুট বানানো থেকে বিরত রাখতে পারেনি। রেসিপির বইগুলোতে নতুন নানান ধরনের বিস্কুট বানানোর প্রণালি লিপিবদ্ধ হচ্ছিল, সেটা সাধারণ মানের শক্ত বিস্কুট কিংবা ঘি, চিনি, বাদামমিশ্রিত বিস্কুটই হোক।
সপ্তদশ শতাব্দীর তিনটি জনপ্রিয় পানীয়ের মধ্যে একটি ছিল চকোলেট। সে সময়ে চা আর কফিও ব্রিটেনে আসে এবং এই তিনটি পানীয় বিস্কুটের ইতিহাস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্কুটকে ডেজার্ট হিসেবে খাওয়া হতো। কিন্তু চা সামাজিক রীতিতে প্রবেশ করার ফলে বিস্কুট একটি নতুন প্রথার অংশ হয়ে ওঠে। বিকেলের চা হয়ে ওঠে জীবনযাপনের একটি জনপ্রিয় অংশ।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে দুই ধরনের বিস্কুট পাওয়া যেত। একটি ছিল স্যাভয়, অন্যটি রেটিফিয়া। স্যাভয় লম্বা টিনে তৈরি করা এবং বিংশ শতাব্দীতে এটি লেডিফিঙ্গার নামে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে রেটিফিয়া ছিল কাঠবাদামের মিশ্রণে তৈরি কুড়মুড়ে স্বাদের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বিস্কুট সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তখন মূলত বেশির ভাগ মানুষ বাসায় বিস্কুট বানানো শুরু করে এবং প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানে নানা ধরনের বিস্কুট উপস্থাপনের প্রবণতা বাড়ে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা খাওয়ার ব্যাপারটি কয়েক ধাপে শেষ করত, যেখানে শেষাংশে বিস্কুটের সঙ্গে নানান ধরনের ডেজার্ট রাখা হতো; যেমন আইসক্রিম, ফল ও বাদাম। সে সময় ডিম দিয়ে তৈরি একধরনের ছোট বিস্কুট, ম্যাকারুন, ওয়াইন বিস্কুট, পেটিট ফোর বিস্কুট বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
পেটিট ফোর মানে ‘ছোট ওভেন’। এটি উচ্চ তাপমাত্রায় উৎপাদন করা ছোট, উপাদেয় বিস্কুট। সাধারণত কাটা হতো ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ আকৃতিতে। এই বিস্কুটগুলো ছিল রঙিন, সুসজ্জিত এবং নানান ধরনের উপাদানের মিশ্রণে তৈরি। একে ক্ল্যাসিক ডেজার্ট বিস্কুট হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ইতিমধ্যে স্পঞ্জ বিস্কুটের ব্যবহার দিন দিন বাড়তে থাকে, যা সুন্দরভাবে এক কাপ চায়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো। ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়া এ বিস্কুট বেশ পছন্দ করতেন। উইন্ডসরে বানানো এই বিস্কুটগুলো তার আবাসিক প্রাসাদে পাঠানো হতো। এই বিস্কুটগুলোর মধ্যে ল্যাংগুয়েজ ডি চ্যাট, চকোলেট স্পঞ্জ, ওয়েফার, পেটিট ফোর এবং রাইস কেক অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে পরপর দুটি শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। এ সময়ে দেশটিতে কারখানায় বিস্কুট উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। প্রথমে বাষ্প শক্তি এবং তারপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করা বিস্কুট ছড়িয়ে পড়তে থাকে সর্বত্র। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য বিস্কুটের মধ্যে রয়েছে পিক ফ্রেন্স, হান্টলি ও পামার্স। এরপর দ্রুতই নানান ধরনের বিস্কুট বাজারে আসতে থাকে: ১৮৫০-এর দশকে জেমস, ১৮৬১ সালে গ্যারিবাল্ডিস, ১৮৬০ সালে অসবোর্ন বিস্কুট (অসবোর্ন হাউসের নামে নামকরণ), একই বছর দ্য পার্ল, ১৮৬৩ সালে মেরি এবং ১৮৯৯ সালে প্রথম চকোলেট ডাইজেস্টিভ। স্যাভয় বিস্কুটগুলোও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৮৫ সালে জ্যাকবসের ক্রিম ক্র্যাকার বাজারে আসে। অনেক বিস্কুট কোম্পানি নতুন মুদ্রণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশেষ টিন তৈরি করেছিল, যা দ্রুতই সংগ্রহযোগ্য হয়ে ওঠে।
চিনি তখনো বিস্কুটের গল্পের একটি মৌলিক অংশ। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরা চিনির ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে, ফলে এটি যথেষ্ট সস্তা হয়ে ওঠে; বিশেষ করে গরিব মানুষের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নেয়। অন্যদিকে বিস্কুট উৎপাদনকারীরা বর্ধিত চাহিদার কারণে বেশি উৎপাদন শুরু করে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে তাদের অবস্থা বেশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে।
আমাদের দেশে বিস্কুট উৎপাদনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে শুরুর দিকে বেলা বিস্কুট ছিল বেশ নামকরা। গণি বেকারির হাত ধরে এ বিস্কুটের প্রচলন শুরু হলেও ধীরে ধীরে সব বেকারিতেই তৈরি হতে থাকে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেকারিশিল্পের প্রসার ঘটে চট্টগ্রামে। গণি বেকারি থেকে ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য বেকারির পণ্য তৈরি হতো। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ১৭টি বেকারিতে তৈরি হতো বেলা বিস্কুট।
বর্তমানে নানান ধরনের বিস্কুট সবখানেই পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক সময়ে চিনিসংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সামনে আসায় সারা বিশ্বে বিস্কুটের ওপর আংশিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে স্বস্তির ব্যাপার, বিস্কুট আকারে বেশ ছোট এবং একসঙ্গে সাধারণত অল্প পরিমাণ খাওয়া হয়। তা ছাড়া স্বাস্থ্যবান্ধব বিস্কুটেরও বেশ প্রচলন রয়েছে এ সময়ে। তাই নিজের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে, পছন্দের আকার ও স্বাদের বিস্কুট বেছে নিতেই পারেন যেকোনো গ্রাহক। তাতে সময়টা বেশ আনন্দে কাটবে!
 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top