বিশেষ ফিচার I অচিন পাখির দেশে
এ এক মানুষ ভজনার মেলা। প্রতি বসন্তের শেষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পদ্মার চরে চলে এই আয়োজন। সেখানে অসাম্প্রদায়িক মানুষের ভালোবাসাবাসি। লিখেছেন অতনু সিংহ
বাংলার এক ফকির অচিন পাখি ওরফে আলহিম ফকির। যাঁর ভাবনা, মানুষ একদিন ঠিক পাখি হয়ে যাবে। পাখির যেমন রাষ্ট্র নেই অথচ আছে তার কিচিরমিচির-কুহু ভাষার নিজস্ব বলয়, আছে তার প্রেমের বাসা। সে ইচ্ছেমতো উড়তে পারে। তেমনই আলহিম ফকির রাষ্ট্রহীন ভালোবাসা ও মানুষ ভজনার তাগিদে পদ্মার চরে নো-ম্যান্স-ল্যান্ডের নৈরাষ্ট্রের এক প্রান্তভূমিতে বেঁধেছেন আখড়া। সেই ঠিকানা মানে রাষ্ট্রহীন ভালোবাসাবাসির এক দেশ, সেখানে চাঁদনি রাতে বসে গানে গানে মানুষের ভেতরে থাকা পরমের জিকির, চলে প্রেমের জিকির। আমরা সেই রাষ্ট্রহীন ভালোবাসার দেশের গল্প ভাগ করে নিতে চাই।
তার আগে জেনে রাখা ভালো, ফকিরের রাষ্ট্র নেই। আছে প্রেম ও মানুষ ভজনার দেশ। কেননা রাষ্ট্র আসলে কর্তৃত্বের একটি কাঠামো। কিন্তু দেশ হচ্ছে যাপনভূমি। যে যাপন জীবনের, অস্তিত্বের, সংগ্রামের, ভালোবাসার। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো নানাভাবেই রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কর্তৃত্ববাদকে পূর্ণতা দেয়, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে এমন কিছু বিশ্বাস, আচার, উৎসব ও যাপন, যা লৌকিক। পরজগতে প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং ইহজগতেই পরজগতের স্বপ্নকে সাকার করার নানা প্রয়াস লোকমানসকে ঘিরে পূর্ণতা দেয় সেই সব লৌকিক বিশ্বাস, লোক-অধ্যাত্মের জগৎ। পরকালের কর্তা নয়, বরং ইহকালের গণমানুষ ও গণমানুষের মধ্যকার একক লোকব্যক্তি-মানুষই সেখানে পরমের ধারণা। যেমন আমাদের এই বাংলার লোককবি, লৌকিক অধ্যাত্মের প্রেমিক পুরুষ লালন সাঁইয়ের মানুষ ভজনার পথ।
কিংবা শুধু লালন সাঁই নয়, বাংলার আউলিয়া পথের সাধুগুরুরা, ফকির-আউল-বাউল-মুর্শিদ-দরবেশরা, যাঁদের অনেকেই মনে করেন আপন আত্মপুরের সন্ধান পেলেই পাওয়া যাবে আলোকজনের সন্ধান, পাওয়া যাবে পরমজনের সন্ধান। বাংলার বৈষ্ণব, মারেফত-তরিকত-কর্তাভজা-মাইজভান্ডারিসহ নানা লৌকিক ধারার সাধক, যাঁরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবাদ, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রেম ও পরমের মন্ত্র-আয়াতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন; যাঁদের কাছে রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় বা শ্রেণিবৈষম্যের বিভাজন তুচ্ছ; যাঁরা মানুষ ভজনায় মেতে থাকেন, যাপন করেন প্রেমের দেশে- বাংলার এমনই এক সাধু অচিন পাখি, যাঁর আশ্রম পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী পদ্মার চরে। যে ভূমিতে ভারত কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিহ্ন নেই, অথচ আছে চরাচর বাংলা।
একদিকে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলা, অন্যদিকে এই বাংলাদেশের রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলা। মাঝে পদ্মার চর। যা উদয়পুর চর নামেও পরিচিত, বর্ষা থেকে শুরু করে শরৎ অবধি সেখানে বয়ে চলে পদ্মা। শীত থেকে গ্রীষ্ম অবধি সেইখানে চর। আর চর জাগলে জেগে ওঠে নদীর গর্ভের মাটি, তাতে ফসল হয়, ফুল ফোটে আর বসন্তে দুই বাংলার নানা প্রান্ত থেকে জড়ো হন সাধু-বাউল-ফকিররা।
প্রতিবছর বসন্তের শেষের দিকে এই চরে একটি সাধুসেবা ও মোচ্ছবের আয়োজন করেন ফকির আলহিম। সেই সাধুসেবায় হাজির থাকেন দুই বাংলার নানা ফকির, বাউল, আউলিয়া, সাধুরা। মাটি ও খড়-সহযোগে নির্মিত আখড়াগৃহ ও বিশ্রামাগারে ভরে ওঠে মানুষ। সাধু-ক্ষ্যাপারা ছাড়াও দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এলাকার প্রান্তিক মানুষ, আর কৃষিজীবীরা আগ্রহ ও ভক্তিসহকারে সমবেত হন এই আনন্দ আয়োজনে। তা ছাড়া কলকাতা ও ঢাকা থেকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী, তরুণ লেখক ও শিল্পীরা নানা সময় হাজির থেকেছেন এই মানুষ ভজনার মেলায়।
আজকাল বাউল-ফকির উৎসবের নামে বহুজাতিক করপোরেটদের স্পনসরশিপে যেভাবে নাগরিক অনুষঙ্গে লোকসংস্কৃতির পুঁজিবাদী বিকৃতি ঘটানো হয়, এই ধরনের জমায়েত সেই বিকৃতির উল্টো দিকে থাকা খাঁটি লোকযাপনের অংশ। বাংলার নানা প্রান্তে আজও এমন আখড়া ও যৌথ সহজ যাপনের বাস্তবতা হাজির আছে। কিন্তু অচিন পাখি আলহিম ফকিরের চরের আশ্রম রাষ্ট্রহীন দেশে। বন্যা আর খরার সঙ্গে নিত্য সংগ্রাম করে যাওয়া প্রান্তজনেরা ভরে যায় আলোয় আলোয়, যখন তাদের ভূমিসংলগ্ন পদ্মার এই চরে সাধু, মুর্শিদ-দরবেশ-সাঁইজনেরা আর কত শত মানুষ জড়ো হয়।
ফাল্গুন পূর্ণিমাতেই আগে এই মেলা ও মোচ্ছব হতো। কিন্তু ইদানীং উত্তরবঙ্গে দুই বাংলার সীমান্তে অচিন পাখিকে কেন্দ্র করে সাধুসেবার আয়োজন করেন তাঁর শিষ্যরা। তাই ফকির বাবা ইদানীং দোলপূর্ণিমার ঠিক পরেই মৃদু চাঁদের আলোয় পদ্মার চরে এই উৎসব করছেন। মোট তিন দিনের সাধু সমাগম হয় পদ্মার ওই চরে। বলে রাখা দরকার, দোলপূর্ণিমা দিবস-সময় দুই বাংলার নানা অঞ্চলেই ফকিররা সাধু সমাগমের আয়োজন করে থাকেন। দোলপূর্ণিমা হলো শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব দিবস। এই উপলক্ষে ফকির লালন সাঁই জীবিতাবস্থায় ছেঁউড়িয়ায় তাঁর আখড়ায় সাধুসেবার আয়োজন করতেন। চৈতন্যের আবির্ভাব-তিথি উপলক্ষে লালন সাঁইয়ের সাধুসেবা আয়োজিত হয় দোলপূর্ণিমার দিন। কুষ্টিয়ার লালন ধামে সাধুসেবা ও লালন মেলার আয়োজন করা হয় প্রতিবছরের একই দিন। লালন ধামে নবপ্রাণ আখড়ায় শ্রীচৈতন্য ও লালন সাঁইয়ের স্মরণে তিন দিন ধরে চলে সাধুসেবা। চৈতন্যের আবির্ভাব-তিথি উপলক্ষেই লালন সাঁই ও চৈতন্য মহাপ্রভুর স্মরণে পদ্মার চরে তিন দিনের সাধুসেবার আয়োজন করেন আলহিম ফকির। উল্লেখ্য, এটি কেবল গানবাজনার আনন্দ উৎসব নয়, এর মধ্যে থাকে মানুষ ভজনার আচার, লোকাচার। বাংলায় সুলতানি আমলে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ও পন্ডিত বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য নিজেকে ডিক্লাসড বা শ্রেণিচ্যুত করে শূদ্র ও মজলুম জনতার হক আদায় করতে নামসংকীর্তনকে আশ্রয় করে পথে নেমেছিলেন। বিশ্বেশ্বর ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে চেতনপুরের শ্রীচৈতন্য রূপে নদীয়ায় তথা বাংলায় হাজির হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতপাতের অস্পৃশ্যতা, পুরুষ-নারী বিভাজন ও শরিয়তি আধিপত্যের বিরুদ্ধে একযোগে মুখর হয়েছিলেন তিনি। আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন বাংলার নিম্নবর্ণের জনতা, শূদ্র ও মজলুম। তাঁর এই আন্দোলন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ইসলামের সমন্বয়মূলক ধারাটিকেও। ঈশ্বর বেহেশতে নয়, আছে আপন অন্তঃপুরেই, তাই মানুষ ভজলেই তাঁকে পাওয়া যাবে- এই রাজনৈতিক বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বাংলার ফকিররা। যদিও চৈতন্য বাংলার ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আস্ফালনে শেষমেশ টিকে থাকতে পারেননি বঙ্গে, তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল উড়িষ্যায়। অভিযোগ, সেখানে তাঁকে হত্যা করে রটিয়ে দেয়া হয়, তিনি জগন্নাথের সঙ্গে মিশে গেছেন অথবা সমুদ্রের পানিতে বিলীন হয়েছেন। অন্যদিকে চৈতন্যের পথকেও তত দিনে ফের সংস্কৃতায়ন করে ফেলেন কিছু লোক। কেবল নিত্যানন্দ তাঁর পথ ও মত প্রচার করে যান। যাঁরা চৈতন্যের পথে থেকে যান, তাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী বৈষ্ণব আর যাঁরা ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে আপোস চালান, তাঁরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব নাম নিয়ে শঙ্করাচার্যের সঙ্গে চৈতন্যকে মেলাতে চেষ্টা করেন। অথচ এই শঙ্করাচার্যের দর্শনের বিরুদ্ধেই দার্শনিক সন্দর্ভ হাজির করেছিলেন শ্রীচৈতন্য।
যা হোক, চৈতন্যের চেতনাকে আজও বহন করেন বাংলার ফকিররা। লালন সাঁই নদীয়ার চৈতন্য ধারাকে নতুন রূপ ও বয়ানে বয়ে নিয়ে গেছেন। ইসলামের জাত-পাত, বর্ণভেদহীন সমতার আদর্শের সঙ্গে মিল পেয়েছেন চৈতন্যের বাণীর। তাই চৈতন্যের আবির্ভাব-তিথিতে বাংলার ফকির সমাজ সাধুসেবা করে থাকেন।
দোলপূর্ণিমার আশপাশেই চৈতন্য স্মরণে লালন সাঁইয়ের সাধুসেবার কথা মাথায় রেখে পদ্মার চরে আলহিম ফকিরও প্রতিবছর এই সাধুসেবার আয়োজন করে থাকেন। চরে যেখানে বাংলাদেশ-ভারতের রাষ্ট্রীয় উপস্থিতি হাজির নয়, সেই নৈরাষ্ট্রের দেশে চলে এই সাধুসেবার উৎসব। প্রথম দিন সীমান্ত-প্রহরীদের ক্যাম্প অতিক্রম করে চরের উপর দিয়ে বহু পথ হেঁটে আখড়ার সম্মুখে উপস্থিত হন সাধুজনেরা, তরুণ লেখক, শিল্পী ও সহজ মানুষেরা। চরের আখড়ার চারদিকে ইতিউতি শুরু হয়ে যায় গান। দোতারা, একতারা, খোমক-সহযোগে। তবে মূল অনুষ্ঠান সেই দিন নয়, তারপরের দিন। সেদিন রাতে একসঙ্গে ভাত-ডাল আর সবজি ভাগ করে খান সমবেত মানুষেরা। পরদিন ভোরবেলা ফকির বাবা উপস্থিত সব মানুষের সামনে হাজির হন, হাতে ধূপধুনা নিয়ে উপস্থিত প্রত্যেক মানুষকে আলাদাভাবে পূজা করেন তিনি। করেন মানুষের ইবাদত। এই মানুষ পূজায় উপস্থিত মানুষের মুখে তুলে দেন চিড়া, দুধ আর গুড়। এরপর শামিয়ানার তলায় শুরু হয় গান। গান ও মানুষ ভজনা আর প্রেমের তত্ত্বকথার ফাঁকেই একদিকে চলে রান্নার আয়োজন। দুপুরে আবার সবাই পাতপেড়ে মধ্যাহ্নভোজ সারেন। তবে তা নিরামিষ। সাধুসেবার সময় ফকিররা নিরামিষ খান। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে সারা রাত চলে গান, আপন অন্তরে থাকা পরমের জিকির। তার ফাঁকে লুচি, সবজি আর মিষ্টান্নসহযোগে একসঙ্গে নৈশ আহার। ফের গান, অবিরাম, রাত পার হয়। পরদিন সাধুসেবার শেষে দুপুরে মৎস্যমুখের মাধ্যমে উৎসবের সমাপন। শেষ দিনের এই আয়োজনকে বলা হয় মোচ্ছব। তিন দিনের এই সমাগমকে কেন্দ্র করে পদ্মার ওই চরে বসে যায় লৌকিক মেলা। লম্পের আলো জ্বেলে দিকে দিকে বিক্রি হয় চপ, জিলাপি, পাঁপর ভাজা, গজাসহ নানা সুস্বাদু খাবার, বিক্রি হয় মেয়েদের মাথার ক্লিপ, ফিতাসহ নানা পণ্য।
এই মেলায়, এই মোচ্ছবে অংশ নিতে হলে পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের দিক থেকে চর-সংলগ্ন সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে এসে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। তারপর নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে যাওয়া। আখড়া থেকে দূরে দেখা যায় দুদিকে দুই বাংলা, বিভাজনের ইতিহাস কাঁধে নিয়ে মিটমিট জেগে আছে রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায়। কিন্তু ফকিরের দেশ নেই, শ্রেণি নেই, সাম্প্রদায়িকতা নেই, জাতিবাদ নেই; ফকিরের আছে মানুষ ভজনা ও মানুষ সেবার তাগিদ। তাই দুই বাংলার মাঝে রাষ্ট্রহীন এক স্থানে ফকির অচিন পাখি আয়োজন করে আসছেন এই আনন্দ উৎসবের। পদ্মার চরে এই সাধুসেবা শ্রেণিবৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বিভাজন, পুরুষ-নারী ভেদাভেদ, ব্রাহ্মণ্যবাদসহ সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিপ্রতীপে এক প্রেমের উৎসব।
ছবি: লেখক