skip to Main Content

মনোযতন I ভুলো মনের মর্মযাতনা

আলঝেইমার। স্মৃতিভ্রংশের যাতনা। জটিল এই মনোরোগে আক্রান্তের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তা থেকে সেরে ওঠার কিংবা একে অন্তত নিয়ন্ত্রণে রাখার কী উপায়? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

বয়স যখন ১১-১২, তখন থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। তবে সময়ের পার্থক্যে তখন দেয়ালজুড়ে অ্যালজেব্রার উঁকিঝুঁকি আর জ্যামিতির সংজ্ঞার পাহাড়। ভেতর থেকে জেগে উঠত প্রিয় মুখ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলেরা। সকালের আলো মুখে নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেই দেখা হতো প্রিয় মুখের নীরব দৃষ্টি। মন ভালো করা এ মুখগুলোর ভেতর থেকে কেমন যেন একটা তাড়া আসত কানে। তাতেই দূর হয়ে যেত রাজ্যের ক্লান্তি। ওদিকে পাশের রুমে থাকা প্রিয় আপুটার জীবনে তাকালে পাওয়া যায় অন্য রকম অভিজ্ঞতা। একই ঘরে বেড়ে ওঠা বোনের ভালো লাগে অর্ণবের গান। তাই তার কাছে বিনোদন মানেই গান, আর গান মানেই অর্ণব। শুধু কি তাই? তার বেডরুমজুড়ে প্রিয় শিল্পীর পোস্টার। চার দেয়ালে সেঁটে রাখা পোস্টারে একাকার। গান শুনতে শুনতে পা দুলিয়ে এসব রঙিন ছবির রাজ্যে হারিয়ে যেতেই ভালো লাগে তার। এ ভালো লাগা খাপছাড়া। নেই এর যথাযথ কোনো কারণ! আহা, একটা মানুষ এত গুণী হয় কীভাবে? কীভাবে সম্ভব এত এত সুন্দর গান করা? আপু নিজের ভেতরে একটা তাড়না অনুভব করেন। ভালো কিছু করতে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। ঠিক আপনারই মতো!
কিন্তু দিন যত যায়, বদলাতে থাকেন গানপাগল প্রিয় বোনটি। কিছুই যেন মনে রাখতে পারেন না আর। আপনি এই অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড আপুর মুখোমুখি হন। তিনি নিজেই আপনাকে বলে যাচ্ছেন তার সমস্যার কথা। তার ভাষায়—
 আমি একসঙ্গে অনেক ব্যাপারে মাথা ঘামাতে পছন্দ করি না।
 আমি খুবই অন্যমনস্ক। রিমাইন্ডার ছাড়া কোনো কাজ করতে ভুলে যাই।
 যেকোনো কাজে দেরি করার অভ্যাস আমার।
 মাঝেমধ্যে ভুলভাবে সময়ের হিসাব করি। যেমন, আমার অফিসের গাড়ি আসার কথা সকাল ৯টায়, তাহলে বাসা থেকে বের হলেই গাড়ি, এটা ভেবে আমি রেডি হই ৮টা ৫৫-তে। কিন্তু তখনই মনে হয় আমার ব্যাগ গোছানো হয়নি অথবা ওয়ালেটটা খুঁজে পাচ্ছি না। ফলে গাড়ি মিস করি।
 হয়তো ১০ মিনিটের জন্য গান শুনতে শুরু করলাম। কিন্তু যখনই খেয়াল হলো, ততক্ষণে ৩০ মিনিট পেরিয়ে গেছে! আর অমনি পিছিয়ে পড়লাম আমিও।
 শপিংয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারি, পর্যাপ্ত টাকা নেই সঙ্গে।
 হুট করেই সেলফোনের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যায়, খেয়াল থাকে না!
 ভালো প্রস্তুতির পরও ক্যালকুলেটর অথবা ঘড়ি সঙ্গে নিতে ভুলে যাই।
 যেকোনো ধরনের কাজ বারবার বা একই কাজের পুনরাবৃত্তি অপছন্দ করি। যদিও আমি ওই কাজে পারদর্শী নই।
কে দিল আচরণ ও আবেগের এই লাগাম?
প্রিয় মানুষটির আচরণ ও আবেগে কে দিল লাগাম? ঠিক এই প্রশ্ন করেছিলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হককে। তার মতে, এটি মস্তিষ্কের এমন এক ধরনের সমস্যা, যা মানুষের স্মৃতি, চিন্তা, আচরণ ও আবেগকে প্রভাবিত করে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই স্মৃতিভ্রংশতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁঁকি ও হার বাড়তে থাকে। বিশ্বের নানা দেশের গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৬৫-ঊর্ধ্ব মানুষের মাঝে মাঝারি থেকে গুরুতর স্মৃতিভ্রংশের হার ৫ শতাংশ। আর ৮৫-ঊর্ধ্ব মানুষের মাঝে এ হার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ আলঝেইমারস সোসাইটির এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে এ দেশে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লাখ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে ৯ লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। যেসব রোগের কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে আলঝেইমার। ১৯৭০ সালে জার্মান মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ অ্যালয়েস আলঝেইমারস এ রোগের বর্ণনা করেন। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে এ রোগের নামকরণ হয়।
লক্ষণ ও ক্ষতির রেখাচিত্র
আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে—
 রোগীর স্মৃতিশক্তি এবং স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি লোপ পেতে থাকে।
 রোগী সকালে কী খেয়েছেন, তা দুপুরেই ভুলে যেতে পারেন।
 কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাও মনে করতে পারেন না।
 পরবর্তীকালে সময় ও স্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দেয়; পরিচিত লোকজনকেও চিনতে অসুবিধা হয়।
 চিন্তাশক্তি, বোধ বা ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে, ফলে রোগীর পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্ম করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
 অনেকের আচরণ, আবেগ, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
 কেউ আবার বিষণ্নতা ও সন্দেহবাতিকের মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
এ ছাড়া বিভিন্ন ইমেজিং পরীক্ষায় দেখা গেছে, রোগাক্রান্তদের মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যায়, এর ভেন্ট্রিকল বা প্রকোষ্ঠ বড় হয়, কর্টেস্ক ও হিপোক্যাম্পাস অংশের স্নায়ুকোষের ক্ষয় হতে থাকে।
স্মৃতি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটারের পরিমাণগত তারতম্য বিশেষত অ্যাসিটাইলকোলিনের কর্মক্ষমতায় ঘাটতি দেখা দেয়।
আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় চোখ
কেনটাকি ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা প্রায় ১ হাজার ৬০০ বৃদ্ধ মানুষের ওপর টানা ছয় বছর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, যাদের শরীরে ভিটামিন ডি-এর যথেষ্ট অভাব রয়েছে, তাদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে আলঝেইমারে আক্রান্তের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ। এই ঘাটতির মাত্রা অতিরিক্ত হলে এ সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় শতভাগ। আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘জামা নিউরোলজি’তে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাড়ন্ত শিশুদের শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব স্মৃতিশক্তির স্বাভাবিক উন্মেষ ব্যাহত করে। তাই এই গবেষকেরাও বলছেন, আলঝেইমারের সঙ্গে ভিটামিন ডি-এর যোগসূত্র নিবিড়।
৫০-৫৫ বছর বয়সেও এই অসুখ দেখা দিতে পারে। কারও কারও ক্ষেত্রে তারও আগে। সে ক্ষেত্রে অপুষ্টির কারণ, ভিটামিন ডি, বি-কমপ্লেক্সের অভাব, মাথায় আঘাত বা অ্যাকসিডেন্ট, শরীরে সংক্রমণ যেমন হারপিস, এইচআইভি, ব্রেন টিউমার, জন্মের পরই কোনো সংক্রমণ বা ভাইরাল এনসেফেলাইটিস, হরমোনাল ডেফিশিয়েন্সি বা থাইরয়েড কম অথবা বয়সকালে স্ট্রোকের ফলেও ডিমেনশিয়া দেখা দিতে পারে।
সমাধানের সহজ পাঠ
দ্রুত রোগ শনাক্ত করা আলঝেইমার চিকিৎসার জন্য জরুরি। এ রোগের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য রোগীর অবনতির গতি ধীর করা। কিন্তু রোগীকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কার্যকর কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে রোগীর উপসর্গ ও লক্ষণভেদে কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো উপশম বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর কিছু ওষুধ রয়েছে। আশার কথা, অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত ওষুধ রোগীর স্মৃতিশক্তি কিছুটা ধরে রাখতে সহায়তা করে। ডাক্তারের পরামর্শে ওসব ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। এ ছাড়া রোগীর আনুষঙ্গিক অন্যান্য মানসিক উপসর্গ যেমন অনিদ্রা, হতাশা প্রভৃতির জন্য চিকিৎসকেরা কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাধারণত বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে এদের আনুষঙ্গিক আরও শারীরিক রোগ থাকে, যেগুলোর চিকিৎসা আলঝেইমার রোগের কারণে ব্যাহত হতে পারে। সে কারণে এসব রোগীর বিশেষ যত্ন ও সতর্কতা প্রয়োজন। রোগীর চারপাশের পরিবেশ তার উপযোগী করে গড়ে তোলা চাই। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চাই সবার আগে। রোগীকে একা কোথাও যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। তার পকেটে সব সময় নাম, ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বরসংবলিত একটি কার্ড বা কাগজ রাখা ভালো, যেন কোনো কারণে তিনি হারিয়ে গেলে কাজে লাগে।
এ ছাড়া রুটিন ও চেকলিস্ট ভুলে যাওয়ার অভ্যাস রোধে রুটিন অনুসরণ করা যেতে পারে। নিয়মিত আপনার মোবাইলে চার্জ দিন। মোবাইল কিংবা হাতঘড়ির টাইমার ওপেন করে কাজ শুরু করুন। এতে ১০ মিনিটকে আধা ঘণ্টা মনে হবে না! একটি নির্ধারিত জায়গায় আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখুন। যেন বাসা থেকে বের হওয়ার পথে সহজেই খুঁজে পান। যে কাজে আপনার দক্ষতা কম, সেগুলোর সমাধানে অভিজ্ঞ কারও সাহায্য নিন। তবে সব সময় সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে। অন্যদিকে, ক্ষেত্রবিশেষে আপনি নিজেও অন্য কাউকে সাহায্য করতে পারেন। ‘নেভার বি লেইট অ্যাগেইন’ বইটি পড়তে পারেন। এই বই থেকে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। এ ছাড়া ভুলে যাওয়ার অভ্যাস রোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে—গুরুত্বপূর্ণ কাজ নির্দিষ্ট সাইটে সংরক্ষণ করে রাখা। সামনের জরুরি কাজ ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখা। যে কাজ খুব জরুরি, সেগুলোর জন্য ‘আইওয়ান্টসেন্ডি’ ব্যবহার করুন, ফলে সময়মতো ই-মেইল পেয়ে যাবেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমার রোগীকে বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে দিলে মানসিক অবস্থার অনেকটা উন্নতি ঘটে। তাই একটু বয়স বাড়লে নিয়মিত বেলা ১১ থেকে ২টার মধ্যে সূর্যরশ্মি গায়ে লাগান। রোদ বা সূর্যের আলো গায়ে লাগালে তা ব্রেনের ফ্রি র‌্যাডিক্যালসকে বিনষ্ট করে ব্রেন স্নায়ুকোষ সচল রেখে আলঝেইমার প্রতিরোধ করে।
দূর হোক স্মৃতিভ্রমের যাতনা। জীবন হয়ে উঠুক আরও রঙিন এবং ভালোবাসাময়, শরতের শুভ্রতার মতো!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top