skip to Main Content

যাপনচিত্র I দূর পাহাড়ের টানে

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা। গণমাধ্যমে সরব উপস্থিতি এই আইনজীবীকে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। জানা যাক তার একান্ত জীবনের গল্প

‘ওঠো, উদ্যমের সঙ্গে দিন শুরু করো। আর প্রতিদিন আগত সুযোগকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে শেখো’—যেন এই মন্ত্রে নিজের দিনটি শুরু করেন ব্যারিস্টার মিতি সানজানা। ভোর ছয়টার আগেই বিছানা ছাড়েন। দুই সন্তানকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে স্কুলে পাঠানো তার প্রথম কাজ। এরপর ব্ল্যাক কফি হাতে শোনেন শ্রুতিমধুর কোনো গান। সব ধরনের গানের প্রতি টান থাকলেও রবীন্দ্রসংগীত তার মনে বিশেষ দোলা দিয়ে যায়। ছোটবেলায় বাবা-মাকে সকালে গান শুনতে দেখে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এরপর চেষ্টা করেন হেলদি ব্রেকফাস্ট করার, যেন সারা দিন উদ্যম ধরে রাখতে পারেন। ব্রেকফাস্টের মেনুতে থাকে মিল্ক, ওটস, ফলের জুস ও ডিম। মাঝেমধ্যে পিনাট বাটার ও লাল আটার রুটিও রাখেন সকালের খাদ্যতালিকায়। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য একটু শারীরিক কসরত করতেও ভোলেন না এই আইনজীবী। তবে ওয়ার্কআউট বাসায় করবেন নাকি জিমে, সেটা নির্ভর করে ওই দিনের ব্যস্ততার ওপর। সাধারণত নানা ধরনের কার্ডিও এক্সারসাইজ, যেমন ট্রেডমিল, ক্রসট্রেইনার করেন তিনি। সময় পেলে ধানমন্ডি লেকে ৪০ মিনিট হাঁটেন। অবশ্য শীতকালেই বাইরে হাঁটতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য তার।
সকাল ১০টার দিকে কোর্টের কাজ শুরু হয় ব্যারিস্টার মিতির। কোর্টে কাজ না থাকলে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ভিত্তিতে চেম্বারে বসেন। আইনজীবী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন মানবাধিকার ও অধিকারকর্মী। ফলে মিডিয়ায় তার উপস্থিতি সরব। এত কাজের ভারসাম্য রাখতে আগে থেকেই ক্যালেন্ডার মেইনটেইন করেন। আর দৈনন্দিন ব্যস্ততা শেষে যতটুকু সময় পান, সবটুকুই দিতে চান নিজের পরিবার এবং দুই সন্তান অরিত্র ও অনাহিতাকে। ওদের খাওয়াদাওয়া, হোমওয়ার্ক…সব নিবিড়ভাবে খেয়াল রাখেন।
সময় পেলে ঘুরতেও ভালো লাগে মিতির। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। সমুদ্রের তুলনায় পাহাড় তাকে বেশি টানে। বিলেতে পড়াশোনা করায় জায়গাটির প্রতি আলাদা ভালো লাগা কাজ করে তার। এই বছরের জুনেই সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, স্লোভাকিয়া, চেক রিপাবলিক ও লিচেনস্টাইনে ঘুরে এসেছেন। লিচেনস্টাইনের কথা তিনি আলাদাভাবে বললেন, কারণ এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম দেশ। দেশটি এক পরাবাস্তব অনুভূতি এঁকে দিয়েছে এই আইনজীবীর মনে। সেখানকার এক রেস্তোরাঁয় ঠিক তাদের পাশেই বসেছিলেন সে দেশের প্রিন্স ও প্রিন্সেস। এদিকে সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য মিতিকে আলাদাভাবে মোহিত করে। ইউরোপের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস…সবকিছুই মুগ্ধ করে তাকে। তবে এ পর্যন্ত ঘুরে আসা সবচেয়ে পছন্দের শহর স্পেনের বার্সেলোনা। স্বামী ব্যারিস্টার ওমর এইচ খান ও তার রয়েছে আর্ট কালেকশনের ঝোঁক। কামরুল হাসান, রফিকুন নবী, জয়নুল আবেদিন, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, শাহাবুদ্দিন আহমেদসহ দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম রয়েছে তাদের সংগ্রহে।
দুপুরে বাসায় ফিরে সন্তানদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ করেন ব্যারিস্টার মিতি। খাবারের মেনুতে দেশি স্টাইলে রান্না করা ডাল ও সবজি থাকে নিয়মিত; সঙ্গে মাছ অথবা মাংস। এই আইনজীবীর জীবন বেশ পরিবারকেন্দ্রিক। বন্ধুদের সান্নিধ্য ভালো লাগলেও সন্তানদের কাছ থেকে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে পারেন না। অবশ্য বাইরে থেকে বন্ধুবান্ধব এলে চেষ্টা করেন তাদের সময় দেওয়ার। তবে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কিংবা ভ্রমণ করা তেমন একটা হয় না। আর হলেও পরিবারও সঙ্গে থাকা চাই তার।
মিতি সানজানার বাসা বেশ ছিমছাম ও পরিপাটি। দেয়ালজুড়ে বিখ্যাত সব পেইন্টিং। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের ইনটেরিয়র ও ফার্নিচার তার বেশ পছন্দ। সেই ছাপ বাসার পরতে পরতে। সবুজের সান্নিধ্য পেতে বারান্দায় রেখেছেন গাছগাছালি। একটু স্মৃতিকাতর হওয়ায় পুরোনো জিনিস ফেলে না দিয়ে সযত্নে রেখে দিতে ভালোবাসেন তিনি।
পরিবারে বাবা আর বাইরে রবীন্দ্রনাথ তার সবচেয়ে পছন্দের ব্যক্তিত্ব। পরতে পছন্দ করেন দেশীয় শাড়ি। সাজগোজে থাকে সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা। কপালে টিপ, চুলে বেলি ফুলের মালা তাকে খুব টানে। সবচেয়ে প্রিয় পোশাক সুতি জামদানি। পোশাকের ক্ষেত্রে কমফোর্টকে দেন অগ্রাধিকার। শীতের সময় একটু স্টাইলিস্ট ড্রেসআপ করেন তিনি। ক্ষেত্রবিশেষে ওয়েস্টার্ন চাপান শরীরে। পছন্দের রং যেকোনো ধরনের নীল, কালো ও লাল। প্রিয় অ্যাকসেসরিজ ব্যাগ ও ঘড়ি। পাট, চটের ব্যাগ থেকে শুরু বিদেশি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের ব্যাগ রয়েছে তার। ঘড়ির কালেকশনও নেহাত কম নয়। চুল ও ত্বক নিয়ে খুব একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন না। লম্বা চুলই পছন্দ। চুলের যত্নে আয়ুর্বেদিক বিভিন্ন উপাদান যেমন উপটান, ফেসপেক, ফ্রুট ফ্লেভারের হারবাল প্রডাক্ট, মেহেদি, নারকেল তেল, অলিভ অয়েল ব্যবহার করেন। ত্বক স্পর্শকাতর হওয়ায় তিনি ব্যবহার করেন ভালো ব্র্যান্ডের উপযুক্ত মেকআপ।
আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি পেলেও ছোটবেলায় এ পেশায় আসার কোনো স্বপ্ন ছিল না। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়ায় গায়িকা কিংবা মডেল হতে চাইতেন। বিলেতে যখন আইন বিষয়ে পড়তে যান, তখন তার জীবনযাপন ছিল এখনকার চেয়ে ভিন্ন। সেখানকার সংগ্রামী জীবন থেকে শিখেছেন অনেক। তবে সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার ছিল, কারও ওপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে জীবন ধারণ করা। বহুজাতিক সংস্কৃতি থেকে পেয়েছেন সারা বিশ্বের নানান দেশের বন্ধুবান্ধব, যাদের কাছ থেকে শিখেছেন অনেক।
‘ফ্যাশন হলো মুখোশ আর স্টাইল হচ্ছে মুখশ্রী’—কবিগুরুর এই মতধারার সঙ্গে একমত মিতি। বললেন, ফ্যাশন একটু হলেও মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য আড়াল করে। অন্যদিকে স্টাইল মানুষের ব্যক্তিত্ব বা প্রকৃত সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই ট্রেন্ডে নিজেকে ভাসিয়ে দেন না তিনি। তবে ট্রেন্ডি যেসব স্টাইল তাকে মানাবে বলে মনে করেন, তা ফলো করতে দ্বিধা করেন না। একটু পুরোনো ফ্যাশন স্টাইলই অবশ্য তাকে আকর্ষণ করে বেশি। পছন্দের স্টাইল আইকন সুচিত্রা সেন ও মধুবালা। পারফিউমও বেশ পছন্দ তার। পছন্দের পারফিউম ল্যানকমের লা ভিয়েবল, গুচির এনভি মি ও গিলটি।
রান্নার ক্ষেত্রে বেশ শৌখিন মিতি সানজানা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় কুকিং স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলেন। দেশীয় মাছ রান্না থেকে শুরু করে কেক, পিৎজা—সবই বানাতে পারেন। ইন্টারনেট থেকে নানান রেসিপি দেখে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে উপাদান এনে রান্না করেন কখনো কখনো। ভোজনরসিক হওয়ায় চেষ্টা করেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারার। হোক সেটি সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো ভেজিটারিয়ান রেস্তোরাঁ কিংবা স্লোভাকিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বোম শেল্টারের ভেতর অবস্থিত কোনো ঐতিহাসিক রেস্তোরাঁ।
সোশ্যাল মিডিয়া বলতে মিতি শুধু ফেসবুক ব্যবহার করেন। পাবলিক প্রোফাইল হওয়ার ফলে সেখানে বন্ধুতালিকা ও ফলোয়ারের সংখ্যা বেশ বড়। ফলে একটি বড় সময় সেখানে চলে যায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। এ ব্যাপারে একটু সময় সংকোচনের পক্ষপাতী তিনি। অবসরে নেটফ্লিক্সে বিভিন্ন রোমান্টিক, থ্রিলার ঘরানার টিভি সিরিজ ও সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন। টম হ্যাঙ্কসের প্রায় সব সিনেমাই তার প্রিয়। অন্যদিকে প্রিয় গায়কের তালিকায় রয়েছে এলভিস প্রিসলি, বব ডিলান, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, জন ডেনভার প্রমুখের নাম।
ব্যারিস্টার মিতি সানজানা জানান, সফল জীবনযাপনের চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ জীবন যাপন করতে চান তিনি। তার কাজে সমাজ, প্রকৃতি, জীবন, পৃথিবী উপকৃত হলে সেই জীবনকে সার্থক মনে করবেন। অন্যদিকে, আইন পেশায় আসতে আগ্রহীদের প্রতি তার পরামর্শ, চ্যালেঞ্জিং এই পেশায় হওয়া চাই বেশ সিরিয়াস। শ্রম, প্রতিজ্ঞা ও ধারাবাহিকতার কোনো বিকল্প নেই এখানে।
 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: রনি বাউল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top