ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ইন্ডিয়া কতুর উইক
বছর দুয়েক বাদে পুরোনো রূপে জমকালো ফ্যাশন প্রদর্শনী। পর্দায় ডিজিটাল শোকেসিং নয়, এবার সরাসরি উপভোগের সুযোগ মিলেছে। উদযাপিত হয়েছে পনেরোতে পদার্পণের পর্ব। লিখেছেন সারাহ্ রুশমিতা
হয়ে গেল ইন্ডিয়া কতুর উইক। আয়োজন করেছিল ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এফডিআই)। নয়াদিল্লির তাজ প্যালেসে জায়গা করে নিয়েছিল ফ্যাশনিস্তাদের প্রিয় এই শো। ২২ থেকে ৩১ জুলাই এই অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখে ভারতীয় ফ্যাশন নিয়ে আগ্রহীদের। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। কী হয় কী হয় উত্তেজনায় মেতে উঠেছিলেন ইন্ডিয়াসহ ফ্যাশন জগতের হাজারো ফ্যাশনিস্তা।
এবার ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার ১৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। তা মাথায় রেখে সাজানো হয় পুরো আয়োজন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ফ্যাশন-সচেতনদের চাহিদা নিয়ে ভেবে তৈরি হয় তালিকা।
করোনাকালে টানা দুই বছর ইন্ডিয়া কতুর উইকের ডিজিটাল শোকেসিং দেখেই মন ভরাতে হয়েছিল ফ্যাশনবিশ্বের। দীর্ঘ বিরতির পর এ বছর পুরোনো রূপ ফিরে পেয়েছে জমকালো এই আয়োজন। সব মিলিয়ে উপলক্ষ তাই একটু বেশিই বিশেষ।
আয়োজনের প্রথম দিন ২২ জুলাই প্রদর্শিত হয় নন্দিত নকশাকার তরুণ তাহিলিয়ানির পোশাক। টাইটেল, ‘দ্য পেইন্টারলি ড্রিম’। রঙিন লেহেঙ্গা, লং জ্যাকেটে লেহেঙ্গার সঙ্গে লেয়ারিং আর লাল সিদুর রঙা শাড়ি। এমব্রয়ডারির ম্যাজিক মাধুর্য ছড়িয়েছে। জারকানা, পিচওয়াই, কাশিদার কারুকার্য দেখা গেছে। জুয়েলারি পার্টনার ছিল গোয়েনকা ইন্ডিয়া।
পরদিন র্যাম্প মাতিয়েছেন রাহুল মিশ্রা। তিনি টুডি এবং থ্রিডি এমব্রয়ডারি ব্যবহার করেছিলেন। কালেকশনের নাম ‘ট্রি অব লাইফ’। এর সঙ্গে অর্চনা আগারওয়ালের টাইমলেস জুয়েলারি শোভা বাড়িয়েছে কালেকশনের। ২৪ জুলাই দেখা মেলে নয়াদিল্লির নকশাকার দুই ভাইয়ের ব্র্যান্ড জে জে ভালায়ার কালেকশনের। টাইটেল ছিল ‘আলমা’। লাক্সারিয়াস ফ্যাব্রিক, এলিগ্যান্ট ডিটেইলস আর এমব্রয়ডারির ঐকতানে তৈরি হয়েছিল একেকটি পোশাক।
২৬ জুলাই র্যাম্পে মডেলরা হেঁটে বেড়িয়েছেন ডিজাইনার ভারুনের নকশা করা পোশাক পরে। ‘নিউ লিফ’ শিরোনামের পোশাক প্রদর্শন করেছেন তিনি। হ্যান্ড এমব্রয়ডারির মসৃণ নকশায় পোশাকের অলংকরণ ছিল নজরকাড়া। সেগাল জুয়েলারির গয়না ছিল এর সঙ্গে। আপসাইকেলড এমব্রয়ডারির সঙ্গে অ্যাপ্লিকের দারুণ মিশেল নজর কেড়ে নিয়েছে এই আয়োজনে।
২৭ জুলাই দেখা মেলে দুটি ব্র্যান্ডের কালেকশনের। আনজু মোদির সঙ্গে জোড় বেঁধেছিল জুয়েলারি শ্রী পারামানি জুয়েলস। অন্যদিকে রোহিত গান্ধী আর রাহুল খান্নার জুটি তো বরাবরই হিট। আনজু মোদি তার কালেকশনের নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য রোড লেস ট্রাভেলড’। অভিনেত্রী অদিতি রাও হায়দারি শো-স্টপার ছিলেন এই কালেকশনের। রোহিত গান্ধী ও রাহুল খান্নার দুর্দান্ত কালেকশনের নাম ছিল ‘ফিবোনাক্কি’। বলিউড তারকা মালাইকা অরোরা ছিলেন এই কালেকশনের শো-স্টপার। ইভনিং ওয়্যার নিয়ে কাজ হয়েছে এই কালেকশনে। ড্রামাটিক ফ্যাব্রিক ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে একেকটি পোশাক। ডিজাইনার প্যাটার্ন নিয়ে বেশ কাজ করেছেন এই কালেকশনে। ফলে প্রতিটি পোশাকের মেকিং লাইন এবং ডিভিশনগুলো দেখা সম্ভব হয়েছে।
২৮ জুলাই ডিজাইনার ডলি জে তার মিরাকি কালেকশন নিয়ে আসেন। শিল্পা শেঠি ছিলেন এই কালেকশনের শো-স্টপার। সোনালি রঙের ঝলকানি দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে এই কালেকশনের প্রদর্শনে। পোশাকের টেক্সচারও ছিল নজরকাড়া। এরপরে আসেন সুনীত ভারমা। তার কালেকশনের নাম ছিল ‘সিতারা’। চিরায়ত মোটিফ এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টওয়ার্কের মিশেলে সম্পন্ন করা হয়েছিল পোশাকগুলো।
২৯ জুলাই সিদ্ধার্থ টেইলর তার আয়োজন প্রদর্শন করেন সবার সামনে। কালেকশন টাইটেল ছিল ‘শান সুই’। অভিনেতা ফারহান আখতার ছিলেন এই কালেকশনের শো-স্টপার। চায়নিজ আর্ট জনরা ‘ল্যান্ডস্কেপ’ থেকে নেওয়া হয়েছে শিরোনামটি।
এরপরে লোটাস মেকআপের অ্যাসোসিয়েশনে প্রদর্শিত হয় ডিজাইনার ফাল্গুনী শেইনের কালেকশন। তার নকশার পোশাকের টাইটেল ছিল ‘লাভ ফরেভার’। ফ্রেঞ্চ ক্যাপিটাল ভি যা ভি-এর সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে এই কালেকশন। জুয়েলারি পার্টনার ছিল অর্চনা আগারওয়ালের টাইমলেস জুয়েলারি। শো-স্টপার ছিলেন সারাহ আলী খান।
৩০ জুলাই প্রদর্শিত হয় দুজন নকশাকারের পোশাক। কুনাল রাওয়ালের কালেকশনের নাম ছিল ‘ডিয়ার মেন’। এমব্রয়ডারি ব্যবহারে সম্পন্ন হয়েছে অলংকরণ। অর্জুন কাপুর ছিলেন এই কালেকশনের শো-স্টপার। এদিন ডিজাইনার অমিত আগারওয়াল প্রদর্শন করেন তার আয়োজন ‘পেডেসিস’।
শেষ দিন ৩১ জুলাই মঞ্চ মাতিয়েছেন জনপ্রিয় ডিজাইনার অনামিকা খান্না। তিনি শোর পর্দা নামান। তার কালেকশনের নাম ‘দ্য কতুর কালেকশন: অ্যান এক্সপেরিমেন্ট’। ট্র্যাডিশন আর আধুনিকায়নের মিশেল ফুটে উঠেছিল এই কালেকশনে। অভিনেতা রাজ কুমার রাও ব্র্যান্ডের শো-স্টপার হিসেবে র্যাম্পে হেঁটেছেন।
এবারের আয়োজনে ব্রাইডাল কালেকশন নিয়েও অনেক কাজ করেছেন ডিজাইনাররা। জমকালো উৎসবমুখর রঙিন পোশাকে ক্যাটওয়াক করেছেন মডেল ও সেলিব্রিটিরা। এবারে লেয়ারিং নিয়ে নজরকাড়া কাজ করেছেন ডিজাইনাররা। রাহুল মিশ্রা তার কালেকশনে দেখিয়েছেন শাড়ির ওপরে জ্যাকেটের ব্যবহার। শাড়ির সঙ্গে একই রং এবং ফ্যাব্রিকের জ্যাকেটে লেয়ারিং করেছিলেন তিনি। জ্যাকেটের দৈর্ঘ্য ছিল হাঁটু ছাড়িয়ে। তরুণ তাহিলিয়ানি শাড়ির সঙ্গে লেয়ারিংয়ে ব্যবহার করেছিলেন শর্ট জ্যাকেট। ভিন্ন রং নয়। একটি রং ব্যবহারেই তৈরি করেছেন শাড়ি ও জ্যাকেট।
জে জে ভালায়া ব্র্যান্ডের দুই ভালায়াও লেয়ারিংয়ে মজেছেন। মনোক্রোমে সম্পন্ন হয়েছে তাদের নকশা। জ্যামিতিক নকশার শাড়ি আর জ্যাকেট জুড়ে ঝকমকে কারুকাজ উৎসবের আভাস দিয়েছে প্রতিটি পোশাকে। বুক খোলা জ্যাকেট আর শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজও ছিল বেশ নকশাদার। ব্লাউজকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন বেশ কয়েকজন ডিজাইনার। রাহুল মিশ্রা, তরুণ তাহিলিয়ানিকে দেখা গেছে ব্লাউজের নকশাকে দারুণভাবে উপস্থাপন করতে। করসেট আর ডিপ নেকলাইনের ক্রপ টপ ব্লাউজের সঙ্গে লেহেঙ্গা আর টপস পরে হাজির হয়েছিলেন ফ্যাশন ডিভারা।
রঙের ক্ষেত্রে দেখা গেছে লালের প্রাধান্য। নানাভাবে এই রং উপস্থাপিত হয়েছে। জে জে ভালায়ার কালেকশন আলমাতে দেখা গেছে এর দারুণ বাহার। জানা যায়, এই অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছেন স্পেন থেকে।
হেরিটেজ ক্র্যাফটম্যানশিপ ট্রেন্ড এবারের আয়োজনে জনপ্রিয় একটি ধারা হিসেবে সামনে এসেছে। জে জে ভালায়া, তরুণ তাহিলিয়ানি, আনজু মোদি। প্যারিস ওত কতুর কালেকশন থেকে হ্যান্ড পিকড কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছিলেন তাদের ড্রেপিং স্টাইলের লেহেঙ্গার জন্য। জায়গা করে নিয়েছিল সিমলেস সারফেস অলংকরণ কৌশল। চিকনকারি, পিচওয়াই, কাশিদার কাজ। ডিজাইনার ভালায়া কিছুদিন আগে ৩০ বছর পূর্তি করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে এনেছিলেন জারদৌসি অলংকরণের মাধুর্য। রোহিত গান্ধী আর রাহুল খান্না কাটওয়ার্ক, ক্রিস্টাল আর ট্যাসেলের অন্যতর উপস্থাপনা করেছিলেন ফিবোনাক্কি সিরিজে।
ওয়েস্ট ব্যান্ড ট্রেন্ড এসেছে লেহেঙ্গা আর শাড়ির অনুষঙ্গ হয়ে। জে জে ভালায়া, তরুণ তাহিলিয়ানি কোমরবন্ধের ফ্যাশনকে পুনরায় সতেজ করে তুলেছেন। জালি স্টাইল, লেদার বাকল বেল্ট, ক্রিস্টালে তৈরি ওয়েস্ট ব্যান্ড দেখা গেছে র্যাম্পে। এ সিজনে বিয়ের কেনাকাটায় ওয়েস্ট বেল্টের চাহিদা থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।
অনামিকা খান্না, রোহিত গান্ধী, ফাল্গুনী শেন, সিদ্ধার্থ, সুনীত ভারমার কালেকশনে দেখা গেছে ঝলমলে অলংকরণ। সিকুইন অলংকরণে তৈরি লেহেঙ্গা, শাড়িতে আলোকিত হয়েছিল মঞ্চ।
ব্রাইডাল গাউনের নজরকাড়া আয়োজন দেখা গেছে র্যাম্পে। ডিজাইনার রোহিত খান্না, রাহুল গান্ধী, অনামিকা খান্না, ফাল্গুনী শেন কাজ করেছেন জমকালো ব্রাইডাল লেহেঙ্গা নিয়ে। রেড কার্পেট মাতিয়ে তোলার মতো গাউন দেখা গেছে। শাড়ি গাউনের এক্সক্লুসিভ ডিজাইন নিয়ে র্যাম্প মাতিয়েছেন অনামিকা খান্না ও ফাল্গুনী শেন। এই ডিজাইনার ডুওর তৈরি কালেকশনটির নাম ‘অ্যান এক্সপেরিমেন্ট অ্যান্ড লাভ ফরেভার’।
ছবি: ইন্টারনেট