টেকসহি I আয়ত্তে অপচয়
ফরমায়েশি ফ্যাশনতত্ত্বের কল্যাণে। মেড টু অর্ডারের এ ধারা জায়গা করে নিচ্ছে মেইনস্ট্রিম ট্রেন্ডে
ফাস্ট ফ্যাশনে ফেঁসেছে ফ্যাশনবিশ্ব। চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত কেনাকাটায় এখনো অভ্যস্ত বেশির ভাগ মানুষ। এ ধারা চলছে কয়েক যুগ ধরেই। ফলে ফ্যাশন-বর্জ্য দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাদার আর্থ। দূষণে সামলে উঠতে পারছে না প্রিয় প্রকৃতি। ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রতিনিয়ত নতুন নকশার পোশাক তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে ভলিউমটাও বেশি হয়ে থাকে। মূল উদ্দেশ্য বেশি ক্রেতার কাছে পণ্য নিয়ে পৌঁছে যাওয়া। চাহিদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য নিয়ে ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো কাজ করে। ওভার প্রডাকশন হয় বেশির ভাগ সিজনেই। এই অতিরিক্ত পণ্য মূলত ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা নয়; বরং নিজস্ব পণ্য নিয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। ক্রেতা আকর্ষণ করার জন্য ডিসকাউন্টসহ নানা অফার দেওয়াও ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর মার্কেটিং কৌশল; যা অবিক্রীত পণ্যের বিকিকিনি খানিকটা হলেও বাড়ায়। প্রয়োজন না থাকলেও কিছু মানুষ ক্রেতায় পরিণত হয়। তাদের আলমিরাতে অতিরিক্ত ফ্যাশনপণ্য যোগ হয়। পরবর্তী সময়ে যা ফ্যাশন-বর্জ্যে পরিণত হয়।
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয় লরেন ব্র্যাভোর বই, ‘হাউ টু ব্রেকআপ উইথ ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই তখন থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রভাবক ফ্যাশন-বর্জ্য নিয়ে ভাবছেন বোদ্ধারা। ম্যাকেঞ্জির ‘দ্য স্টেট অব ফ্যাশন’ থেকে জানা যায়, প্রতি ৫ জন ক্রেতার ৩ জন পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশের লাভ-ক্ষতির হিসাব করেন।
ফাস্ট ফ্যাশনের ঠিক বিপরীতের ফ্যাশন থিওরি নিয়ে কাজ হচ্ছে ফ্যাশন বিশ্বে। মেড টু অর্ডার নামে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে ফ্যাশন-সচেতনদের মাঝে। এ ধারায় পোশাক তৈরির সিদ্ধান্ত নেবেন ক্রেতারা। চাহিদা বুঝে ব্র্যান্ডগুলো তৈরি করবে পোশাক। পরিকল্পনা কিংবা ফোরকাস্টিংয়ের ফলে পোশাক তৈরি হবে না; শুধু ক্রেতা তার চাহিদা জানান দিলেই তৈরি হবে। তৈরি পোশাক অর্থাৎ রেডি টু ওয়্যারের সঙ্গে মেড টু অর্ডার ধারণার মূল পার্থক্য এটাই। এর বাইরেও এই নতুন ধারণার কিছু নিজস্ব বিষয় রয়েছে। এই ধারায় পোশাক তৈরি করতে দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তা হাতে পাবেন না ক্রেতা, সময় দিতে হবে তৈরি করার জন্য।
মেড টু অর্ডারে মূলত পরিবেশের প্রতি মমত্ববোধের পরিচয় মেলে। এ ক্ষেত্রে স্টক রাখা সম্ভব না হওয়ায় কোনো কিছুর অতিরিক্ত ব্যবহার হয় না। উৎপাদনের গতি ধীর হয়। চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য তৈরি না করার কারণে ফ্যাশন-বর্জ্যের পরিমাণও কমে।
মেড টু অর্ডার ধারায় প্রতিটি পোশাক আলাদা ব্যক্তির জন্য তৈরি করা হয়। তাই প্রত্যেকে সুযোগ পান নিজের চাহিদামতো পোশাক বানিয়ে নেওয়ার। প্লাস সাইজ বডি যাদের, তারা ব্র্যান্ডের পোশাক কেনার ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যা অনুভব করেন। মেড টু অর্ডারের ক্ষেত্রে নিজের মতো তৈরি করে নেওয়া যায় বলে রেডি টু ওয়্যারের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হন বিশেষ শ্রেণির এ ক্রেতারা।
এই ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ক্রেতার মনস্তত্ত্ব। ক্রেতা এখানে পোশাকের প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকেন। ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়া থেকে নিজের মাপমতো তৈরি—প্রতিটি বিষয়েই নিজেকে খুঁজে পান ক্রেতা। এ কারণে পোশাকটি সংরক্ষণের প্রতি আগ্রহ থাকেন। পোশাকের ফ্যাব্রিকের গুণগত মান বিবেচনায় কোন ফ্যাব্রিক কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকে। সে অনুযায়ী পোশাকটি সংরক্ষণ করার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন রেডি টু ওয়্যার ধারণায় আগ্রহী ক্রেতারা। ফলে পোশাকের স্থায়িত্ব হয় বেশি। ফ্যাশন-বর্জ্যের পরিমাণ কমে। পরিবেশের ক্ষতির দিকেও সীমারেখা টানা সম্ভব হয়।
আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে বেশ কিছু ব্র্যান্ডকে দেখা যাচ্ছে মেড টু অর্ডার ধারায় কাজ করতে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড চেলসি জোয়ান একটি ব্রিটিশ স্লো ফ্যাশন লেবেল। ২০২০ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে এই ব্র্যান্ড। এর আরও একটি বিশেষত্ব আছে। নতুনত্বকে বরণ করতে গিয়ে পুরোনোকে ভুলে যায়নি চেলসি; বরং চিরায়ত ফ্যাশনধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নকশা করেছে মেড টু অর্ডার ধারার পোশাকগুলো। অ্যানা ব্লাউজ নামের ডিজাইনটি এই ব্র্যান্ডের এমনই এক উদাহরণ। চেলসি জোয়ান ফ্রিলের ব্যবহার করে থাকে পোশাকে। সঙ্গে গুরুত্ব পায় পোশাকের সাইজ। পোশাক তৈরির প্রতিটি উপাদান সংগ্রহ করা হয় যত্নের সঙ্গে। পরিবেশের সুরক্ষার দিকে নজর রেখে।
মেড টু অর্ডার থিওরির আরেকটি ব্র্যান্ড চেলসা ব্রাভো। মূলত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ড। আর্দি টোনের পোশাক তৈরি করে থাকে। হ্যান্ডপেইন্টের ইলাস্ট্রেশনকে অলংকৃত করে। ওয়্যারেবল আর্ট তৈরি করে এই ব্র্যান্ড। পোশাককে ক্যানভাসের মতো ব্যবহার করে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয় বিমূর্ত নকশা।
নিউজিল্যান্ডভিত্তিক মেড টু অর্ডার ফ্যাশন লেবেল ‘এসে’। রঙের ক্ষেত্রে আর্দি টোনের ব্যবহারই বেশি এই ব্র্যান্ডের। তিনটি লো ইম্প্যাক্ট ফ্যাব্রিকের ব্যবহার করে থাকে। অরগানিক কটন, টেনসেল ও লিনেনে পোশাকগুলো তৈরি করা হয়। প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রেও সচেতনতা চোখে পড়ার মতো। প্লাস্টিক ফ্রি প্যাকেজিং ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া এথিক্যাল লেবার প্র্যাকটিস করে এসে কর্তৃপক্ষ।
ইন্ডিয়ান মেড টু অর্ডার ব্র্যান্ড ডুডলেজ। এই ব্র্যান্ড তৈরি করে নিত্যদিনের ব্যবহার উপযোগী পোশাক। পুরোনো পোশাক থেকে ফ্যাব্রিক নিয়ে তৈরি করে নতুন পোশাক। ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে তৈরি হয় এই ব্র্যান্ডের পোশাকের ফ্যাব্রিক। ধরনীর প্রতি ভালোবাসা থেকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নেয় এই ব্র্যান্ড। পোশাক তৈরি থেকে প্যাকেজিং—সব ক্ষেত্রেই এই একই বিষয় মাথায় রাখা হয়। ব্র্যান্ডটি জিরো ওয়েস্ট থিওরিতে বিশ্বাসী। পোশাক তৈরি উপলক্ষে যেন কোনো ফ্যাশন-বর্জ্য তৈরি না হয়, সেদিনে রাখা হয় সতর্ক নজর।
রোমানিয়ান ফ্যাশন লেবেল লাউড বডিস। এটিও কাজ করে মেড টু অর্ডার ঘরানার পোশাক তৈরির জন্য। প্যাট্রিসিয়া লুইজা বিলাজ এই ব্র্যান্ড শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সব মাপেই মানুষ চায় ফ্যাশনেবল পোশাক পরতে। হোক সে সাইজ জিরো কিংবা প্লাস সাইজ। পোশাকের ফ্যাব্রিক রাঙিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নন-টক্সিক ডাই ব্যবহার করা হয় এ ব্র্যান্ডে।
অস্ট্রেলিয়ার মেড টু অর্ডার ধারার ফ্যাশন লেবেল লুসিন্ডা বাবি। মূলত মেলবোর্ন শহরকে কেন্দ্র করে এ ব্র্যান্ড কাজ করে। এরা পোশাক তৈরির সব উপাদান লোকাল মার্কেট থেকে সংগ্রহ করে। রিসাইকেল ধারাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে ব্র্যান্ডটি।
শুধু পোশাকের ক্ষেত্রেই যে এই থিওরি ব্যবহৃত হয়, মোটেই তা নয়। এই ধারণা ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে জুতা। হেলেন কিরকাম স্টুডিও মেড টু অর্ডার ধারণাকে কেন্দ্র করে স্নিকার তৈরি করছে। এখানে আপসাইকেল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। লো ওয়েস্ট প্রসেসের বিষয়টি বিবেচনা করে। অটাম আডেগবো ব্র্যান্ডটিও তৈরি করে হ্যান্ড ক্রাফটেড ফুটওয়্যার।
সারাহ্ রুশমিতা
ছবি: রিমা নাজের সৌজন্যে