ফিচার I স্মৃতির সুরে
একসময় বাংলা ছিল অখণ্ড। ইতিহাসের নানা বাঁকবদলে মাঝখানে বসেছে কাঁটাতারের বেড়া। তবু দুই পারের মানুষ কথা বলে বাংলায়। গানও গায় বাংলায়। বাংলাদেশের ঢাকা ও ভারতের কলকাতার এই প্রজন্মের দুই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীর পূজার স্মৃতি ঘিরে এই আয়োজন
সময়ের বাঁক
শিবু কুমার শীল
ভোকাল, মেঘদল; বাংলাদেশ
ছোটবেলা থেকেই পুরান ঢাকার নারিন্দায় থাকি। সেই নব্বইয়ের দশকের স্মৃতিচারণা না করে থাকা যাবে না। সে সময় পূজা ছিল আমাদের কাছে সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির প্রতীক। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মিলে উদযাপন করতাম। তখন পূজার মণ্ডপে প্রতিমা বানানোর কারিগরদের সঙ্গে থেকে মূর্তি বানানো দেখতাম; আর তা বেশ উপভোগ করতাম। নানা ধরনের বাজি ফোটাতাম, নানান জায়গায় বেড়াতে যেতাম, যাত্রাপালা দেখতে যেতাম। ছোটবেলার এক মজার স্মৃতি মনে পড়ে। একবার বাবা-মা আমার পছন্দের জামা না কিনে দিয়ে তাদের পছন্দেরটা কিনে দিয়েছিলেন। আর সেটা নিয়ে আমার সেকি অভিমান! কান্নাকাটি আর মান-অভিমানে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে সেরেছি! এমনকি সেই জামা পরতে রাজিও হইনি।
বর্তমানে পাড়াভিত্তিক পূজা উদযাপনের ব্যাপারটি থাকলেও আগের তুলনায় তা বেশ কম; সঙ্গে আছে বেশ বাণিজ্যিক ব্যাপারও। তবু বিভিন্ন অভিজাত এলাকার তুলনায় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পাড়াভিত্তিক পূজাই ভালো লাগে বেশি। আমি চাই না কোনো উৎসব উদযাপিত হোক আতঙ্কে; বরং তাতে থাকুক পরিপূর্ণ আনন্দের উপস্থিতি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অনেক কিছুই পাল্টায়। যার ধারাবাহিকতায় জামা ঘিরে অভিমান করা আগের সেই ছোট্ট আমি আজ পূজায় পরিবারের সবাইকে খুশি রাখার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিই। এবার চেষ্টা করব মায়ের শাড়ি আর স্ত্রীর বায়না পূরণ করার। এবারের পূজা উদযাপন ঘিরে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও বরাবরের মতো ঢাকাতেই থাকা হবে। রাত ৯টা-১০টায় বের হব সবাইকে নিয়ে, মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে। সঙ্গে কুমারীপূজা আর দশমীর বিশেষ উদযাপন তো আছেই।
উঁকি দেওয়া প্রেম
সোমলতা আচার্য্য চৌধুরী
গায়িকা; পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্য সবার মতো সারা বছর আমিও অপেক্ষা করি এই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি, সময়ের অববাহিকায় একেক সময়ে পূজা কেটেছে একেক রকম। একদম ছোটবেলায় আমার কাছে পূজা বলতে ছিল বাবা-মায়ের হাত ধরে দিদিকে নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। আরেকটু বড় হওয়ার পর টানা কয়েক বছর কেটেছে মামাবাড়িতে। সেখানে একত্র হতাম ১৩-১৪ জন কাজিন। এরপর সবাই মিলে পাড়ার পূজার প্যান্ডেলে আড্ডায় কাটাতাম, সময় যে কখন চলে যেত টের পেতাম না। সেই সময় চার মামার কাছ থেকে প্রতিদিন উপহার পেতাম। আর তা জমিয়ে কাজিনদের নিয়ে দশমীর দিন ভালো কোথাও খেতে যেতাম। বিভিন্ন স্ট্রিট ফুড, যেমন ফুচকা, পাপড়ি চাট ইত্যাদি চেখে দেখতাম।
কলেজে পড়ার সময় সম্পর্কে জড়াই। স্বামী আকাশ সেই সময় ছিল বয়ফ্রেন্ড। সে বাইরে পড়াশোনা করার কারণে অন্য সময়ে ওর সঙ্গে তেমন একটা দেখা হতো না। ফলে পূজার সময় এলে ষোলো আনা পূর্ণ করতাম। হেঁটে বেড়াতাম মাইলের পর মাইল। কিছুটা ঠাকুর দেখে, কিছুটা প্রেম করে কেটে যেত সময়। দেখা হতো পূজার প্রায় প্রতিদিনই। পরবর্তী সময়ের পূজাগুলোতে দক্ষিণ কলকাতায় হেঁটে চষে বেড়াতাম আর বিভিন্ন প্যান্ডেল দেখতাম। দশ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করতেও দ্বিধা করতাম না।
গানের জগতে প্রবেশের পর গত ১১ বছর পূজা মানেই যেন ব্যস্ততা। এই সময়ে দু-তিনবার কলকাতায় থাকা হয়েছে। বাকি সময়গুলোতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এবং বিদেশে শো নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। সে সময় অসংখ্য নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ব্যাপারটি যথেষ্ট ইতিবাচকভাবেই দেখি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সেখানকার স্পেশাল কুজিনের স্বাদ নিতে ভুলি না।
ছোটবেলায় জামাকাপড় কেনা এবং কোন দিন কোন কাপড় পরব, তা নিয়ে যে আগ্রহ ও উত্তেজনা ছিল, তা এখন আর তেমন নেই। তবে বিগত সময়ে অষ্টমীর দিন অঞ্জলিতে শাড়ি পরার প্রথা ভালোভাবেই অনুসরণ করতাম এবং তার জন্য শাড়ি কিনতে ভুল হতো না। এবারের পূজার সময় দেশে থাকা হচ্ছে না। ঘুরে বেড়াব আর গানে মাতাব দর্শক-শ্রোতাদের।
গ্রন্থনা: ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সংগ্রহ