এডিটরস কলাম I সহমর্মিতার সামাজিক জীবন
কারও সমস্যায় কারও কিছু যায় আসে না। নিজের ভালো থাকলেই হলো। কিন্তু একা ভালো থাকার চাপ বইতে গিয়ে মানুষ যে আরও বিচ্ছিন্ন এবং নিরুপায় হয়ে পড়ে, তা কি আমরা বুঝি? এবং এই পরিস্থিতি থেকেই তো উদ্বেগের জন্ম হয়, অনিশ্চয়তা, ভীতি, অবিশ্বাস ও সন্দেহ পেয়ে বসে
আমরা খুব ব্যক্তিগত হয়ে পড়েছি। বড়জোর নিজের পরিবার ছাড়া আর কিছু কি ভাবতে পারি? কিন্তু আমাদের উদ্বেগ বিচিত্রমুখী ও বিপুল। সন্তান জিপিএ ফাইভ পাবে কি না, কাদের সঙ্গে সে মেশে, ডাক্তারের কাছে সময়মতো পৌঁছতে পারা যাবে তো? যে ফ্ল্যাট বা প্লট লোন করে কেনা হলো, তার কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এবার টান পড়বে টাকায়, তা জোগাড় করা যাবে কি? ভাগ্নের বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো, ভালো একটা উপহার না দিতে পারলে মুখ দেখাবো কেমন করে? এসব প্রশ্ন ও সংকটের মধ্যে প্রায় সেঁধিয়ে থাকছে এখনকার জীবন। এগুলোর মোকাবিলা করতে গিয়ে কাহিল হয়ে পড়েছে আমাদের সামাজিক মন। তাই একটা উপলক্ষ লাগে, যেখানে প্রত্যাশিত কিছু মানুষের দেখা অন্তত মিলবে।
একসময় জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ, উদ্বেগহীন, কোথাও কারও কোনো তাড়া ছিল না। সবার সঙ্গে সবার দেখা হতো, যদিও যোগাযোগ আজকের মতো সহজ ছিল না। পেশাজীবী মধ্যবিত্তের বাসায় একটা ল্যান্ডফোন থাকতো, এটুকুই। পরিবারকর্তার রোজগার বেশি নয়, কিন্তু চাহিদা সামান্য। ফলে, অস্থিরতা, অশান্তি, হতাশা- এসব ছিল না। সামাজিক সম্পর্কগুলো ছিল আনন্দ আর সহমর্মিতায় পূর্ণ।
এখন যোগাযোগের উপকরণ সহজলভ্য, যোগাযোগও সহজ; কিন্তু সবাই যে যার মতো বিচ্ছিন্ন। প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কারণে উদ্বিগ্ন ও অস্থির। সবারই খুব তাড়া, যার সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই বলে, সময় নেই। আচ্ছা, আগে এত সময় মানুষ পেত কোত্থেকে? ছোটবেলায় দেখতাম, বিকেলে প্রতিবেশী বাসায় এসেছেন, গল্প করতে করতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে। এখন তো আত্মীয়স্বজনেরই দেখা মেলে না পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া কিংবা খুব কাছের কেউ মারা না গেলে। অর্থাৎ পারস্পরিক সাক্ষাৎ পর্যন্ত উপলক্ষভিত্তিক হয়ে পড়েছে। উপলক্ষমাত্রই ক্ষণস্থায়ী, ফলে যাদের সঙ্গে দেখা হয়, ক্ষণিকের তাকানো আর দু-চারটা বাক্যবিনিময় ছাড়া তেমন কিছুর সুযোগ থাকে না। তারপর যে যার জগতের দিকে ছুটছে, কখন আবার দেখা হবে, বলা যায় না।
সমাজ আগে ছিল, এখনো আছে। কিন্তু এর চেহারা যেমন পাল্টেছে, অভ্যন্তরটাও আগের মতো নেই। যেমন ধরুন, আপনার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া সন্তানকে নিয়ে আগে বাবা-মায়ের কাউকে স্কুলে যেতে হতো না, ছুটি শেষে বাড়িতে আনতে হতো না। এখন অষ্টম শ্রেণির সন্তানকে নিয়েও দেখি তাদের কোচিং সেন্টারে যেতে হয়। কেউ-কেউ বসেও থাকেন। কারণ- উদ্বেগ। কিন্তু কেন? নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাই তো রাষ্ট্র রেখেছে। যেমনটি ছিল আগেও। ছিল সেসব মানুষের গড়া সমাজ, যাদের ওপর নির্ভর করা যেত। এমনকি অচেনা হলেও। এখন পাশের ফ্ল্যাটের শিশুটির নাম কি বলতে পারবে কেউ? শৈশবে দেখেছি, কোনো প্রতিবেশী মারা গেলে, পারিবারিক অনুষ্ঠান এমনকি বিয়ে পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হতো। এখন একই দালান থেকে বরযাত্রী ও মৃতদেহ বের হচ্ছে। মেনে নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু এটাই এখনকার বাস্তবতা। কখন যে আমরা এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি, টেরও পাইনি। আমাদের জীবনের গতি হঠাৎ করেই ঢের বেড়েছে। তাড়া বেড়েছে। ফলে, কেউ কারও দিকে তাকানোর ফুরসত পাই না। তাতে এমন একটা মনোজাগতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে বিবেকের অংশীদারিত্ব ঘুচে গেছে। কারও সমস্যায় কারও কিছু যায় আসে না। নিজের ভালো থাকলেই হলো। কিন্তু একা ভালো থাকার চাপ বইতে গিয়ে মানুষ যে আরও বিচ্ছিন্ন এবং নিরুপায় হয়ে পড়ে, তা কি আমরা বুঝি? এবং এই পরিস্থিতি থেকেই তো উদ্বেগের জন্ম হয়, অনিশ্চয়তা, ভীতি, অবিশ্বাস ও সন্দেহ পেয়ে বসে। ফলে, সমাজে মানুষে মানুষে যে গাঁটছড়া থাকে, যা থেকে ঐক্যের সুর বেজে চলে, তা নষ্ট হয়ে যায়। ন্যায়-অন্যায়বোধও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এটা খুব বিপজ্জনক। যারা একটু বেশি সংবেদনশীল, তারা সামলাতে পারে না।
এই অবস্থা থেকে মুক্তি দরকার। কিন্তু চটজলদি তা সম্ভব নয়। তবে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি সবার আগে। ব্যক্তি ও পরিবারকে সমাজের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। শৈশব-কৈশোরের সহপাঠী ও বন্ধুদের খুঁজে বের করুন। দেখবেন কেউ না কেউ আপনার কাছেই রয়েছে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। এখান থেকেই দেখবেন, একটা সুন্দর সামাজিক পরিমন্ডল গড়ে উঠছে। সবাই মিলে জনহিতকর কোনো লক্ষ্য ঠিক করে কাজ শুরু করতে পারেন। চিত্তের মুক্তি যেমন আসবে, নিজের উদ্বেগ-অস্থিরতা কমে আসবে। দল বেঁধে বেড়াতে যেতে পারেন। শরীর-মন দুটোই চাঙা হবে। আর এই সামাজিক সম্পর্ক থেকে এমন কিছু পেয়ে যাবেন, যার জন্য আপনার অপেক্ষা ছিল। যত মিলেমিশে থাকবেন, দুশ্চিন্তা তত কম হবে। জীবন তখনই প্রীতিকর, যখন তা উদ্বেগমুক্ত। সে জন্যই প্রয়োজন সহজ, সুন্দর, সহমর্মিতাপূর্ণ পরিবেশ। একটু সচেতন আর আন্তরিক হলে এটা আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলতে পারি।
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু