ফিচার I ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে
শুধু সুপারহিরোদের স্টাইল স্টেটমেন্টেই সীমাবদ্ধ নেই এর গন্ডি। মিলেছে বিশ্বের জনপ্রিয় সব তারকার অনুমোদনও। প্রমাণ রানওয়ে, রেড কার্পেট থেকে হালের ট্রেন্ডি ইনস্টা রিলে। জানাচ্ছেন সারাহ্ রুশমিতা
অন্তর্বাস। নিত্যদিনের পোশাকের তালিকায় এর উপস্থিতি অনেকটা আবশ্যকই। তবে একসময় প্রায় অবহেলিত ছিল এই ওয়্যারড্রোব এসেনশিয়াল। কয়েক যুগ আগের ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যায়, অন্তর্বাসকে মানব সম্মুখে নিয়ে আসার কাজটি প্রথম করেছিলেন পুরুষেরা। কডপিস নামক আন্ডারওয়্যারটি প্রথম আলোয় আসে আউটারওয়্যার হিসেবে। মেল জেনিটালিয়া ঢেকে রাখতে। তবে এই অনুষঙ্গ ব্যবহারের কারণ কিন্তু মোটেই ফ্যাশন ছিল না, বরং মূত্রত্যাগের কাজ সহজ করা ছিল উদ্দেশ্য। ট্রাউজারের বাইরের দিকে এটি সংযুক্ত করে রাখা হতো। এরপরে দেখা যায় করসেট। নারীর এই অন্তর্বাস প্রথম দৃশ্যমান হয় দেহকে আরও সুডৌল দেখাতে।
নব্বইয়ের দশক থেকেই লুকিয়ে রাখা অন্তর্বাস মানুষের সামনে উন্মুক্ত করার প্রচলন শুরু হয়। পরিণত হয় ফ্যাশন স্টেটমেন্টে। বারল্যাস্ক এবং ফ্লাপার নাচিয়েদের পরনের ব্রা, আন্ডারওয়্যার এবং স্টকিং তখনকার সময়ে আকর্ষণীয় পোশাক হিসেবে সমাদৃত হতে শুরু করে। জোসেফাইন বেকার, ক্লারা বও, টেম্পসেট স্টরমের মতো লিজেন্ডারি পারফরমারদের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের সাক্ষী।
১৯৬০ সালে সেক্সুয়াল লিবারেশন মুভমেন্ট একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখে অন্তর্বাসের বহিঃপ্রকাশে। আশি ও নব্বইয়ের পপতারকারা এই ট্রেন্ডকে আরও উসকে দেন। জনপ্রিয় পপতারকা ম্যাডোনা ১৯৮০ সাল থেকেই অন্তর্বাসকে দর্শকের সামনে নিয়ে আসেন। অন্তরালে ঢেকে রাখার যুগ পেছনে ফেলে পোশাককে পোশাক হিসেবে গণ্য করার শুরু সেখান থেকেই। ১৯৯০ সালে তার এক শোতে তিনি হাজির হয়েছিলেন জন পল গঁতিয়েরের কাস্টম মেইড ‘কোন ব্রা’ পরে। এ ধারাই বর্তমানে নজর কাড়ছে মেগান ফক্স, বেলা হাদিদদের স্টাইল অ্যাপিয়ারেন্সে। আশির দশকে প্রিন্সেস ডায়ানাও স্লিপ ড্রেসকে আউটারওয়্যার হিসেবে পরার প্রথা জনপ্রিয় করে তোলেন।
১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের প্রথম দিকে ‘হোয়েল টেইল ট্রেন্ড’ জনপ্রিয় হয়। মূলত লো-ওয়েস্টেড প্যান্ট অথবা স্কার্টের কোমরের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসা থং স্ট্র্যাপের এই স্টাইল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফ্যাশনিস্তাদের মাঝেও। কাটতি বাড়ে লো ওয়েস্টেড বটমের। প্যারিস হিল্টন, হ্যালি ব্যারি ও ব্রিটনি স্পিয়ারসের মতো তারকারা এই ট্রেন্ড তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে আবার এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ভারসাচি ও গুচির মতো ব্র্যান্ডগুলোর কল্যাণে। বাদ পড়ছেন না তারকারাও। তালিকায় আছে বেলা হাদিদ, কিম কার্দাশিয়ান আর জেনিফার লোপেজের মতো নাম। ১৯৯৭ সালে ব্র্যান্ড গুচির স্প্রিং সামার কালেকশনের রানওয়েতে মডেলকে দেখা যায় বটমে থং পরে ক্যাটওয়াক করতে। এরপর হ্যালি ব্যারি ২০০০ সালের এক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে দৃশ্যমান থংয়ে রেড কার্পেটে আসেন। সেই শুরু। এরপর ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে ইনারওয়্যারের রক্ষণশীলতা। এক্সপোসড থংকে স্টাইলিশ ক্লথ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এখন দেখা যাচ্ছে নানান রকম সৃজনশীলতা। যেটুকু অংশ দৃশ্যমান, সেই অংশকে অলংকৃত করার ট্রেন্ড এখন জনপ্রিয়। স্টোন, ক্রিস্টালের মতো অনুষঙ্গ ব্যবহারে।
হালের ওয়াইটুকে ট্রেন্ডকেও প্রভাবিত করছে এই ফ্যাশনধারা। এবারের মেট গালা আফটার পার্টিতে উপস্থিত তারকাদের পোশাকের দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মিলবে। সেখানে অনেকেই পরেছিলেন লঞ্জারে ইন্সপায়ারড আউটফিট। এর মধ্যে কেন্ডেল জেনারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই আয়োজনে পোশাক হিসেবে দেখা গেছে স্টকিং, গারটারস, ব্রা টপস, হোয়েল টেইলস। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড গুচি, ফেন্ডির রানওয়েতে দেখা গেছে এ ধরনের আউটারওয়্যারের সঙ্গে ক্লাবড লঞ্জারে ইন্সপায়ারড আউটফিট। ওয়াইটুকের মিলিনিয়াল ফ্যাশনের ধারা অনুপ্রাণিত করছে জেন জেডদের। অতিরঞ্জনে এই প্রজন্মের সব সময়েই অনাগ্রহ। তাদের চাহিদার সঙ্গে বেশ খানিকটা মিল আছে এই লঞ্জারে ইন্সপায়ারড আউটফিট ট্রেন্ডের।
করোনাকালের যাপিত জীবন ফ্যাশনে শক্তিশালী প্রভাব রেখেছে। মানুষ নতুনভাবে নিজেকে চিনতে পেরেছে। নিজের শরীরকে মেনে নিয়ে, শারীরিক গঠনকে বাস্তবের সঙ্গে মিল রেখে সাজিয়ে তোলায় প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছে। সাহসী পোশাকের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠার এটি অন্যতম কারণ। করোনা-পরবর্তী জীবনে নিজের প্রতি ভালোবাসা এবং বডি পজিটিভিটি—এই দুই চিন্তাধারাতেই মানুষ নতুন করে জীবনদর্শনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়। কেননা, মহামারি শেষে নতুন করে নিশ্বাস নেওয়ার আনন্দ সবার চোখেমুখে। নিজেকে লুকিয়ে রাখাতে আর আগ্রহ নেই। নেই প্রতিবন্ধকতাকে শক্তিশালী করে তোলার ভুল ভাবনা; বরং সাহসী পোশাকে দেহকে পর্যাপ্ত আরাম আর ট্রেন্ডি করে তুলতেই যত ফ্যাশন-ভাবনা।
তবে এ ধরনের পোশাক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সঠিক মাপের আন্ডারগার্মেন্টস কেনা চাই। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দেহের আকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দেহের জন্য উপযুক্ত অন্তর্বাস বেছে নেওয়ার জন্য সঠিক মাপ জানা আবশ্যক। একই সঙ্গে নিজের দেহকে ভালোভাবে জানা জরুরি।
শপিং লিস্টে অনেক ধরনের অন্তর্বাস রাখা আবশ্যক নয়। সংগ্রহ পর্যাপ্ত না থাকলে তবেই শপিংয়ে যেতে হবে। আর যদি বাজেটে বেশ বড় অঙ্ক আলাদা করে রাখা থাকে নতুন এই ট্রেন্ড উপভোগের জন্য, তাহলে রংবেরঙের অন্তর্বাস কেনার মোক্ষম সময় এখনই।
আন্ডারওয়্যারকে আউটারওয়্যার হিসেবে পরার ট্রেন্ডে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ বেশ কাজে দেবে। যেমন গোল গলার সাদা রঙের টি-শার্ট এবং ম্যাচিং স্নিকারের সঙ্গে পেয়ার আপ করে নেওয়া যেতে পারে প্যাস্টেল কালার স্লিভলেস স্লিপ ড্রেস।
আবার, প্যাস্টেলকে খানিক সময়ের জন্য সরিয়ে রেখে কিছুটা মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে শকিং কালারের পোশাকের দিকেও। ফ্লুরোসেন্ট ইয়েলো কিংবা নিয়ন ইয়েলো কালারের ব্রা বেছে নেওয়া যায়। এর সঙ্গে ব্যাগি ডেনিম প্যান্টের মেলবন্ধনে তৈরি হবে দারুণ স্টাইল। শকিং ইয়েলো কালারের জুতার লেইস আউটফিটটিকে করবে সম্পূর্ণ।
আন্ডারওয়্যার কালেকশনে ব্ল্যাক থাকবেই, এ জন্য নতুন করে শপিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। ব্ল্যাক ব্রালেটের সঙ্গে শিয়ার ব্ল্যাক শার্ট পরে নেওয়া যেতে পারে অনায়াসে। সঙ্গে স্ট্র্যাপি স্যান্ডেল বেছে নেওয়া যায় নিয়ন কালারের। এই দুই বিপরীত ধারার রঙের মেলবন্ধনে বেশ মানিয়ে যাবে।
রেগুলার ব্রার বাইরে ডিজাইনার ব্রা কিনে রাখা যায় সংগ্রহে। অনেক না হলেও একটি কিংবা দুটি ড্রেসি ব্রা আলমারিতে থাকতেই পারে। এ ধরনের ব্রার সঙ্গে বটমে জেট ব্ল্যাক শর্টস অথবা নি-লেন্থ ক্যাপ্রি পরে নেওয়া যায়। এরপরে টপে লেয়ারি করে নেওয়া যায় ওভারসাইজড শার্ট দিয়ে। লুক সম্পূর্ণ করতে পায়ে পরা যায় স্ট্র্যাপি হিলস। রং বেছে নিতে হবে উজ্জ্বল।
বডি স্যুট অন্তর্বাসের নতুন ধারার একটি দারুণ সংযোজন। নতুন করে বডি স্যুট কেনার সময় এর পেছনের দিকের নকশাতেও খেয়াল করতে হবে। সুচারু নকশার একটি বডি স্যুট সংগ্রহে থাকলেই চলবে। লেইস ব্যাক-সংবলিত বডি স্যুটও বেছে নেওয়া যায়।
ক্যামিসোলের আরেক নাম আরাম। সিল্কে তৈরি ক্যামিসোল একদম গায়ে মিশে থাকে। এটি সরাসরি আন্ডারওয়্যার না হলেও লাউঞ্জওয়্যার হিসেবে সমাদৃত। আউটারওয়্যার হিসেবেও এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এর সঙ্গে লেয়ারিংয়ে শিক ব্লেজার অথবা কোজি কার্ডিগান—পরে নেওয়া যাবে দুই-ই। তবে আবহাওয়ার মর্জি মেনে।
লেয়ারিং বেশ কয়েক বছর ধরে ফ্যাশনের বাজারে রাজত্ব করছে। অন্তর্বাসের সাহসী ফ্যাশনেও দেখা যাচ্ছে লেয়ারিং। এটি বেছে নিতে চাইলে স্বচ্ছ ফ্যাব্রিক জুতসই। ডিজাইনের ক্ষেত্রেও অতিরঞ্জন এড়িয়ে চলা জরুরি। গঠনগত নকশায় ফ্রিল থাকতে পারে, কিন্তু অতিরিক্ত অলংকরণ এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
কালেকশনে করসেট থাকা চাই-ই চাই। ওভার বাস্ট করসেট টপসের মতো করে পরা যায়। সঙ্গে সিল্ক স্কার্ফ। শোল্ডার জুড়ে রাখা যেতে পারে। সঙ্গে স্যাটিন ব্লেজারের লেয়ারিং—একদম জমে যাবে।
বাসার বাইরের রোব কখনো পরা না হলেও এই সিজনে চলবে সেটাও। সিল্ক আর স্যাটিন ফ্যাব্রিকের রোব আউটারওয়্যার হিসেবে বেশ মানাবে। ফ্যাশন আর আরাম—দুই-ই হবে।
ওভার দ্য টপ স্টাইলেও চলতে পারে এই ফ্যাশন। ওয়ান কালার সেমি ট্রান্সলুসেন্ট টপসের সঙ্গে পরা যায় ফ্রেমড অথবা লেইসি ব্রা। অন্তর্বাসের ফ্যাশনে লেয়ারিং একদম বেসিক সূত্র। বিভিন্নভাবে এই ট্রিকস ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মাথায় রাখতে হবে স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারটা। মেনে চলতে হবে উপযোগিতাও।
মডেল: ইফা ও সূর্য
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস