টেকসহি I প্রযুক্তিই প্রতিকার
ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসে। সমস্যা শনাক্তকরণের পাশাপাশি সমাধানেও কার্যকর অত্যাধুনিক সব প্রক্রিয়া
প্রয়োজনে শপিং, বড্ড সেকেলে ব্যাপার! ফাস্ট ফ্যাশনের কালচারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার প্রয়োজনে পোশাক কেনার চল এখন আর নেই বললেই চলে। এখন যেন নতুন পোশাকের দরকার পড়ে প্রায় প্রতিদিন। ব্যস্ততা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ঘরের বাহির হওয়ার মাত্রা। ফলাফল—ফাস্ট ফ্যাশনে ঝোঁক। মুদ্রাস্ফীতির সংবাদ রোজ খবরের পাতাজুড়ে, তবু যেন কেনাকাটা থেমে নেই। মানুষ কিনছে; তা প্রয়োজনের থেকে বেশিই। এতে তৈরি হচ্ছে ফ্যাশন-বর্জ্য। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে। ক্ষতিকর রাসায়নিকে ভারী হচ্ছে বাতাস।
আশার খবর হচ্ছে, প্রযুক্তির ব্যবহারে কমানো যেতে পারে ফাস্ট ফ্যাশন-বর্জ্যরে পরিমাণ। তবে এর বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সফলতা পেতে প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে মূল কারণ। বুঝতে হবে কীভাবে পরিবেশের টেকসই অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ফাস্ট ফ্যাশন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত ক্রেতার থেকে পণ্যের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। যদিও এই অতিরিক্ত পণ্যগুলোর পাশাপাশি ক্রেতার কাছেও থাকে প্রয়োজনের বাড়তি পোশাক। এই দু ধরনের পোশাকের যথাযথ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে প্রযুক্তি ভালো সমাধান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ডেটা ড্রিভেন বাজার পরিকল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কেট রিসার্চের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা বুঝে থাকেন বাজার চাহিদা কেমন হতে পারে। কাস্টমার বিহেভিয়ার অর্থাৎ ভোক্তার আচরণ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। এতে অতিরিক্ত পণ্য তৈরির পরিমাণ কমে আসবে।
ফ্যাশনে বেশ কিছু সেকেলে চর্চা রয়েছে। যেমন ইউনিফর্ম, ওয়ার্কিং আওয়ারে অফিসে থাকার বাধ্যবাধকতা, মিটিং অ্যাটেয়ারে উপস্থিতির মতো বিষয়গুলো ফাস্ট ফ্যাশনের গতি বাড়িয়ে দেয়। কারণ, ধরাবাঁধা নিয়মের কাপড়গুলো তৈরি বাধ্যতামূলক, কিন্তু উপযোগিতার পরিমাণ কম। একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পরে এ ধরনের পোশাকগুলো পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এগুলো থেকে সম্পূর্ণ উপযোগিতা আদায় সম্ভব হয় না। এর আগেই ফ্যাশন-বর্জ্যে পরিণত হয়। আবার কিছু পোশাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে বেশ ভারী বুননের ফ্যাব্রিক, যা অনেক বেশি সময় ধরে অপচনশীল থাকে। তবে সময় পাল্টাচ্ছে। আউটডেটেড ফ্যাশনের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন অনেকে। ফরমালের দুনিয়াতে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে সেমি ফরমাল, ক্যাজুয়াল। ঘরের পোশাকে দিব্যি বাইরে বেড়ানো যায় এখন। আবার আড্ডা-দাওয়াতের পোশাক পরে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে যেতে পারছেন ব্যস্ত মানুষেরা। ব্যয় কমছে। কমছে কম উপযোগিতার পোশাক তৈরির বাধ্যবাধকতা। করোনাকাল প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পেরেছে, বাসায় থেকেও সমানভাবে কাজ করে যেতে পারেন একজন কর্মী। এসবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তির আধুনিকায়নে এখন যেকোনো জায়গা থেকেই অফিসের মিটিংয়ে যোগ দিতে পারছে মানুষ। তাই অফিশিয়াল পোশাকের আবশ্যকতা কিছুটা হলেও কমেছে। আবার ভার্চুয়াল মিটিং, সেমিনার, ক্লাস, অফিসের ক্ষেত্রে ক্যামেরা অন করে কাজ করতে হলেও সে জন্য নতুন নতুন পোশাক, ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য নতুন পর্দা, বিছানার চাদর মোটেই জরুরি হয়ে দাঁড়ায়নি। অনলাইন মিটিং অ্যাপের ফিচারে রয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তন অপশন। সেটি ব্যবহারে নিমেষেই বদলে যাচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ড।
ফাস্ট ফ্যাশনে ট্রেন্ড দ্রুত বদলে যায়। একটির পরে আরেকটি ফ্যাশনধারা আসতে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। ফলে অনেক সময়ে ফ্যাশন ফোরকাস্টিং ভুল হয়ে থাকে। প্রডাকশনের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে গেলে বিকোতে বিকোতে ট্রেন্ডের বাইরের পোশাক হিসেবে গুরুত্বহীন হয়ে যায় কালেকশনটি। নিকট ভবিষ্যতে যেহেতু ট্রেন্ড ফিরে আসার সম্ভাবনা কম থাকে, তাই ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো পোশাক ধরে রাখার পরিকল্পনায় অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। বড় লটে পোশাক জমা হতে শুরু করে তখন। এ ক্ষেত্রে পোশাকে যদি রিডিজাইন করার অপশন থাকে, সেগুলো ফ্যাশন-বর্জ্যে পরিণত হওয়া থেকে বেঁচে যায়। পোশাকের গঠনগত নকশা পরিবর্তন অসম্ভব, এমন নয়। এ বিষয়ে ফ্যাশন ডিজাইনারদের নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। ফ্যাশন টেকের মাধ্যমে উপযোগী পোশাকের পরিকল্পনা করা যায় এ ক্ষেত্রে।
ওভার প্রডাকশনের কারণে যে শুধু ফ্যাশন-বর্জ্য তৈরি হয়, তা কিন্তু নয়। লেবার খরচ বেড়ে যায়। শিপিং চার্জও বৃদ্ধি পায়। প্রডাক্ট শিপিংয়ে সমুদ্রপথের ব্যবহারে পানি দূষিত হয়। কারণ, বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে তেল ব্যবহার করে। জাহাজ যত বেশি চলাচল করবে, তেলের মাধ্যমে দূষণ ততটাই বাড়বে। রয়ে যাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট।
ফাস্ট ফ্যাশনে পণ্য উৎপাদন নিয়ে হাজার রকমের পরিকল্পনা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা হয় ওয়্যারহাউস নিয়েও। ওয়্যারহাউসে পণ্য কীভাবে এবং কী পরিমাণে থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। ওয়্যারহাউসে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) ব্যবহার করা হলে পণ্য মজুতের পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। সহজেই স্টক লেভেল জানা গেলে পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে সঠিক লোকেশনে সঠিক পরিমাণ পণ্য শিপিং। প্রডাক্ট মুভমেন্টের ক্ষেত্রে আরএফআইডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে শিপিংয়ে পণ্যের সঠিক বণ্টন সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব।
এআই, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করা যায় পাইকারি দোকান এবং ওয়্যারহাউস উভয়ই জায়গাতেই। ফ্যাশন ডিজাইনাররা পোশাকের ডিজাইন করা থেকে প্রস্তুত করার নানা ধাপে এআই ব্যবহার করতে পারেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে জানা যেতে পারে, কোন কোন ট্রেন্ড সেট হবে আসন্ন সিজনে। জানা যাবে ফ্যাশনবিশ্ব কোন দিকে এগোচ্ছে, পোশাকের প্যাটার্ন কেমন হবে, কোন দেশ এখন কেমন ধারা অনুসরণ করছে, ফ্যাশন জোয়ারের স্রোত কোন দিকে ধাবিত হবে। আরও শনাক্ত করা যাবে নতুন ডিজাইন পরীক্ষামূলকভাবে পাঠাতে চাইলে কোন দেশটি বেশি উপযুক্ত। এ ছাড়া সেলসের মূল্যায়নসহ ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বেশির ভাগ সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে এআই ব্যবহারে। শিপিংয়ের আগে ম্যাচিওর ডেটা বিজনেস সম্পর্কে জানা গ্রোথের জন্য জরুরি হয়ে থাকে। স্টোরের ক্ষেত্রেও নানাভাবে অপারেশনে সাহায্য করবে এআই। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। সাধারণত দোকানে একটি পোশাকের বিভিন্ন সাইজ থাকে। সব সাইজ সমানভাবে বিক্রি হয় না। কিছু কিছু সাইজ রয়ে যায়। স্টোরে এআই ব্যবহার করা হলে ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যাবে কোন সাইজের পোশাকের চাহিদা বেশি এবং কোনটির তুলনামূলক কম। সে অনুযায়ী পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে প্রডাকশন যেমন যথাযথ করা সম্ভব, তেমনি কমিয়ে আনা সম্ভব অদরকারি পোশাক। অনলাইনে এআই রিকমেন্ডেশন, সল্যুশন এবং স্টাইল গাইডের মাধ্যমে প্রডাক্ট ওয়েস্ট কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে অনলাইনে সাইজ ভুল করে অর্ডার দেওয়া যেমন কমবে, তেমনি ভুল সাইজ কিনে নিয়ে ফেরত দেওয়ার পরিমাণ মোটামুটি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আশা করা যায়।
আরএফআইডি এবং এআইয়ের মেলবন্ধন তৈরি করে ওয়্যারহাউস এবং স্টোর নিয়ন্ত্রণ করা হলে ফ্যাশন লেবেলগুলো ওয়েস্টের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো।
প্রযুক্তির একটি নতুন দুয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ওয়েবসাইট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থিতির মাধ্যমে ব্যবহৃত পোশাক পুনরায় ব্যবহারের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠছে ইদানীং। এই শেয়ারিংয়ের ফলে ফ্যাশন-পণ্য দ্রুত বর্র্জ্যে পরিণত হচ্ছে না।
একইভাবে রেন্ট দ্য রানওয়ে অর্থাৎ ভাড়া করা পোশাকে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসার প্রচলনও শুরু হয়েছে। এই প্র্যাকটিসের মাধ্যমে দোকান থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নেওয়া যায় পোশাকটি। ফলে বাজেট সংকুলানে চাপ তৈরি হয় না কারও ওপরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপ অথবা পেজ খুলে এখানে কয়েকজন মিলে কাজ করতে পারে। এভাবেই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে ফাস্ট ফ্যাশনও হয়ে উঠতে পারে সাসটেইনেবল; যাতে উপকৃত হবেন ক্রেতা, বিক্রেতা, উৎপাদনকারী। ভারসাম্যে থাকবে পৃথিবীর পরিবেশ।
i সারাহ্ রুশমিতা
ছবি: ইন্টারনেট