স্বাদশেকড় I পুডিং পার্বণ
বিক্রির পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়, আমরা পুডিংয়ের প্রেমে পড়ে গেছি! খাবারের শেষ ভাগের এই মিষ্টান্নের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশ দারুণ
বাঙালির পাতে পুডিং বেশ ভালোই জায়গা করে নিয়েছে। তবে এই সুস্বাদু খাবারের উৎপত্তি এই অঞ্চলে নয়; ভারতীয় উপমহাদেশে পুডিং তৈরির প্রণালি এসেছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। ইতিহাস বলে, মধ্যযুগে এই বিশেষ খাবার তৈরি শুরু করেন পশ্চিম ইউরোপের গৃহিণীরা। এর সত্যতা মিলেছে ১৬১৫ সালে প্রকাশিত গার্ভাস মারখামের ‘দ্য ইংলিশ হাউসওয়াইফ’ বইয়ে। সেখানে তিন ধরনের পুডিং তৈরির প্রণালি বর্ণনা ছিল—সেদ্ধ পুডিং, রুটি পুডিং ও ভাতের পুডিং। যদিও তখন এগুলোকে গরম খাবার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তবে গত শতাব্দীতে পুডিং বলতে খাবারের শেষে একটি মিষ্টান্নকে বোঝায়।
১৮৩৭ সালে যুক্তরাজ্যের আলফ্রেড বার্ড, কর্নফ্লাওয়ার সহযোগে যে প্রণালি ব্যবহার করে পুডিং তৈরি করেন, সেটিকেই প্রথম বিক্রয়যোগ্য পুডিং তৈরির প্রণালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলফ্রেড বার্ড তখন কর্নফ্লাওয়ার ব্যবহার করেছিলেন; কারণ, ডিমের প্রতি অ্যালার্জি ছিল তার স্ত্রীর। এটি ছিল প্রথম প্যাকেজ করা পুডিংগুলোর অন্যতম। এদিকে, উনিশ শতকের শেষ দশকে এবং বিশ শতকের শুরুতে লিয়নরা কেক ও আলকাতরা তৈরিতে দীর্ঘ শেলফ প্রস্তুত করে। ১৯২০-এর দশকে লন্ডনে অবস্থিত হ্যামারস্মিথের ক্যাডবি হলের কারখানায় প্রতি সপ্তাহে ২ মিলিয়ন ভিয়েনা রোল, ৪০ হাজার ফরাসি পেস্ট্রি, অর্ধ মিলিয়ন সুইস রোল, এক মিলিয়নের তিন-চতুর্থাংশ মাফিন ও এক মিলিয়নের এক-চতুর্থাংশ ক্রিম এবং জ্যাম স্যান্ডউইচ তৈরি হতো।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৮৬১ সালে প্রকাশিত ইসাবেলা বিটনের ‘দ্য বুক অব হাউসহোল্ড ম্যানেজমেন্ট’-এ পুডিং তৈরির উপকরণ হিসেবে দুধ, চিনি কিংবা ফলমূলের পাশাপাশি গরুর চর্বিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে তিনি রান্না করা আপেলের গুণাবলি তুলে ধরেন। অন্যান্য উপাদানের তুলনায় মাখনের উপকারিতা সম্পর্কেও এই বইয়ে অবহিত করেন ইসাবেলা। পাশাপাশি মার্জারিনও একই সময়ে বিকশিত হচ্ছিল। ইসাবেলা তার লেখা বইয়ে লেখেন, ‘ভালো ও টাটকা মাখন পরিমিতভাবে ব্যবহারের ফলে সহজে হজম হয়। মাখন নরম, পুষ্টিকর ও চর্বিযুক্ত হওয়ায় অন্যান্য অলিজিনাস পদার্থের তুলনায় হজম হয় অনেক সহজে।’ হেরোডোটাস পুডিং, এমপ্রেস পুডিং, দিল্লি পুডিং, রয়্যাল কোবার্গ পুডিং, বারবারি টার্ট, মিষ্টি ম্যাকারনি পুডিংয়ের মতো অনেক পুডিং সম্পর্কে বেশির ভাগ আধুনিক পাঠকদের ধারণা খুব বেশি নেই। বইটিতে বেশ কিছু পুডিংয়ের রেসিপিও রয়েছে, যা আজ অবধি জনপ্রিয়; যেমন জ্যাম রলি পলি, বেকড কাস্টার্ড পুডিং, রাইস পুডিং ও আপেল টার্ট। বেকড রুটি ও মাখনের পুডিংয়ের রেসিপিটি আধুনিক রুটি ও মাখনের পুডিংয়ের অনেক রেসিপির পথনির্দেশক। এসব পুডিংয়ে কিশমিশ, ভ্যানিলার স্বাদ যুক্ত থাকত এবং জায়ফল মেশানো হতো।
১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব দুনিয়ার সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। পুডিংয়ের মূল উপাদান দুধ, ডিম, ময়দা, শুকনো ফল, মাখন ও চিনি সেই সময় রেশনের আওতাভুক্ত ছিল। চিনি ও মাখন রেশনিং চালু ছিল ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। তাই বেশির ভাগ রেসিপিতে ময়দার পরিবর্তে শুকনো ডিম এবং কুচি করা আলু ব্যবহার করা হতো। তাই বলে তখনো কিন্তু স্টিমড পুডিং ও স্টিমড স্পঞ্জের প্রতি ভোজনরসিকদের ভালোবাসা কমেনি। যুক্তরাজ্যের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি লিফলেটের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১৯৪০ সালের জুন থেকে বাড়ির শেফদের অনুরোধ করা হয়, যেন বাচ্চারা পুডিংকে টিট হিসেবে দেখে এবং শাকসবজি খাওয়ার পরেই তাদের সেগুলো খেতে দেওয়া যাবে। তখন পুডিংয়ের বিভিন্ন রেসিপিতে উপাদান হিসেবে ছিল স্টিমড চকোলেট ডাফ, ময়দা, কাঁচা আলু, বেকিং পাউডার, কোকো, চিনি ও চর্বি।
বার্ডস নামক কাস্টার্ড পাউডার যা ভিক্টোরিয়ান যুগের একেবারে শুরুতে তৈরি হয়েছিল, সেটি নতুন নতুন পণ্যের একটি পরিসর নিয়ে আসতে করেছিল সহায়তা। ফলে যেসব কর্মজীবী নারীর রান্না করার মতো সময় ছিল না, তাদের জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়ে উঠেছিল। ১৯৬০ সালে ইনস্ট্যান্ট হুইপ, ১৯৬৪ সালে ড্রিম টপিং এবং ১৯৬৭ সালে অ্যাঞ্জেল ডিলাইট বাজারে আসে। প্রুর আধিবাসী পিটার ডেভিস প্রথম অ্যাঞ্জেল ডিলাইট বাজারজাত করেন, যিনি পরবর্তীকালে সেন্সবারি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন।
এদিকে, স্ট্রবেরি ফ্লেভারের মূল স্লোগান ছিল ‘টেস্ট লাইক স্ট্রবেরি অ্যান্ড ক্রিম’। বিনা মূল্যে স্যাম্পল প্রদানের একটি বিশাল প্রচারাভিযানের ফলে প্রথম বছরে যে পরিমাণ অ্যাঞ্জেল ডিলাইট বিক্রি হয়, তা অর্থের হিসাবে ২ মিলিয়ন পাউন্ড! ১৯৭২ সালে বাজারে আসে ব্যানোফি পাই। এটি এমন এক ধরনের মিষ্টি পুডিং, যাতে কলা, কনডেন্সড মিল্ক থেকে তৈরি ক্যারামেল, ক্রিম ও বিস্কুটের মতো উপাদান থাকে। এই পুডিংয়ের উদ্ভাবক ছিল ইস্ট সাসেক্সের জেভিংটনের রেস্তোরাঁ—‘দ্য হাংরি মঙ্ক’। বিস্কুট গুঁড়ো করে মেশানো এই পুডিং ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। চিজ কেকের ক্রেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যানোফি পাইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে সে সময়।
১৯৭০-এর দশকে বাজারে আরও আসে স্টিকি টফি পুডিং। কামব্রিয়ার শ্যারো বে হোটেলে এর উদ্ভাবন করেন ফ্র্যান্সিস কুলসন। সে সময় শ্যারো বে হোটেল ছিল কান্ট্রি হাউস হোটেলগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্টিকি টফি পুডিং উদ্ভাবনের সঠিক তারিখ জানা না গেলেও খাদ্যবিষয়ক লেখক সাইমন হপকিনসন জানান, কুলসন স্বীকার করেছেন, এই রেসিপি সম্পূর্ণ তার নিজের নয়; বরং তিনি ল্যাঙ্কাশায়ারের এক সুদর্শন নারীর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এমনকি হোটেলের কর্মীরা গোপন রেসিপিটি প্রকাশ না করার জন্য একটি গোপনীয়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তবে জানা যায়, এই পুডিংয়ের রেসিপিতে সমান পরিমাণে খেজুর, চিনি ও ময়দা যুক্ত করা হয়।
১৯৮০-এর দশক ছিল সবকিছুর জন্যই একটি স্বর্ণযুগ এবং তা ছিল ডেলিয়া স্মিথময়, যিনি টেলিভিশনের সময়সূচি ও প্রকাশনা ক্যালেন্ডারে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। ডেলিয়া ঐতিহ্যগত ইংলিশ খাবার এবং কৌশলের ক্ষেত্রে বাড়ির শেফদের শিখিয়েছিলেন সহজ উপায়। সময় বাঁচাতে সাহায্য করার জন্য প্যাকেটজাত খাবার ব্যবহারের উপায় বাতলে দিয়েছিলেন তিনি। ক্ল্যাসিক ডেলিয়া রেসিপি হিসেবে জনপ্রিয়তা পায় প্যাকেজ করা ট্রাইফেল স্পঞ্জ এবং বার্ডস কাস্টার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি ঐতিহ্যবাহী রাস্পবেরি ট্রাইফেল।
১৯৯৯ সালে প্রকাশের পর জেমি অলিভারের প্রথম রান্নার বই ‘দ্য নেকেড শেফ’ রন্ধনশিল্পী ও ভোজনরসিকদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। রোস্ট ও স্যালাড ছিল জেমির সবচেয়ে জনপ্রিয় মেনু। নিজের বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, বাড়ির শেফরা চাইলে সুপারমার্কেট থেকে প্রাক্-প্রস্তুত পুডিং কিনে আনতে পারেন। বইয়ের ‘ডেজার্ট’ অধ্যায়ের শুরুতে তিনি লিখেছেন, ‘শেফ হিসেবে আমি দেখেছি, এমন অনেক ডেজার্ট আছে, যেগুলো বাড়িতে বানানো বেশ মুশকিল।’ ‘দ্য নেকেড শেফ’-এ টুকরো ফল, বেকড চকোলেট টার্ট এবং সেমিফ্রেডোর মতো জটিল উপকরণ বাদ দিয়ে কীভাবে সহজেই পুডিং বানানো যায়, সে রকম কয়েকটি রেসিপিও দিয়েছেন জেমি। ওই বইয়ে তার উদ্ভাবিত সেরা পুডিং বলা যায় বেকড ফ্রুটকে। এতে থাকে সামান্য পরিমাণে খোবানি, ডুমুর, পিচ ও বরই ফল; সঙ্গে মেশানো হয় চিনি এবং কয়েক ফোঁটা ব্র্যান্ডি। ফলগুলো ভ্যানিলা চিনি দিয়ে মিষ্টি করে মাস্কারপোন ক্রিমের ডলপ বা পি-সহ পরিবেশন করা হয়। ইতালীয় ডেজার্ট অ্যাফোগাটোকে জনপ্রিয় করতেও সাহায্য করেছিলেন জেমি, যেটির রন্ধনপ্রণালি ছিল বেশ সহজ। ভ্যানিলার একটি স্কুপের ওপর এসপ্রেসোর একটি শট ঢেলে দিলেই তৈরি হয়ে যায় এটি।
এদিকে, ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এম অ্যান্ড এস) ২০০৫ সালে মেল্ট ইন মিডল চকোলেট পুডিংয়ের প্রবর্তন করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিপণন পরিচালক স্টিভ শার্প স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘এটি শুধু একটি চকোলেট পুডিং নয়, এটি মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার…!’ ২.৪৯ পাউন্ড ওজনে, দুটি প্যাকেটে এটি বাজারজাত করা হয়। সুপারমার্কেটে পাওয়া অতি উচ্চমানসম্পন্ন রেডিমেড এই পুডিং একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল। একই সময়ে গু-লেমন চিজকেক এবং ক্রিম ব্রুলেস কাচের রামকিনসে বিক্রি হতো, যা সহজেই বাড়িতে নিয়ে আসা যেত। মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের তাকগুলোতে এখনো চকোলেট পুডিং পাওয়া যায়। এমনকি গত বছর চার লাখ প্যাক বিক্রি হয়েছে জনপ্রিয় এই পুডিং।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানান রকমের বৈচিত্র্য এসেছে পুডিংয়ে। এর জনপ্রিয়তা কখনোই কমেনি। এখন তো অনেক উৎসবের মূল ভোজ শেষে পুডিং ছাড়া যেন চলেই না!
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট