ফিচার I নামধারীর নামকরণ
প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডিং ও প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে সুন্দর নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রেও তা-ই। বিশ্বের বহুল পরিচিত রেস্তোরাঁগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে যেমন সৃজনশীলতা রয়েছে, তেমনি রেষারেষিও। বর্তমানে থিম বেইজড নাম রাখার ধুম পড়েছে
স্টারবাকস: এ রেস্তোরাঁর সহপ্রতিষ্ঠাতা গর্ডন বাওকার ছিলেন আড্ডাবাজ ও বইপ্রেমী। তার পছন্দের উপন্যাস ‘মবি ডিক’। বইটিতে নানান কিছু থাকলেও এর একটি চরিত্রকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাওকার। তা ছাড়া এই উপন্যাসের জাহাজ ‘পিকুড’-এর নামটি মনে ধরেছিল তার। তাই ওয়াশিংটনে নিজের কফিশপ খোলার ব্যাপারে বন্ধুদের সঙ্গে যখন পরামর্শ করছিলেন, তখন বন্ধুর পরামর্শের সঙ্গে নিজের পছন্দের নামটি মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন স্টারবাকস। তার বন্ধু তাকে বলেছিলেন ইংরেজি ‘এস’ ও ‘টি’—এই দুটি বর্ণ পাশাপাশি বসিয়ে একটি নাম চিন্তা করতে। ফলে তিনি পিকুড নামটি গ্রহণ না করে স্টারবাকসই নির্বাচন করেন।
ম্যাকডোনাল্ড: ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার জিডিপির চেয়ে চার গুণ বেশি আয় করেছিল এই প্রতিষ্ঠান। এটি যে এত লাভজনক প্রতিষ্ঠান হবে, তা অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন রেস্তোরাঁটির শুরুর দিকের মালিক রে ক্রক। মূলত ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নার্ডিনোতে বাস করা দুই ভাই রিচার্ডস ও ম্যাক ম্যাকডোনাল্ড মিলে চালু করেছিল এই রেস্তোরাঁ। তারা তাতে হ্যামবার্গার তৈরি করতেন। চাহিদাও ছিল বেশ। বাইরে থেকে তাদের উন্নতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছিলেন রে ক্রক। ফলে তিনি একসময় দুই ভাইয়ের কাছ থেকে রেস্তোরাঁটি কিনে নেন। এরপর বিক্রেতাদের সঙ্গে নিয়েই ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রোগ্রাম খোলেন নতুন এই মালিক। মূলত রে ক্রকের পুরো নাম রে ক্রক ম্যাকডোনাল্ড। তাই নতুন ও পুরোনো মালিকের নাম সমন্বয় করে রেস্তোরাঁর নাম দেন ‘ম্যাকডোনাল্ড’।
হোয়াটাবার্গার: বার্গারপ্রেমীদের কাছে আমেরিকান এই বার্গারের বেশ কদর। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বার্গার হাউসের দুই কর্ণধার হারমন ডবসন ও পল বার্টন। ডবসন সব সময়ই গতানুগতিক ধারার বাইরে চিন্তা করতেন। তিনি এমন অভিনব বার্গার তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যাতে সবাই তা মুখে দিয়েই বলে ওঠে ‘হোয়াট আ বার্গার’! এই চিন্তা থেকেই বার্গারের পেটির পুরুত্বে পরিবর্তন আনেন তিনি। সেকালের পেটি দুই ইঞ্চি পুরু হলেও তিনি তা চার ইঞ্চিতে উন্নীত করেন। ফলে সেই বার্গার খেতে ভোজনরসিকদের ব্যবহার করতে হয় দুটি হাত। তা ছাড়া এই পুরুত্বের বার্গার দেখে ভোক্তারা সত্যিই বিমোহিত হয়ে বলে উঠত—হোয়াট আ বার্গার!
ওয়েন্ডিজ: ফাস্ট ফুডের জগতে পরিচিত নাম ওয়েন্ডি। বর্তমানে আমেরিকার এই প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে ৬৫০০টি। তাই এর নাম ওয়েন্ডিজ। এই ভোজনালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ডেভ থমাস। ছোটবেলা থেকেই রেস্তোরাঁর মালিক হওয়ার আশা বুকে লালন করতেন তিনি। ২০ বছর ব্যবসা করার পর স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেয়। তিনি তার রেস্তোরাঁর নাম দেন ওয়েন্ডি। যা তার আদুরে মেয়ে মেলেনির ডাকনাম ছিল। তবে পাঁচ সন্তানের বাবা ডেভ থমাস কোনো সন্তানের প্রতি অবিচার করেননি। একে একে পাঁচ সন্তানের নামেই নাম রেখেছেন নিজের রেস্তোরাঁর। কিন্তু পরিচিতি পেয়েছে ওয়েন্ডি নামেই।
চিপটোলে: বারিতোস ও মেক্সিকান গ্রিলের জন্য আমেরিকায় বহুল পরিচিতি পেয়েছে রেস্তোরাঁটি। ১৯৯৩ সালে বাবার কাছ থেকে ৮৫ হাজার ডলার ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন স্টিভ ইলিস। সান ফ্রান্সিসকোতে থাকাকালীন ইলিস আমেরিকানদের গ্রিল ও বারিতোসপ্রীতি লক্ষ করেছিলেন। রেস্তোরাঁ থেকে লাভ করার জন্য তার দৈনিক ১০৭টি বারিতোস বিক্রির প্রয়োজন ছিল। সপ্তাহান্তে দেখা গেল, বিক্রির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ফলে খুব দ্রুতই উন্নতি ও পরিচিতি লাভ করতে থাকে ইলিসের ‘চিপটোলে’। এই রেস্তোরাঁর নামের বিষয়ে ইলিসের পরিবারের কারোরই মত ছিল না। তারা বলেছিলেন, নাম হিসেবে চিপটোলে খুবই কঠিন। কিন্তু ইলিস শেষমেশ এ নামই রাখেন।
ডমিনোজ: আগের নাম ডমিনিক। নামবদলের পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে। সালটা ১৯৬৩। টম ও জেমস মনাহান নামের দুই ভাই বাস করতেন আমেরিকায়। জীবিকার অন্বেষণে মিশিগানের ক্রস স্ট্রিটে একটি দোকান নেন তারা। সেখানে পিৎজা বেচা শুরু করেন। মিশিগানের এই ছোট দোকানের আগের মালিক ছিলেন ডমিনিক ডাইভার্টি। তিনি এখানে পিৎজাই বিক্রি করতেন। ডমিনিক পিৎজা নামে। ওই দুই ভাই এই নাম পরিবর্তন না করেই পিৎজার ব্যবসা চালিয়ে যান এবং আগের মালিকের চেয়ে বেশি সফল হন। এবার দুই ভাই চাইলেন তাদের পিৎজার নামের ব্র্যান্ডিং করতে। তাতে বাধা দেন আগের মালিক। সাফ জানিয়ে দেন, ডমিনিক নামটি ব্যবহার করা যাবে না। সমস্যার সমাধানে ‘ডমিনোজ’ নামটি প্রস্তাব করেন ওই রেস্তোরাঁর একজন পিৎজা ডেলিভারিম্যান। শেষে জন কেনেডি নামের ওই ডেলিভারিম্যানের প্রস্তাব গ্রহণ করেই এই রেস্তোরাঁর ব্র্যান্ডিং হয় ডমিনোজ নামে, যা এখন ভুবনবিখ্যাত।
চিক-ফিল-এ: মুরগির মাংসের স্যান্ডউইচের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি আটলান্টার এই রেস্তোরাঁর। এখানে বছরে যে কয়টি মুরগি লাগে, সেগুলো পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে পুরো পৃথিবী একবার প্রদক্ষিণ করা হবে বলে তথ্য দিয়েছে বাজফিল্ড। রেস্তোরাঁটি বিখ্যাত হয়ে উঠতে লেগেছে বেশ কয়েক বছর। ১৯৪৬ সালে এটি চালু হয়। প্রায় ১৮ বছর ধরে এতে চলতে থাকে কেবলই গরু ও শূকরের মাংসের আইটেম। পরে ১৯৬৪ সালে এর মেনুতে যোগ হয় মুরগি। এতেই ভাগ্য খুলে যায় রেস্তোরাঁটির। মুরগির মাংসের স্যান্ডউইচের এত চাহিদা দেখে রেস্তোরাঁর নামে বদল আনেন এর মালিক ট্রুয়েট ক্যাথি। পুরোনো ‘দ্য ডোয়ার্ফ গ্রিল’ বদলে নতুন নাম দেন ‘চিক-ফিল-এ’। নামবদলের কাজটি তিনি করেন ১৯৬৭ সালে।
যাহোক, আগের রেস্তোরাঁগুলোর নাম সাধারণত এভাবেই রাখা হতো। কিন্তু সমকালের পালে লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া। এখন অনেক রেস্তোরাঁই সাজে থিম অনুসারে। নামও রাখা হয় সেভাবেই। ক্যাফেগুলোও চলছে সেই পথে। এ ক্ষেত্রে কলকাতার কিছু সুপরিচিত ক্যাফে ও রেস্তোরাঁর নাম আসতে পারে। যেমন ‘দ্য বাইকার্স ক্যাফে’। এর ভেতরটা সাজানো হয়েছে নানান যুগের মোটরসাইকেলের সমারোহে। ‘কয়েদি কিচেন’ রেস্তোরাঁয় রাখা হয়েছে কারাগারের আবহ। ঢুকলেই মনে হবে জেলখানা! আবার বাঘ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা বাড়াতে খোলা হয়েছে ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার ক্যাফে’। ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোর নামকরণেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন গুলশানে ‘ইজুমি’। জাপানি এই শব্দের অর্থ ঝরনা কিংবা বসন্ত। এর খাবারগুলোও জাপানি। আরেকটি থিমেটিক রেস্তোরাঁ হলো বনানীর ‘ক্লাব হুইলস’। এর স্বত্বাধিকারী মোটর বিজনেসম্যান হওয়ায় সেই প্রভাব পড়েছে তার প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁতেও। গাড়ির ইঞ্জিন খোদাই করা চেয়ার কিংবা স্পোর্টস কারের টেবিল—সবই মুগ্ধ করে অতিথিদের।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট