skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I ডায়াবেটিস ডায়েট

১৪ নভেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিস ডে’। প্রভাববিস্তারী এই ব্যাধির ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে পালিত হয় বিশ্বজুড়ে। পরামর্শ দিচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

দিন যত যাচ্ছে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা যেন বাড়ছে। এটি হরমোনজাতীয় রোগ। অন্যদিকে, ইনসুলিন এমন এক ধরনের হরমোন, যা আমাদের দেহে অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস থেকে সৃষ্টি হয়। বিশেষত, আমরা যখন শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার গ্রহণ করি, তা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো মানবদেহের কোষগুলোয় গ্লুকোজ পৌঁছে দেওয়া। আর গ্লুকোজের কাজ হলো শরীরে শক্তি দেওয়া। সত্যি বলতে, গ্লুকোজের কারণেই আমরা সারা দিন সঠিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা লাভ করি। তবে ইনসুলিনের ঘাটতি হলে গ্লুকোজ শরীরের কোষে পৌঁছাতে পারে না। ফলে গ্লুকোজের আধিক্য দেখা দেয় রক্তে। তাতেই বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা বহুমূত্র রোগ।
লক্ষণ দেখে চেনা
ডায়াবেটিসের রয়েছে কিছু কমন উপসর্গ। অনেকে এ ধরনের লক্ষণগুলোকে বুঝতে পেরেও এড়িয়ে চলেন। ফলে পরবর্তীকালে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ঝুঁকি দেখা দেয়। লক্ষণগুলো হলো—
 ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া;
 হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া;
 অতিরিক্ত পিপাসা পাওয়া;
 অবসাদ বা ক্লান্তি ভাব হওয়া;
 খাওয়ার পরও বারবার খিদের অনুভূতি হওয়া;
 হঠাৎ কোথাও কেটে গেলে সহজে ক্ষত না সারা;
 চোখে নানা সমস্যা হওয়া, বিশেষত ঝাপসা দেখা…ইত্যাদি।
ডায়াবেটিস একটি মেটাবলিক ডিসঅর্ডার। এটি মূলত দুই রকম—টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিসকে সাধারণত শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিস বলা হয়। এসব রোগীর ক্ষেত্রে ইনসুলিন তৈরি হওয়ার জন্য অগ্ন্যাশয়ের যে কোষগুলো থাকে, সেগুলো ধ্বংস হতে থাকে। ফলে সঠিকভাবে কোষ তৈরি হতে না পারায় রক্তে ইনসুলিনের ঘাটতি দেখা দেয় এবং গ্লুকোজের লেভেল বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে শরীরে বাইরে থেকে ইনসুলিন প্রবেশ করানোর প্রয়োজন পড়ে।
অন্যদিকে, পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন অগ্ন্যাশয়ের মাধ্যমে তৈরি হতে না পারার ফলে রক্তে ইনসুলিনের ঘাটতি দেখা দিয়ে সৃষ্টি হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস মেলাইটাস। এটি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষত ৪০ বছরের পর বেশি দেখা দেয়।
আরেক রকম ডায়াবেটিস আছে, যা শুধু গর্ভবতী মায়েদেরই হয়ে থাকে। একে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস বলা হয়। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থায় দেখা দিলেও সন্তান প্রসবের পরও দু-তিন মাস পর্যন্ত রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য থাকতে পারে। তবে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের সঠিক নিয়ম অনুসরণ করলে ধীরে ধীরে এটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং পরবর্তীকালে ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো নির্মূল হয়ে যায়।
সতর্কবার্তা
ডায়াবেটিস কোনো কিউরেবল রোগ নয়, তবে কন্ট্রোলেবল। ডায়াবেটিস রোগীরা অতিমাত্রার বা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নিয়ে সতর্ক থাকলেও আরেকটি বিষয়ে অনেকে বেশ অসচেতন থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীর হঠাৎ ডায়াবেটিস কমে নানা রকম দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়, যাকে বলে হাইপো গ্লাইসেমিয়া। কোনো কোনো ডায়াবেটিস রোগী রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যের কথা চিন্তা করে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই পরিমাণের চেয়ে কম কিংবা বেশি ইনসুলিন গ্রহণ করে ফেলেন। ফলে খাবার গ্রহণের পর ইনসুলিনের অপর্যাপ্ততা, অথবা পরিমাণের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণের ফলে রক্তে সুগারের মাত্রার ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এতে মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে পারেন রোগী। এমনকি ঘটতে পারে প্রাণহানিও। তাই ‘হাইপো’ হওয়ার লক্ষণগুলো জানা থাকা ভালো।
রোগীর রক্তে সুগারের মাত্রা তিন বা তার কম হতে থাকলে তাকে হাইপো ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরানো, এমনকি অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাও ঘটতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অতি দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য রোগীর মুখে গ্লুুকোজ কিংবা চিনি দিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় রোগী হাইপো গ্লাইসেমিক শকে চলে যেতে পারেন।
বাতিলের খাতা
অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিস হলে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে সব ধরনের খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দিতে হবে। এতে মানসিক যন্ত্রণা থেকে ডিপ্রেশন শুরু হতে পারে রোগীর। অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার কথা গোপন রাখারও চেষ্টা করেন। ডায়াবেটিস হলে সবচেয়ে বেশি সতর্ক হতে হবে খাবারদাবার বা ডায়েটে, তাতে সন্দেহ নেই। তার মানে, অবশ্যই ডায়াবেটিস ডায়েট ফলো করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে যেসব খাবার অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চিনি, মিষ্টি, গুড়, গুড়ের পিঠা, কোল্ড ড্রিংকস, বেকারি আইটেম, কুকিজ, হরলিকস, কেক, পেস্ট্রি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি। এ ছাড়া প্যাকেটজাত কোনো খাবার গ্রহণ করার সময় প্যাকেটে উল্লেখিত নিউট্রিশনাল ভ্যালু জেনে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে যেসব প্যাকেটজাত খাবারে সুগার যোগ করা থাকে, সেগুলো অবশ্যই খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে; যেমন জুস, কেচাপ, সস, জেলি ইত্যাদি।
যা খাবেন
ডায়াবেটিস রোগীরা হরদমই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন কোন খাবার খাবেন, কোনটি খাবেন না তা নিয়ে। অনেকে আবার কার্বোহাইড্রেট বাদ দিয়ে দিতে চান। সে ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন জটিলতা। মনে রাখতে হবে, এমন রোগীর ক্ষেত্রে ভাত, রুটি, আলু—কোনোটাই সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, তা নয়। তবে সুগারজাতীয় খাবারগুলো সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া দরকার। তাই খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন এগুলো:
 লাল চালের ভাত: ডায়াবেটিস রোগীরা ভাত খাওয়া নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন। তবে সারা দিনে এক বেলা ভাত তো খাওয়া যেতেই পারে। যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, আবার ভাতও খেতে চান, তারা খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন লাল চালের ভাত। এটি উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় রক্তের সুগার ধীরে ধীরে বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ক্ষতিকর নয়।
 লাল আটার রুটি: যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, তাদের জন্য এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সে ক্ষেত্রে সারা দিনে অন্তত দুই বেলা লাল আটার রুটি হতে পারে আপনার বেস্ট চয়েস। ডায়াবেটিস হলে অনেকেরই নার্ভের দুর্বলতা হতে দেখা দেয়। লাল আটার রুটিতে থাকা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আপনার স্নায়ুর জটিলতা কমাতে সাহায্য করবে।
 ওটস: ব্রেকফাস্ট কিংবা ডিনারে যাদের গতানুগতিক ভাত বা রুটি খেতে খেতে একঘেয়েমি লাগছে, তারা মেইন কোর্স হিসেবে রাখতে পারেন ওটস। এটি হাই ফাইবার সমৃদ্ধ। এ ছাড়া এতে রয়েছে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, কপার ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য এসব উপাদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
 স্যালাড: বিভিন্ন ধরনের স্যালাড রাখা যেতে পারে খাদ্যতালিকায়। শসা, কাঁচা পেঁপে, লাল ও হলুদ ক্যাপসিকাম, লেটুস, লেবু ও পুদিনাপাতার মিশ্রণে তৈরি এক বাটি স্যালাড একজন ডায়াবেটিস রোগীর জন্য হতে পারে বিকেলের বেস্ট স্ন্যাকস।
 ফুট বোল: ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা অনেক সময় ফল খাওয়া নিয়েও দুর্ভাবনায় ভোগেন। ডায়াবেটিস হলে ফল খাওয়ায় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা নেই; বরং সব ধরনের ফল মিশ্রিত এক বাটি মিক্সড ফ্রুট নিতে পারেন মধ্য সকালের হেলদি নাশতা হিসেবে। অবশ্য অতিরিক্ত মিষ্টি ফল কম খাওয়া কিংবা সম্ভব হলে বাদ দেওয়াই ভালো।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top