skip to Main Content

রসনাবিলাস I স্বর্গীয় অ্যাটিটিউড!

রাজধানীর বুকে খাবারের মন্ত্রমুগ্ধকর সমাহার। স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেওয়ার মতো! লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

ক্যানভাসের এবারের গন্তব্য ছিল হলিডে ইন হোটেলের অ্যাটিটিউড রেস্টুরেন্ট। বৈশ্বিকভাবে তিন তারকা এই হোটেলের লবির হোয়াইট লোটাসে আমেরিকানোয় চুমুক দিতে দিতে জানা গেল, বাংলাদেশে তারা চার তারকার সব সুযোগ-সুবিধা দিতে চলেছে। কথাগুলো বলছিলেন মার্কেটিং কমিউনিকেশনস ম্যানেজার মোহাম্মাদ সাজ্জাদ হোসেন। অবশ্য স্বাগত জানিয়েছিলেন এর আগে শেফ নিজে লবিতে এসে। পরিচয় পর্বে জানা গেল এক্সিকিউটিভ শেফ নিলেশ দে দুনিয়ার বড় বড় জায়গায় কাজ করে এসেছেন; পরিচয়ে তিনি বাঙালি, তবে বাংলার নন, দিল্লির। ভারতীয় খাবারে তার বেশ হাতযশ আছে, তেমনটাই জানতাম। কথা প্রসঙ্গে মোহাম্মাদ সাজ্জাদ জানিয়ে দিলেন, এই লবিতে সন্ধ্যার জমজমাট আড্ডার সঙ্গ হিসেবে দারুণ সব প্যাকেজ রয়েছে।
এরপর লালগালিচার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেই দর্শন পেলাম অ্যাটিটিউডের। সিঁড়ির ওপরে হলুদ আলোর জাহাজ-আকারের ঝাড়বাতি। রিসেপশন বাঁয়ে ফেলে এগোতেই সারি সারি টেবিল-চেয়ার। ডানে ঘুরলে মূল ডাইনিং, সেখানে এক প্রান্তে কোনো এক বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থার অনুষ্ঠান চলছিল। তার উল্টো দিকে, অর্থাৎ সিঁড়ির ঠিক পেছনের দিকটায় বুফে কাউন্টার। আর সেটার পেছনে কাচে ঢাকা এল শেপের লাইভ কিচেন। এখনকার যুগে যা যা প্রয়োজন একটা আধুনিক রেস্টুরেন্টের রসবতীতে, তার সবটাই আছে—জানালেন শেফ।
শেফ রসুইয়ের তদারকিতে আমাকে একলা ফেলে গেলেন বিশাল রেস্টুরেন্টে, ক্ষণিকের জন্য। তখন ভালোমতো নজর দিলাম। সাদা ফলস সিলিং থেকে হলদে-আলোর সঙ্গে দেয়ালের ভাররক্ষক লাইটের ক্রিম টাইলস চমৎকার মানিয়ে গেছে। আর এক পাশের দেয়ালে কাঠের মুর‌্যাল তো চমৎকার। পুব দিকের কাচের দেয়াল ভেদ করে প্রাকৃতিক আলোও ঢোকে বেশ। মেহগনি রঙের টেবিলের সঙ্গে ধূসরাভ চেয়ার—সব মিলিয়ে বেশ কোজি আর কম্ফি ভাইব দেয়।
চারপাশ দেখতে দেখতেই টেবিলে এলো অহ-দে’ভ (শুরুর পদ) হিসেবে স্যালাড আর অ্যাপেরিতিফ (ক্ষুধাবর্ধক) হিসেবে শরবা। স্যালাডের চমৎকার, শৈল্পিক পরিবেশনা। সত্যি বলতে খাবারের ব্যাপারে আমি প্রথমে দর্শনদারি, পরে গুণবিচারি। খুব সাধারণ স্যালাড—টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা, বিট আর খানিকটা মিষ্টি স্যালাড ড্রেসিং দিয়ে চমৎকার খেতে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে সেন্ট্রাল ইউরেশিয়ার কোথাও প্রথম রান্না হয়েছিল শরবা। অবশ্য ইতিহাসে এই ‘শরবা’ নামের প্রথম খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল দশম শতকের আরব রান্নার বই কিতাব-আল-তাবিখে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল ঠিক কীভাবে ষষ্ঠ শতাব্দীর পারসিক রসুইঘরে রান্না হতো এই জিনিস। ভারতবর্ষে শরবার নাম প্রথম পাওয়া গেছে শের শাহের দরবারি খাবারে (অবশ্য তার আগে ভারতবর্ষে স্যুপ ছিল না, তা বলা যাবে না)। টমেটো শরবা খেতে অসাধারণ, আর কে না জানে খাওয়ার আগে টমেটো খেলে পেটে ইঁদুরের নৃত্য শুরু হয়!
এরপর এলো হালিম। ধারণা করা হয়, মুসলিম শাসনামলের শুরুতে আরব্য এই পদ ইরান, আফগানিস্তান হয়ে এসেছিল ভারতবর্ষে। সম্রাট আকবরের বন্ধু ও জীবনীকার আবুল ফাজ্ল্ ‘আইন-ই-আকবারি’তে ২০ রকমের বেশি হালিম হতে পারে বলে জানালেও বিশদ বিবরণ দেননি একটারও। তবে অ্যাটিটিউড রেস্টুরেন্টে তিন পদের হালিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। সঙ্গে একটা বাটিতে সামান্য ঘি-গোলমরিচের গুঁড়া। ঢাকার আর ভারতীয় রন্ধন তরিকার চমৎকার মিথস্ক্রিয়া। হালিমের ডাল একেবারে থিকথিকে, দানাদার নয়—যেমনটা হয় ভারতীয় বা পাকিস্তানি তরিকায়; আবার মাংসগুলো চাংকি, পেস্ট করে মেশানো নয়—আমরা যেমনটা খাই। আবার তেঁতুলের টক নয়, লেবু আর ঘি দিয়ে পরিবেশিত হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, শর্টকাটে একই ডাল-গম মিশিয়ে কেবল পরে তিন বাটিতে তিন পদের মাংস মিশিয়ে দিল কি না! পরে মুখে দিয়ে বোঝা গেল, প্রতিটার স্বাদ ভিন্ন। এক বসায় তিন ধরনের হালিমের স্বাদ পেয়ে আমি রীতিমতো মুগ্ধ! শেফ জানালেন, পুরান ঢাকার অলিগলি ঘুরে নানা ধরনের হালিম খেয়ে তিনি ঢাকার স্বাদ বুঝেছেন আগে, তারপর তার ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করেছেন এই হালিমগুলো। আমি লাজওয়াব হয়ে তখনো মাংস চিবোচ্ছি—এটাকে অ্যাটিটিউডের মাস্ট ট্রাই আইটেমের তালিকায় না রাখলে পাপ হবে!
খাওয়াদাওয়ার মাঝেই শেফের সঙ্গে ভারতীয় খাবার, খাবারের সীমানা, মিথস্ক্রিয়া নিয়ে নানা আলাপ চলছিল। সে অবশ্য অন্য গল্প। এই গল্পে বাদ সাধল প্লাত ফাসিপালের (মেইন কোর্স) দ্বিতীয় ভাগ। টেবিলে এলো কাবাব প্লেটার—কালাঞ্জি (কালোজিরে) নান, সঙ্গে মুরগির চার পদ—তান্দুরি, টিক্কা, রেশমি, মালাই আর মাছের এক পদের কাবাব। সঙ্গে হায়দরাবাদি লালপিঁয়াজ স্যালাড। সব কাবাবই উম্দা, তবে মালাই কাবাবের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। চমৎকারভাবে শ্যাডার চিজের সঙ্গে ক্রিমি টেক্সচারের এই কাবাব, বিশেষণ দেওয়া মুশকিল।
কাবাব যখন উপভোগ করছি, তখন শেফ জানালেন, কীভাবে ঢাকার একটি পশ রেস্টুরেন্টের কর্ণধারকে তিনি জব্দ করেছিলেন, স্রেফ কাবাব খাইয়ে। সে গল্প লম্বা হতে হতে চাপলি কাবাব, গালৌতি, কাকোরি কাবাবকে ছুঁয়ে তুর্কিস্তানের আগুনে পোড়া মাংসের থেকে পেছন দিকে রামায়ণ-মহাভারত যুগে শুল্যপক্ক মাংসে পৌঁছে গিয়েছিল।
এরপর এলো তিন ভাগের মেইন কোর্সের তৃতীয় ভাগ। লখনৌয়ি ডাল দারা-ই-নাওয়াব, ডাল মাখনি, পাঞ্জাবি পিন্ড কি ডাল মাখনি, হায়দরাবাদি শাবনাম পনির, হায়দরাবাদি পনির কোরমা, লখনৌয়ি ভেজ কোরমা এলো প্রথমবারে, সঙ্গে সাইডস হিসেবে নান, তান্দুর রুটি ও জিরা ভাত। ভেবেছিলাম এটুকুই। পরে একটু বিরতি দিয়ে আসতে থাকল শাহি ভুনা, কালা ভুনা, চিকেন টিক্কা মাসালা, মাটন নিহারি, নিযামি চিকেন কারি, মাটন কারি আর হায়দরাবাদি ল্যাম্ব বিরিয়ানি। চোখ সত্যিই কপালে ওঠার জোগাড়। নিজেকে লখনৌ বা হায়দরাবাদের বখে যাওয়া নাওয়াবযাদা মনে হতে লাগল। শেফের মুনশিয়ানা আর পরিমাণের ভেল্কিবাজিতে জব্দ হতেই হলো। এ ধরনের জব্দ হতেও যে সুখ!
কালা ভুনার স্বাদ খানিকটা ভিন্ন মনে হয়েছে, ঝালের মাত্রার তারতম্যের কারণে; অবশ্য চাটগাঁইয়া ঝাল স্টার রেটেড রেস্টুরেন্টে দিলে মামলা ঠুকে দিতে পারেন গোরা সাহেবেরা! তাই সেটার আশাও করিনি, তবে ঝালের তারতম্যে সেটা অন্য এক স্বাদে, অন্য এক নোটের খেলোয়াড়, যেটা মন্দ নয়। মাটন নিহারি—মাস্ট ট্রাই আইটেম, এই লেভেলের গোশ্ত নিহারি এ শহরে দুর্লভ। দারা-ই-নাওয়াব আর পি- কি ডাল মাখনি—ডালখোরদের ভিন্ন স্বাদ দেবে নিশ্চিত, প্রথমটি রাজদরবারের আর দ্বিতীয়টি পাঞ্জাবের গ্রামীণ খাবার। শাবনাম পনির, পনির কোরমা, নিযামি চিকেন কারি আর ভেজ কোরমা—সবই দরবারি খাবার, কেবল মাটন কারিটাই ছিল সাধারণ মানুষের খাবার, তবে অসাধারণ স্বাদের। এত খাবার কি একবারে আটে পেটে! তাই অল্প করে চেখে দেখা হলো সব।
তবে এখানেই শেষ নয়, আমার অবস্থা তখন অনেকটা গোপাল ভাঁড়ের মতো: বেশি খেয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকা গোপাল ভাঁড়কে যখন বড়ি খেতে দেওয়া হয়েছিল, সে উত্তর দিয়েছিল—‘বড়ি খাওয়ার জায়গা থাকলে তো আরেকটা পানতোয়াই খাওয়া যেত!’ তাই ডেজার্টের কথা মুখে তুলতেই আত্মসমর্পণের হাত তুললুম। তাতে কি আর শেফ মানেন? বললেন, ‘মিষ্টি বানানো হয় সব ইন হাউস উপকরণ দিয়ে; না খেলে পস্তাবেন!’ অগত্যা প্রথমে দিলেন সহবে, তবে প্যালেট ক্লিনজার হিসেবে। চমৎকার লেবু আর স্টার অ্যানাইজের স্বাদে। এরপর এলো আকাঙ্ক্ষিত শেষ পাতে মিষ্টিমুখ। চমৎকার পরিবেশন, একদিকে একগাদা ফল, আর এক পাশে ছানার সন্দেশ এবং ক্রিমের পুর দেওয়া ছানার মিষ্টি। মাঝখানে একরত্তি চকোলেটও উঁকি মারছিল। এ এক স্বর্গীয় ভোজপর্ব! মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—
‘আগার ফিরদাউস বার রু-ই জামিন আস্ত্
ঘামিন আস্ত্—ও হামিন আস্ত্—ও হামিন আস্ত।’

ঢাকা শহরে অথেনটিক ইন্ডিয়ান কুজিনের জাদুকর হাজির হয়েছেন, তা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।
ঠিকানা: অ্যাটিটিউড, হলিডে ইন, ঢাকা সিটি সেন্টার, ২৩ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, তেজগাঁও, ঢাকা-১২০৮। ফোন: ৯৬৩৮ ৫৫৫ ৬৬৬।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top