তনুরাগ I অঙ্গে আকর্ষী
মুখত্বকের জেল্লা বাড়াতে ক্লিনআপ, মাসাজ, ফেশিয়াল—বাদ পড়েনি একটিও। কিন্তু শরীরের জৌলুশ? জীবনের বিশেষ দিনটাকে এক্সট্রা স্পেশাল করে তুলতে বাড়তি যত্নআত্তিটুকুর পুরোটাই কিন্তু প্রাপ্য
নববধূর সৌন্দর্যে মুখের মতোই গুরুত্বপূর্ণ শরীরের বাকি অংশ। বরং একটু বেশিই বিশেষ। কারণ, মুখত্বক তো থাকবে মেকআপের আড়ালে। তার ওপর টিকলি, নাকছাবি আর ওড়নার ভাঁজে ঢেকে যাবে অনেকখানি। তারপরে যতটুকু চোখে পড়বে, ততটুকু ত্বকের খুঁত ঢাকার অন্তত একশ পথ রয়েছে। হাত, পিঠ বা শরীরের অন্য অংশগুলোয় যত্নের অভাব হলে তো তা ঢাকারও অপশন হাতে গোনা। যত্নই বরং জুতসই সমাধান। মুখের জন্য যেমন নানা ধরনের ফেশিয়াল রয়েছে, তেমনি শরীরের বাদবাকি অংশের জন্য রয়েছে বডি পলিশিং, বডি র্যাপ এবং মাসাজ। বিয়ের বিশেষ দিনে সর্বাঙ্গের জৌলুশ বাড়াতে লাক্সারি এসব ট্রিটমেন্ট রিল্যাক্সেশনের জন্যও চমৎকার বিকল্প। বিয়ের ব্যস্ত দিনগুলোর মাঝে খানিকটা মি টাইম দেহের জেল্লা আর দীপ্তি বাড়ানোর দারুণ দাওয়াই।
বডি র্যাপ, পলিশিং আর মাসাজ। তিনটিই পুরো শরীরের যত্ন নেওয়ার জন্য উপযোগী। তবে উপকারিতায় অল্পবিস্তর ফারাক আছে। বডি মাসাজের মূল কাজ শরীরের রক্তসঞ্চালন ত্বরান্বিত করা। এতে মাসল রিল্যাক্সড হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিশেষায়িত মাসাজ ক্রিম ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকে জেল্লাও ফিরিয়ে আনে। তবে মাসাজের মূল কাজ রিল্যাক্সেশন। বডি পলিশ বিশেষত ত্বকের উপরিভাগে থাকা মৃত কোষ, ধুলাবালি আর ঘামের পরত সরিয়ে ত্বক মসৃণ করে। এতে ত্বক নরম হয়, বাড়ে উজ্জ্বলতা। পাশাপাশি সেল রিনিউয়াল প্রসেস ত্বরান্বিত হয়। অন্যদিকে বডি র্যাপের ব্যাপারটা অনেকটা ফেশিয়ালের মতো। এতে রক্তসঞ্চালন যেমন বাড়ে, তেমনই ত্বকের মৃতকোষ দূর হয়, আবার ত্বক পুষ্টিও পায়। তাই এই তিনটা প্রক্রিয়ার মধ্যে বডি র্যাপে সময় সবচেয়ে বেশি লাগে। তবে উপকারও সবচেয়ে বেশি এ পদ্ধতিতে। বডি পলিশিং আর র্যাপ—দুই ক্ষেত্রেই প্রথমে এক্সফোলিয়েট করে নেওয়া হয় ত্বক। তারপর ব্যবহার করা হয় মাস্ক। যেহেতু এই দুই পদ্ধতিতেই বেশ কিছু স্টেপ কমন, তাই মসৃণতা আর জেল্লা কমবেশি দুটোতেই পাওয়া যায়। বিয়ের মতো বিশেষ আয়োজনের প্রস্তুতিতে বডি র্যাপ আদর্শ। তবে ত্বকে বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলে সঙ্গে বডি পলিশিং করে নিলে তো সোনায় সোহাগা। বডি মাসাজ বিয়ের পরেও দারুণ উপযোগী। বিয়ের কয়টা দিন শরীর-মনের ওপর দিয়ে তো কম ধকল যাবে না, বিয়ের পরে তাই ফুল বডি মাসাজের রিল্যাক্সেশন দারুণ কাজে দেবে।
বডি র্যাপের বিভিন্নতা
এটি মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। সব র্যাপের উপকারিতা এক নয়। অনেক র্যাপ আছে যা স্লিমিংয়ের জন্য দারুণ কাজের। এ ছাড়া আছে ডিটক্স আর হাইড্রেটিং র্যাপ।
ডিটক্স র্যাপ
এ ধরনের র্যাপের মূল উপাদান নানা ধরনের সি-উইড, অ্যালগি, মাড, ক্লে বা জেল। যার প্রতিটি শরীরে জমে থাকা টক্সিন বের করে দিতে সহায়ক। এ ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি মাস্ক মেখে পুরো শরীর ঢেকে ফেলা হয়। এর ওপর প্লাস্টিক বা ওই জাতীয় অন্য কোনো শিট দিয়ে পুরো বডি জড়িয়ে রাখা হয় মিনিট বিশেকের জন্য। শীতে এর ওপর আরও ভারী কিছু দিয়ে র্যাপ করা হয়, যাতে ত্বক উষ্ণতা পায় এবং মাস্ক ভালোভাবে অ্যাবসর্ব হতে পারে। এতে শরীরের গভীর থেকে ডিটক্সিফিকেশন প্রসেস শুরু হয়। ত্বকের রক্তসঞ্চালন বাড়ে এবং শরীরে সঞ্চিত টক্সিনের কারণে মিনারেলের যে ঘাটতি তৈরি হয়, তা পূরণ হতে শুরু করে। শেষে র্যাপ খুলে মাস্ক পরিষ্কার করে মুছে বডি লোশন মাসাজ করে দেওয়া হয়। চাইলে গোসলও সেরে নেওয়া যাবে বডি র্যাপের পর। যেহেতু এই র্যাপগুলো ডিটক্সিফিকেশনের জন্য তৈরি, সে ক্ষেত্রে ডিটক্স ডায়েট এবং লাইফস্টাইলের সঙ্গে এর যোগে ভালো ফল মিলবে। ডায়েটে পিৎজা, চিপস, কোল্ড ড্রিংকস আর চকোলেট রেখে এই বডি র্যাপ করালে লাভের লাভ কিছুই হবে না। বিয়ের আগে যাদের ডিটক্স রেজিম মেনে চলার পরিকল্পনা রয়েছে, তাদের জন্য এই র্যাপ জুতসই অপশন।
হাইড্রেটিং র্যাপ
ত্বকের হারিয়ে যাওয়া আর্দ্রতা পুনরুদ্ধারই এর মূল উদ্দেশ্য। এই প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের ক্রিম ও জেল ব্যবহার করা হয়। ফলে ত্বক ঠান্ডা থাকে, পর্যাপ্ত আর্দ্রতার জোগান পায় বলে বাড়ে কোমল ভাব। শীতের রুক্ষ আবহাওয়ায় এই র্যাপ রীতিমতো জাদুর শামিল। প্রথমে বিভিন্ন ধরনের বডি সল্ট ব্যবহার করে বডি স্ক্রাব করে নেওয়া হয়। এতে ত্বকের ওপর জমে থাকা মৃতকোষের পরত দূর হয়। তারপর ব্যবহৃত হয় ঘন বডি ক্রিম। শরীর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিয়ে তারপর বডি র্যাপের পালা।
স্লিমিং র্যাপ
স্পেশালাইজড বডি র্যাপ ট্রিটমেন্ট এটি। যাতে মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের মিনারেল সলিউশন। হাই কনসেনট্রেটেড এই সলিউশনে কাপড় ডুবিয়ে তা দিয়ে আঁটসাঁটভাবে জড়িয়ে নেওয়া হয় পুরো শরীর। এতেও শরীরের খানিকটা ডিটক্সিফিকেশন হয়, সেই সঙ্গে মিনারেলের ঘাটতি পূরণ হয়।
বিয়ের আগে বিশেষ ধরনের বডি র্যাপ ট্রিটমেন্ট ত্বকের জেল্লা বাড়াবে অনেকখানি। তবে ত্বকের ধরন ও চাহিদা বুঝে তবেই বেছে নিতে হবে এসব ট্রিটমেন্ট। যেমন চন্দনে তৈরি বডি র্যাপ ডিটক্সিফিকেশনের জন্য দারুণ। সানবার্ন, ট্যানিং কমানোর জন্য চন্দনের গুণের কথা কে না জানে। এ ছাড়া ত্বক টোন করার পাশাপাশি, অ্যান্টি এজিং এজেন্ট হিসেবেও চন্দনের গুণ দুর্দান্ত। বিয়ের আগে চটজলদি ত্বক উজ্জ্বল করতে এই র্যাপের তুলনা নেই। এতে ত্বক পরিষ্কারও হয়। র্যাপ করার আগে রিল্যাক্সি বডি মাসাজ দিয়ে রক্তসঞ্চালন বাড়ানো হয়। তারপর হয় এক্সফোলিয়েশন। ত্বকের ওপরের স্তর সরে যাওয়ায় পরবর্তী ধাপে চন্দনের মাস্ক সহজেই ত্বকের গভীরে প্রবেশ করে। ত্বকের পোরস পরিষ্কার হয় গভীর থেকে। ফলে ওপেন পোরসের সমস্যা কমে এবং ট্যানও দূর হয় যায়। ত্বকে দাগছোপ থাকলে নির্দ্বিধায় এই র্যাপ বেছে নেওয়া যায়। হাইড্রেটিং বডি র্যাপের জন্য কফি ও মিল্ক র্যাপ দারুণ কাজের। ত্বক উজ্জ্বল করবে, সঙ্গে শরীর থেকে টক্সিনও বের করে দেবে। কফিতে থাকা ক্যাফেইন শরীরের সেলুলাইট ডিপোজিট কমায়। ময়শ্চারাইজেশন এবং নারিশমেন্টের পাশাপাশি ত্বকে ব্লাড সার্কুলেশনও বাড়ায় এই ট্রিটমেন্ট। ফলে ত্বক উজ্জ্বল দেখায়, বাড়ে জৌলুশ। দৈনন্দিন ব্যস্ততায় যারা একেবারে ত্বকের যত্ন নেওয়ার সুযোগ বা সময় পান না, বিয়ের আগে ত্বকের পুনরুজ্জীবনে এই র্যাপ ট্রিটমেন্ট তাদের জন্য অব্যর্থ। স্ট্রেস, টেনশন কমাতেও দারুণ কার্যকর। বিয়ের মাসখানেক আগে থেকে সপ্তাহ তিনেক পর একবার করে বডি র্যাপ করে নেওয়া যেতে পারে।
বডি র্যাপের ক্ষেত্রে এক্সফোলিয়েশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এ জন্য সি সল্ট বা সুগার বেসড স্ক্রাবের ব্যবহার করা হয়। এতেও থাকে নানা ধরনের ভ্যারিয়েশন। গ্লো সল্ট, ডেড সল্ট, ব্রাউন সুগার, গ্লো সুগার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এ ক্ষেত্রে। সবক্ষেত্রেই এগুলোর সঙ্গে নানা ধরনের মাসাজ অয়েল মিক্স করে নেওয়া হয়। বাড়িতে বসে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসেনশিয়াল অয়েলও মিশিয়ে নেওয়া হয় অনেক সময়। একই রকম উপকারিতা মেলে।
প্রকারভেদে বডি পলিশিং
বডি পলিশিংয়েরও রয়েছে নানা অপশন। কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েন্ট ছাড়াও প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ ট্রিটমেন্ট এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি সৌন্দর্যসচেতনদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চক্র সল্টস বডি পলিশিং। পাঁচ ধরনের সি সল্ট, মিনারেল এবং এসেনশিয়াল অয়েলের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। প্রতিটি সল্ট আলাদা ধরনের সমস্যা সমাধানে কাজ করে। এর মধ্যে অরেঞ্জ সল্ট ত্বকের পেলবতা বাড়ায়, লাবণ্য ফিরিয়ে আনে। ইয়েলো সল্টের কাজে ত্বকের এনার্জি ফিরিয়ে আনা, দৃঢ়তা বাড়ানো। গ্রিন সল্ট ত্বককে যৌবনদীপ্ত করে তোলে। ব্লু সল্ট বাড়ায় জেল্লা। পিঙ্ক সল্ট ত্বক নরম ও কোমল করে তোলে। এই চক্র সল্টগুলো শুধু ত্বকের ওপরই নয়, কাজ করে নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়েও। মন শান্ত করে, ক্লান্তি দূর করে, শরীরে স্ফূর্তিও জোগায়। বিয়ের আগে শরীর-মন তরতাজা হতে এই বডি পলিশিং ট্রিটমেন্ট হতে পারে প্রথম পছন্দ। এ ছাড়া নেওয়া যেতে পারে আমেরিকান স্টাইল সল্ট বডি স্ক্রাব পলিশিং। এতে থাকে সি সল্ট আর এসেনশিয়াল অয়েলের পারফেক্ট ব্লেন্ড। ত্বকের রক্তসঞ্চালন বাড়াতে চমৎকার। অস্ট্রেলিয়ান স্টাইল নাট ইয়োগার্ট স্ক্রাব দিয়েও সেরে নেওয়া যায় পলিশিং। এটি গভীর থেকে পরিষ্কার করবে ত্বক। জোগাবে বাড়তি আর্দ্রতা। থাই ব্লেন্ডের টারমারিন্ড স্ক্রাব দিয়েও পলিশিংয়ের কাজ দারুণ হয়। এটি মৃতকোষ সারায়, জোগায় পুষ্টি। দাগছোপ দূর করে, বাড়ায় উজ্জ্বলতা।
বডি মাসাজের মূলমন্ত্র
বডি র্যাপ মানেই যে তার সঙ্গে বিশেষ মাসাজও দেওয়া হবে, তা নয়। কিছু র্যাপে মাসাজ অন্তর্ভুক্ত থাকে, কোনোটায় থাকে না। সে ক্ষেত্রে মাসাজের উপকার পেতে চাইলে বডি র্যাপ না করিয়ে সরাসরি মাসাজ ট্রিটমেন্ট নেওয়াই ভালো।
অর্চনা সাহা
মডেল: মিয়াম ও মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান