ছুটিরঘণ্টা I চা স্ট্রবেরি ক্যাকটাস বাগানে
সবুজ পাহাড়ে মেঘের আনাগোনা। গহিন অরণ্যজুড়ে রহস্যময় আলো-আঁধারি। ক্যাকটাস, স্ট্রবেরি, ল্যাভেন্ডার, গোলাপসহ হরেক ফল-ফুলের বাগান মন জুড়ায়। চা-বাগানের বুক চিরে বয়ে গেছে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি, আর আছে মায়াবী সব জলপ্রপাত। গল্পটা মালয়েশিয়ার শৈল শহর ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের। ঘুরে এসে লিখেছেন ইশতিয়াক হাসান
লতা ইস্কান্দর
কুয়ালালামপুর থেকে ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের দিকে মোটামুটি অর্ধেক দূরত্ব পেরোতে না পেরোতেই মুষলধারে বৃষ্টি। তবে ক্যামেরনের পাহাড়ের রাজ্যে প্রবেশের আগেই বৃষ্টিটা একটু ধরে এলো। মুষলধারে এখন রূপ নিয়েছে টিপ টিপ বৃষ্টিতে। ততক্ষণে লতা ইস্কান্দর জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছে গিয়েছি।
পাহাড়ের খুব বেশি ওপর থেকে নামেনি জলপ্রপাতটা। ১০০-১২০ ফুট হবে এর উচ্চতা। তবে বৃষ্টির কারণে পানি আছে বেশ। ধবধবে সাদা জলের ধারা নিচে নেমে ছোট্ট এক লেকের জন্ম দিয়েছে। তারপর একটা ঝিরিতে রূপ নিয়ে ছোট-বড়, নানান আকৃতির পাথরের মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। ওই ঝিরির ওপর একটা সেতু। সেই সেতু পেরোলাম। দলেবলে আমরা সাতজন। আমি, স্ত্রী পুনম, মেয়ে ওয়াফিকা, শ্যালিকা ডোনা, ওর স্বামী সেলিম এবং আমার শাশুড়ি ও খালাশাশুড়ি। মালয়েশিয়ায় আমরা ডোনা-সেলিমের অতিথি।
বৃষ্টির কারণে পাথুরে পথ কিছুটা পিচ্ছিল। এর মধ্যে সাবধানে পা ফেলে চলে এলাম জলপ্রপাতের ঠিক সামনে। পর্যটকদের ভিড় আছে বেশ। বেশির ভাগই মালয়েশিয়ান। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে প্রপাতের শীতল জলের ছিটা শরীর জুড়িয়ে দিল। জলপ্রপাতের উৎসের সন্ধানে ওপর পানে চাইলাম। দেখলাম সেখানে বড় বড় সব গাছ গায়ে ঠেকিয়ে গহিন অরণ্যের সৃষ্টি করেছে। তবে বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগেই আর দু-একটি স্পট দেখে রাতের জন্য একটা ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে আমাদের। তাই জলপ্রপাতের উৎসের সন্ধানে জঙ্গল অভিযানের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হলো।
শ্বেতশুভ্র জলের ধারাকে বিদায় জানিয়ে ঘুরতে যাব, এমন সময় এক কাণ্ড হলো। পা পিছলে পুনম পড়ল পাথরের ওপর। ওর হাত ধরে থাকা ওয়াফিকাও পড়ল। জলপ্রপাতের পানি জমা হওয়া লেকটির ঠিক ওপরের পাথুরে জায়গাতেই হাত-ধরাধরি করে পড়ে আছে মা-মেয়ে। নিচের জলের রাজ্যে পড়ার আগেই দুজনকে তোলা হলো। ভাগ্য ভালো, দুজনের কেউ তেমন ব্যথা পায়নি।
মেঘ-পাহাড়ের রাজ্যে
আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। তবে এর আগে পর্যটকদের জন্য লোভনীয় সব পণ্য সাজিয়ে রাখা দোকানগুলোর একটি থেকে ওয়াফিকার জন্য মাথায় ছাদওয়ালা টুপি কিনল ডোনা। সাতজন মানুষ একটা গাড়িতে ভ্রমণ করছি। তাই একটু ঠাসাঠাসি। তবে সেলিমের এই গাড়ি ওর কথা শোনে! এখন আমাদের এক পাশে পাহাড়, অপর পাশে খাদ…তার পরে আবার পাহাড়। মিনিট দশেক আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চলে চারপাশের দৃশ্য দেখার জন্য গাড়ি থামাল সেলিম। ডানে একটু খোলা জায়গার পর একটা দোকান। গাড়ি থেকে নামতেই আমাদের দৃষ্টি আটকে গেল একটু দূরের পাহাড় সারির দিকে। উঁচু সব প্রাচীন বৃক্ষে ঘন সবুজ পাহাড়ের শরীর। আর সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘেরা। ক্যামেরনের পাহাড়ে বুনো কুকুর, বন ছাগল, হরিণ, ভালুক আছে যত দূর জানি।
আমরা এখানে দাঁড়িয়ে বেশ কতকটা সময় পাহাড় দেখলাম, মেঘ দেখলাম, রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলা গাড়ি দেখলাম। আর নজর কাড়ল আমাদের ঠিক সামনেই কয়েকটা গাছে ঝুলে থাকা ডুরিয়ানরা। সেলিম আর ডোনা বলল, এক গাছে এত ডুরিয়ান ওরা আগে দেখেনি। মালয়েশিয়ার জাতীয় ফল ডুরিয়ান। তবে গন্ধটা বড় কড়া, পরে খেতে গিয়ে বুঝেছিলাম।
ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের টুকিটাকি
সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে পাহাড়ি জনপদে। আমরা রাতের আস্তানা খুঁজছি। এই ফাঁকে বরং ক্যামেরন হাইল্যান্ডস সম্পর্কে দু-চারটি তথ্য দিয়ে রাখি। মালয়েশিয়ার পাহাংয়ে এর অবস্থান। কুয়ালালামপুর থেকে মোটামুটি দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার। আয়তন ৭১২ বর্গকিলোমিটার।
১৮৮৫ সালের ঘটনা। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব মালয়েশিয়ায়। ওই সময় জায়গাটি খুঁজে বের করেন ইংরেজ জরিপকারী উইলিয়াম ক্যামেরন। তার নামেই নামকরণ। তবে একে সত্যিকারের এক শৈল শহরে রূপ দিতে এবং পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পেরিয়ে যায় কয়েক দশক। তা করেন ব্রিটিশ প্রশাসক স্যার জর্জ ম্যাক্সওয়েল, সেটা ১৯১৫ সালের ঘটনা। এখন একে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈল শহর হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকেই। সমুদ্র সমতল থেকে এর উচ্চতা মোটামুটি ৫০০০-৫৫০০ ফুট।
তানাহ রাতা
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। পথে দু-একটা শহরতলি পড়লেও আমরা থামলাম না। একসময় আলো-ঝলমলে আরেকটি শহরে পৌঁছে গেলাম। পরিচ্ছন্ন রাস্তার দুপাশে সারবাঁধা হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকান। চারপাশ থেকে শহরটি ঘিরে রেখেছে পাহাড়গুলো। কেন যেন এই শহরকে দেখেই ভুটানের পারোর কথা মনে পড়ে গেল।
সেলিম জানাল, এটি ক্যামেরনের সবচেয়ে বড় শহর তানাহ রাতা। ক্যামেরন থেকে কুয়ালালামপুর যাতায়াতের জন্য বাস মেলে এখান থেকেই। সেলিম খুঁজে পেতে রাতের জন্য তিন বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করে ফেলল আমাদের জন্য। ভাড়া ২০০ রিঙ্গিত (এক রিঙ্গিত = ২৫-২৬ টাকা)।
পরদিন খুব সকালে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সরু একটি পথ ধরে রওনা দিলাম বোহ টি এস্টেটের দিকে। ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের বড় দুটি চা-বাগানের একটি এটি। ডান-বামে নানা ধরনের সবজির চাষ। বিশেষ করে পথের পাশে প্রচুর জন্মে আছে ছোট আকারের একধরনের লাউ। সেলিম আর ডোনা গাড়ি থামিয়ে বাগানমালিকের অনুমতি নিয়ে লাউ পাড়তে গিয়ে কাঁটার খোঁচা খেল! তবে বোহ টি এস্টেটে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। সপ্তাহের এক দিন এটি পর্যটকদের জন্য বন্ধ। আর সেটি ছিল সেদিনই, মানে সোমবার। অতএব গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিলাম ক্যামেরনের আরেক বিখ্যাত বাগান ক্যামেরন ভ্যালি তথা ভারত টি এস্টেটের দিকে।
চায়ের রাজ্যে ভ্রমণের আগে বরং তাহান রাতার রাত আর সকালটা কেমন কাটল, তা বলে রাখি। তানাহ রাতায় ছিমছাম এক রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার সারি আমরা। খাবার পদগুলোর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল তমিয়াম (আসলে টম ইয়াম)। অক্টোপাস, চিংড়ি ও বিভিন্ন সবজিসহযোগে বানানো টক-ঝাল মিলিয়ে ভারি সুস্বাদু এই থাই স্যুপের মালয়েশিয়ান রূপান্তর।
রাতে ঘুমানোর আগে আমাদের কামরা থেকে আলো ঝলমলে তানাহ রাতার রাস্তা, আর একটু দূরের ক্যামেরনের পাহাড়গুলোর কালো কালো অবয়বের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকটা সময়। তারপর যখন বিছানায় এলাম, বেশ ঠান্ডা পড়ছে রাতের শৈল শহরে। কম্বল টেনে শরীর ঢাকতেই আরামে দুচোখের পাতা এক হয়ে এলো।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পাহাড়মাঝের ছিমছাম শহরটি। প্রধান সড়কের পাশেই ক্যামেরন হাইল্যান্ডের প্রতীক হিসেবে বড় করে শোভা পাচ্ছে সি এবং এইচ অক্ষর দুটি। সেখানে ছবি তুললাম সবাই।
ক্যামেরন ভ্যালি টি
তানাহ রাতা থেকে ক্যামেরনের আরেক শহর রিংলেটে যাওয়ার পথে মিনিট দশেক গাড়ি চালালেই ক্যামেরন ভ্যালি চা-বাগান। ভারতের উত্তর প্রদেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভারত গ্রুপ সেই ১৯৩৩ সালে গোড়াপত্তন করে এই বাগানের। অবশ্য গুগল ঘেঁটে যত দূর জেনেছি, এখানে বাগান আসলে একটি নয়, চারটি। ১৬০০ একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে বাগানগুলো। গেট দিয়ে চা-বাগানের সীমানায় ঢুকতেই বাম পাশে একটি টি শপ। গত সন্ধ্যায় তানাহ রাতা যাওয়ার পথেও এটি দেখেছিলাম। টি শপ থেকে কাচের শার্সির ওপাশে ক্যামেরন ভ্যালি চা-বাগানের অনেকটা অংশই চোখের সামনে চলে আসে। দুপাশে অনেক দূর চা-বাগানের বিস্তার। পেছনে চা-বাগানের পর পাহাড়ে ঘন অরণ্য। চা-বাগানের গা কেটে বড় করে ইংরেজিতে লেখা কয়েকটি অক্ষর জ্বলজ্বল করছে…ক্যামেরন ভ্যালি টি।
টিকিট কাটলাম চায়ের রাজ্যে প্রবেশের জন্য। হেঁটে চা-বাগানে ঘুরবার টিকিট ৩ রিঙ্গিত করে। ছাদখোলা একটা গাড়িও আছে পর্যটকদের বাগান ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। শাশুড়ির জন্য ১০ রিঙ্গিতে কাটা হলো সেই টিকিট।
ওপর থেকে আরেকবার তাকালাম চায়ের রাজ্যের দিকে। বাগানের মাঝখানে ফুলের মতো ফুটে আছে একটা ডাকবাংলো। হালকা হলুদ বাংলোটায় টালির ছাদ। ওই বাংলোয় একটা রাত কাটানোর সাধ হলো। তবে খোঁজ নিতেই জানা গেল, চা-বাগানের এই বাংলো ভাড়া দেওয়া হয় না। একটা সিঁড়ি ধরে আমরা চলে এলাম চা-বাগান মাঝের একটা ঢালু রাস্তায়। যত দূর চোখ যায় একের পর এক পাহাড়। আর পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টির ছোঁয়ায় একেবারে সবুজ হয়ে ওঠা চা-গাছের সারি। আমাদের ডানে কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছেন বাগানে। চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে একটু পর পর বাঁক নিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে মাঝেমধ্যেই লম্বা লম্বা গাছ। পাখিরা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে কোনো না কোনো গাছে। একেকটি বাঁক ঘুরতেই চোখের সামনে চলে আসছে চা-বাগানের মাঝখানে লেখা সেই ‘ক্যামেরন ভ্যালি টি’।
মিনিট দশ-পনেরো হাঁটতেই একটা চওড়া জায়গায় চলে এলাম। এখানে ছাদখোলা গাড়িগুলো এসে পর্যটকদের নামিয়ে দেয়। ওই গাড়ির টিকিট কাটা পর্যটকেরা ঘুরেফিরে আবার এখানে এসে যেকোনো একটি গাড়িতে উঠে ওপরে যেতে পারেন। খানিকটা পথ হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জায়গায়। ওপর থেকে এটি দেখেই চোখ টাটিয়েছিল! সুন্দর, ছোট্ট একটি সেতু। নিচ দিয়ে তরতর করে বয়ে গেছে পাহাড়ি এক ঝিরি। সেতুর ওপর উঠে দাঁড়ালাম। অনেকেই ছবি তুলছে এখানে। চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে ঝিরিটা। কয়েক দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই ঝিরিতে পানি আছে বেশ। পাহাড়ের কাদা-মাটি মিশে পানি একটু ঘোলা।
সেতু থেকে নেমে আমরা বাগানে ঘোরাফেরা করলাম, ভ্রাম্যমাণ টি স্টল থেকে একটু চড়া দামেই কিনে বাগানের চা পান করলাম, পাখিদের গান শুনলাম আর দূরের পাহাড়ের একটি বসতিকে দেখার চেষ্টা করলাম ক্যামেরার লেন্সে। যখন দেখলাম বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেছে, আমাদের না দেখার লিস্টটা এখনো অনেক বড়, তখন ফিরতি পথ ধরলাম। তবে এবার বাগানের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা একটি মেঠো পথ ধরে।
ক্যাকটাস আর স্ট্রবেরির রাজ্য
তারপর ঘুরে বেড়ালাম। ঢুঁ মারলাম স্ট্রবেরিসহ নানা ফুল-ফলের ছোটখাটো কয়েকটি বাগানে, তারপর মধুর চাষ হয় এমন একটি পার্কে। তবে এগুলো কোনোটাই আমাদের ‘অবশ্যই দেখাতে হবে’ তালিকায় ছিল না। তালিকার পরের জায়গাটি পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত ‘ক্যাকটাস ভ্যালি’। ক্যামেরনের দ্বিতীয় বড় শহর ব্রিনচাংয়ের পাশেই। আট রিঙ্গিত খরচ করে ঢুকতে হলো ক্যাকটাসের রাজ্যে। তারপর এক ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকলাম হরেক জাতের ক্যাকটাসে। কোনোটা চ্যাপ্টা, কোনোটা গোল। কোনোটা খাটো, কোনোটা লম্বা। এর আগে ভারতের কালিম্পংয়ের একটি ফার্মে অনেক ধরনের ক্যাকটাস দেখলেও সেখানেও এত জাতের ছিল না।
ক্যাকটাসের রাজ্য থেকে বেরিয়ে, পাহাড়ি কিছুটা ঢাল পার হয়ে আমরা চলে এলাম বিগ রেড স্ট্রবেরি ফার্মে। বাগানজুড়ে গাছ থেকে ঝুলে আছে লাল লাল স্ট্রবেরি। এখানে নিজ হাতে স্ট্রবেরি পেড়ে ঝুড়ি ভরে বাড়িতেও নিয়ে আসতে পারবেন। তবে অবশ্যই এর জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
ক্যামেরনের দেশি ভাই
আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমরা বিগ রেড স্ট্রবেরি ফার্ম থেকে ঢালু পথ ধরে নামতে লাগলাম। ক্যাকটাস ভ্যালিতে পৌঁছানোর একটু আগে হাতের ডানে আরেকটি বাগান। সেখানেও স্ট্রবেরি, গোলাপসহ অনেক ধরনের ফুল-ফল ফুটে আছে। তারপরই ওই ফার্মের ম্যানেজারের দিকে চোখ গেল। হাসিমুখে এগিয়ে এসে সালাম দিলেন। চেহারা দেখে অনুমান করেছিলাম, পরিচয় দিতে নিশ্চিত হলাম। তার বাড়ি বাংলাদেশে। বরিশালের উজিরপুরে। হালকা বৃষ্টির ছাট গায়ে লাগিয়ে আমরা বাগানটা ঘুরেফিরে দেখলাম। আর ভাইটি জানালেন, এই বাগানের মালিক তাকে খুব বিশ্বাস করেন। তাই ভালো বেতন দিলেও দেশে যেতে চাইলেই এটা-সেটা বুঝিয়ে বাদ সাধেন। এভাবে সাত বছর হয়ে গেল তার দেশে ফেরা হয়নি।
আমরা তার বাগান ঘুরে দেখলাম। ভাইয়ের অনুরোধে স্ট্রবেরি পেড়ে খেলাম। ডোনাকে একটা স্ট্রবেরির চারাও উপহার দিলেন তিনি। যখন বাগান থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন মন ভার। হয়তো আমাদের মাধ্যমে দেশে নিজের পরিবারের সদস্যদেরই ক্ষণিকের জন্য ফিরে পেয়েছিলেন।
ক্যামেরনে যেখানেই গিয়েছি, বাংলাদেশি পেয়েছি। প্রথমে তানাহ রাতাতে। তারপর ক্যামেরন ভ্যালি চা-বাগানের দুই গার্ডকেই আবিষ্কার করলাম বাংলাদেশি হিসেবে। দুজনের বাড়িই সিলেটে। তারপর পথে-ঘাটে আরও কয়েকজন বাংলাদেশির দেখা পেয়ে পুনম তো একপর্যায়ে বলেই বসল, মনে হচ্ছে আমরা মালয়েশিয়ায় না, বাংলাদেশেই আছি।
ল্যাভেন্ডার গার্ডেন
ক্যামেরন হাইল্যান্ডে আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল ল্যাভেন্ডার গার্ডেন। বেশ চড়া দামে, মানে ৩০ রিঙ্গিত করে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। তারপর মোটামুটি একটা ঘণ্টা কাটল ল্যাভেন্ডার গার্ডেনেই। ল্যাভেন্ডার ফুল দেখলাম। দেখলাম গোলাপ, পদ্মসহ আরও অনেক ফুল। এক জায়গায় এসে চমকে উঠলাম, ফুল আর লতা-পাতার রাজ্যে অনেকগুলো পান্ডাকে গাছে গাছে ঝুলতে দেখে। তবে বুঝতে দেরি হলো না, চীনের পান্ডা মালয়েশিয়ায় বসতি গাড়েনি; বরং এগুলো কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে বানানো। প্রাণহীন। ল্যাভেন্ডার গার্ডেনের ওপরের দিকের একটি তলা থেকে চারপাশের বৃষ্টিভেজা পাহাড়, পাহাড়ের ধাপে ধাপে ক্যামেরনের মন জুড়ানো সব সবজিবাগান দেখলাম।
অতঃপর বিদায়
ক্যামেরন হাইল্যান্ডস থেকে বের হয়ে এলাম যখন, তখন পেটে ছুঁচোর ডন। ছোট্ট এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ সারলাম দেরি করে। নাসি গোরেং নামের রাইস, চিংড়ি আর সবজির এই পদটি সুস্বাদু। সঙ্গে ল্যামোনেডটা ছিল তোফা। তারপর আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। সেলিমের কথায় তুফান বেগে ছুটল তার ‘পঙ্খিরাজ’। যখন ক্যামেরনের সীমানা অতিক্রম করলাম, তখন মন পুড়ছে সেখানকার সবুজ চা-বাগান, বাহারি সব ফুলের রাজ্য, উঁচু সব পাহাড়ে পুরোনো বৃক্ষের রাজত্ব আর মেঘের খেলা, বহু দিন পরিবারের দেখা না পাওয়া বাংলাদেশি সেই ভাইটির জন্য।
আমাদের গাড়ি ছুটছে পেনাংয়ের দিকে। ঘণ্টা পাঁচেক লাগবে। তবে ওই গল্পটা বরং জমা থাকুক অন্য কোনো দিনের জন্য।
ক্যামেরন ভ্রমণের টুকিটাকি
মালয়েশিয়ার পর্যটন ভিসা করিয়ে দেয় বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি। ৫-৬ হাজার টাকা জনপ্রতি। পরিবার নিয়ে গেলে ভিসা পাওয়া সহজ। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার কয়েকটি এয়ারলাইনস বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ফ্লাইট পরিচালনা করে। আমাদের আসা-যাওয়ার টিকিট পড়েছিল জনপ্রতি ৩১ হাজার টাকা।
কুয়ালালামপুর থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে পারেন ক্যামেরন হাইল্যান্ডস। এ ছাড়া পাবেন বাসও।
ছবি: লেখক