skip to Main Content

মনোযতন I শুচিবাই সমাচার

অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি)। অনেকেই আক্রান্ত ব্যক্তির বদ-অভ্যাস ভাবেন; হাসি-ঠাট্টাও করেন। অথচ এ এক ভয়ানক মানসিক ব্যাধি। জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

ধরা যাক, আপনার মনে হলো, হাতে-পায়ে কিংবা গায়ে ময়লা লেগে আছে। যদিও ভালো করেই জানেন, কোথাও ময়লা নেই; তবু ভাবনাটি বারবার মাথায় আসে আর অমনি ছুট দেন বেসিনের দিকে। একবার, দুবার, বারবার…আপনি হাত ধুয়ে যান। হ্যান্ডওয়াশের ছোবলে রুক্ষ হয়ে ওঠে ত্বক। তবু আপনি নির্বিকার। এই যে ময়লার দুশ্চিন্তা ঘরবাড়ি করে নিয়েছে আপনার মস্তিষ্কে; তাকে বলা হয় ‘অবসেশন’; আর যেভাবে হাত ধুতে থাকেন, তাকে বলে ‘কমপালশন’। এই দুটি মিলিয়েই তৈরি এক ভয়ংকর মানসিক রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার’, সংক্ষেপে ওসিডি; আর আমাদের গ্রামে-গঞ্জে বউ-ঝিদের মাঝে ‘শুচিবাই’। এই রোগে আক্রান্ত রোগী খুঁজতে আতশি কাচ হাতে নিতে হবে না। আশপাশেই পেয়ে যাবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তা-ই বলছে। তাদের মতে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি ৪০ জনে ১ জন এবং শিশুদের প্রতি ১০০ জনে ১ জন এ রোগে ভুগছে।
তাই ধরে নিতে পারেন, ওসিডি বা চিন্তাবাতিক ও বাধ্যতাধর্মী আচরণ একটি উদ্বেগজনিত রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় স্থান করে নেওয়া মেডিকেল ডিজঅ্যাবিলিটির শীর্ষ ১০ রোগের একটি। বিশ্বে প্রতি ৫০ জনে ১ জন জীবনের কোনো না কোনো সময় এই রোগে ভোগে। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরে শুরু রোগটির। নারী-পুরুষ যে কেউই ভুগতে পারে। নিকটাত্মীয়দের কারও এ রোগ থাকলে আপনার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
করোনার দাপট আতঙ্ক ছড়িয়ে যেমন কেড়ে নিয়েছে আমাদের প্রিয়জনদের, তেমনি শিখিয়ে দিয়েছে ‘ট্যাপ অ্যান্ড পে’ পদ্ধতি! তবে কি করোনা বাস্তবতা অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার বাড়িয়ে দিচ্ছে?
ওসিডির খেরোখাতা
যেকোনো কিছু এক-দুবার চেক করতেই পারেন। আর তা স্বাভাবিক আচরণই বটে। যেমন ধরুন, গেটের তালা লক করেছেন কিংবা বাইরের রুমের লাইট নিভিয়েছেন কি না, যাচাই করা। কিন্তু এমন ঘটনা যদি ২০ বা ৩০ বারের মতো মনে সন্দেহ জাগায়, তখন একে স্বাভাবিক বলা যায় না। এটি চিন্তাবাতিকগ্রস্ত ও বাধ্যতাধর্মী আচরণের লক্ষণ। এ এমন এক রোগ, যাতে অবসেশন অথবা কমপালশন কিংবা উভয়ই থাকতে পারে। অবসেশন একধরনের মর্মপীড়াদায়ক চিন্তা, ছবি অথবা তাড়না, যা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথায় আসে। এসব চিন্তাভাবনা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং কোনো যুক্তির ধার ধারে না। আর কমপালশন হলো অবসেশনে প্রভাবিত হয়ে এবং অস্বস্তি ও উদ্বেগ কমানোর জন্য যে কাজ করা হয়। যেমন অকারণে বারবার হাত ধোয়া, গণনা করা, যাচাই করা, গুছিয়ে রাখা এবং একই কথা বলা ইত্যাদি।
সুলুক সন্ধানে
ওসিডির জন্য বংশগত কারণ যদি ৫৫ ভাগ দায়ী হয়ে থাকে, পারিপার্শ্বিক কারণের দায় ৪৫ ভাগ। তার মানে, বংশগত কারণ ছাড়াও এটা হতে পারে। এই রোগের জন্য মানসিক চাপ অনেকাংশে দায়ী। শিশুরা প্রকাশ করতে পারে না, তাই তাদের প্রকাশভঙ্গি বড়দের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়। স্কুলে ভর্তি বা পরীক্ষার চাপ, সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা শিশুদের মনে অভিভাবকদের অজ্ঞাতেই কালো ছায়া ফেলে রাখে। বয়ঃসন্ধির সময় মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হওয়া, ছেলেদের নাইটফলস অনেক ক্ষেত্রে ওসিডির সূত্রপাতের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কলকাঠি নাড়ে। কিশোর বয়সে বিয়ে, গর্ভধারণ ও বাচ্চা প্রসবও ফেলে প্রভাব। আসলে, জীবনের যেকোনো ঘটনা দিয়ে রোগটির সূত্রপাত ঘটতে পারে। মানসিক চাপ, পরিত্যক্ত ব্যান্ডেজ বা বর্জ্য ইত্যাদি দেখেও হতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রে শারীরিক রোগের কারণে এটি হয়ে থাকে।
ওসিডিতে ব্রেইনের কর্টিকো-স্ট্রায়েটাল-থ্যালামোকর্টিক্যাল লুপ অথবা সার্কিট আক্রান্ত হয়। এতে শরীরে জৈব রাসায়নিক সিরোটনিন, গ্লুটামেট, ডোপামিনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে। আমাদের মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষ দিয়ে তৈরি অসংখ্য স্নায়ু থাকে।
এমনই একটি স্নায়ু কর্টিকো-স্ট্রায়াটো-থ্যালামো-কর্টিক্যাল বা সিএসটিসি। কোনো কাজ বা চিন্তা করার সময় কোথায় থামতে হবে, তা এটি নিয়ন্ত্রণ করে। ওসিডির সমস্যায় সিএসটিসি সার্কিট ঠিকমতো কাজ করে না। তাই রোগী বুঝতে পারেন না তিনি যে বিষয়ে ভাবছেন, তা কখন থামানো উচিত। এ কারণে একই চিন্তা বারবার মনে আসে। একই কাজ বারবার করার প্রবণতা দেখা দেয় তার মধ্যে।
লক্ষণ দেখে
ওসিডি আক্রান্ত ব্যক্তি ঠিকই জানেন, তার কাজকর্ম ও আচরণগুলোর কোনো মানে নেই। এমন নয় যে তারা এ ধরনের আচরণ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এটা অনেকটা ভাঙা রেকর্ডের মতো মাথার ভেতরে কাজ করতে থাকে, ফলে একই কাজ বারবার করতে বাধ্য হন তারা। ওসিডির লক্ষণগুলোকে মোটা দাগে চার মাত্রায় ভাগ করা যেতে পারে। কোনো না কোনো মাত্রার সঙ্গে আপনার লক্ষণগুলো মিলে যাবে। বলে রাখি, ওসিডি আক্রান্তের এক বা একাধিক লক্ষণ থাকতে পারে:
 জীবাণু ও সংক্রমণজনিত উদ্বেগ;
 ক্ষতি, আঘাত বা দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী ভেবে উদ্বেগ;
 অগ্রহণযোগ্য চিন্তার কারণে উদ্বেগ;
 সামঞ্জস্যপূর্ণ, সম্পূর্ণ ও নিখুঁতভাবে করার বিষয়ে উদ্বেগ।
এ ছাড়া ওডিসি আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে কিছু লক্ষণ প্রকট আকারে দেখা যায়:
 অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়া এবং জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়;
 নিজের কিংবা অন্যের ব্যথা পাওয়ার আশঙ্কায় ভীত থাকা;
 যেকোনো জিনিস একদম সঠিক স্থানে সঠিকভাবে রাখার প্রবণতা;
 নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা ও রং ‘ভালো’ ও ‘খারাপ’—এই ধারণায় বিশ্বাস করা;
 অনবরত চোখের পলক ফেলা, বারবার বড় করে নিশ্বাস নেওয়া এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের অনুভূতি অনুভব করা;
 সঙ্গীকে অকারণে সন্দেহ করা;
 অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার হাত ধোয়া;
 কোনো কাজ একইভাবে পরপর কয়েকবার করা;
 দরজার লক, ফ্যান-লাইটের সুইচ, পানির কল, গ্যাসের লাইন অন-অফ আছে কি না বারবার দেখা;
 সিঁড়ির ধাপ, জামার কাপড়ে বৃত্তের সংখ্যা, শেলফে প্লেটের সংখ্যা…যেকোনো জিনিস গোনা;
 একই জিনিস একইভাবে সারিবদ্ধ রাখা;
 অন্য বাসার দরজার হাতল ধরতে, পাবলিক বাস বা যানবাহন কিংবা পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে ভয় কাজ করা;
 হাত কাঁপা;
 হঠাৎ মনে বিভিন্ন রকম আতঙ্ক তৈরি হওয়া;
 বিশেষ বস্তু বা অবস্থাকে কেন্দ্র করে ভয় ও আতঙ্ক বেড়ে যাওয়া;
 বদ্ধ জায়গা ও ফাঁকা জায়গায় একা যেতে ভয় পাওয়া;
 কঠিন রোগব্যাধি ও একাকিত্বে ভয় কাজ করা এবং সেই সঙ্গে শারীরিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয় দমবন্ধ ভাব, বুক ধড়ফড়ানি, গলা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বেড়ে ওঠা লতাগুল্ম
হয়তো আপনি দীর্ঘদিন এই রোগে ভুগছেন। আপনার ওসিডি আপনাকে ভুল ও অযৌক্তিক চিন্তায় তাড়িত করে। চাইলেও মাথা থেকে সরাতে পারেন না। তাই অকারণ ধোয়াধুয়ি, গোসল করা, বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আপনার। তাতে ব্যক্তিগতভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবার ও পেশাজীবনও পড়ছে ক্ষতির মুখে। আপনার এই আচরণ পরিবার বা সমাজের অন্য কেউ করছে না। আপনাকে বাধা দিলে রেগে যাচ্ছেন অথবা অভিমান করছেন। খাওয়াদাওয়া, ঘুম—সবকিছুতেই ব্যাঘাত ঘটছে। ওসিডির ক্ষেত্রে শুধু আপনিই আইসোলেশনে থাকছেন। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে একমাত্র আপনারই সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব বাড়ছে। আপনার কাছ থেকে কারও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই ঠিক, তবে নিজের অজান্তে আপনি ঘরবন্দী হয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে ক্রমেই অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন বিষণ্নতা, ফোবিয়া, প্যানিক ডিজঅর্ডার হানা দিতে শুরু করেছে। নিজেকে আঘাত করার বা আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। সঙ্গে যদি অন্যান্য শারীরিক রোগ, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমনটা হলে তো খুবই বিপদ!
খাবারে সবুজ ও লাল সংকেত
ওসিডি রোগীদের খেতে হবে সেরোটোনিন সমৃদ্ধ খাবার। যেসব খাবারে মিলবে তাদের এই সবুজ সংকেত, তা জেনে নিই—
 আমিষ: মাংস, কলিজা, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ;
 ফলমূল জাতীয় খাবার: কলা, আনারস, আম, আঙুর, খেজুর;
 শাকসবজি: পালংশাক, পুঁইশাক, বেগুন, ফুলকপি, শিমজাতীয় বীজ, মাশরুম, টমেটো, ব্রকলি।
যেসব খাবারে লাল সংকেত, মানে এড়িয়ে চলা মঙ্গল, সেই তালিকায় রাখুন—
 মিষ্টিজাতীয় খাবার;
 ক্যাফেইনযুক্ত খাবার, যেমন চকোলেট, চা, কফি, কোমল পানীয়, ক্যাফেইনযুক্ত কিছু ওষুধ;
 অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়;
 কৌটায় সংরক্ষিত খাবার প্রভৃতি।
সমাধানে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তেমনি চিকিৎসার মাধ্যমে ওসিডিও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এসব আচরণকে স্বাভাবিক না ভেবে কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন। সচেতন থাকুন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।’
এ ছাড়া ওসিডির চিকিৎসা বিভিন্ন ওষুধ, সাইকোথেরাপি, শৃঙ্খলার মাধ্যমে করা হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে রয়েছে এসএসআরআই গ্রুপের ওষুধ এবং অন্যান্য। রোগী ও তার পরিবারকে রোগ সম্পর্কে জানাতে হবে, চিকিৎসায়ও উৎসাহিত হওয়া চাই। রোগীকে এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন থেরাপি, শাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন থেরাপি, রিলাক্সেশন থেরাপি ও কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির মাধ্যমেও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়ামের চর্চা করা চাই। তবে যা-ই করা হোক না কেন, নেওয়া চাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top