এডিটর’স কলাম I সমর্থন ও উগ্রতা
উদ্যাপন যদি উগ্রতায় রূপ নেয়, তা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সামাজিক অশান্তি বাড়ার পাশাপাশি শারীরিক তো বটেই, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও হানিকর হয়ে ওঠে তা
‘ফুটবল অনুরাগীরা একটি সর্বজনীন ভাষায় বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বহু ধরনের ব্যক্তিত্বের ভেতর পারস্পরিক সম্পর্ক ভাগাভাগি করে নেন। একজন সিরিয়াস ফুটবল ফ্যান কখনোই একা নন। আমরা বিরাট সৈন্যদলের অংশ; আর আমাদের মধ্যে একমাত্র মিলের জায়গা ফুটবল’—বলে গেছেন আমেরিকান সাংবাদিক এবং গঞ্জো জার্নালিজম মুভমেন্টের প্রবর্তক হান্টার এস. থম্পসন। চার বছর পরপর যখন বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হয় ক্রীড়ামঞ্চে, এই বয়ানের সত্যতা বোধ করি সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে। বিশ্ব কাঁপতে থাকে ফুটবল-জ্বরে। সকল ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ আবেগ শেয়ার করতে থাকেন অভিন্ন ভাষায়—ফুটবলের ভাষায়। সকল ভিন্নতাকে পাশ কাটিয়ে মানুষের এমন একাকার হয়ে ওঠার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এর বাইরে বস্তুতই বিরল। চলছে সেই মৌসুম—বিশ্বকাপ। যথারীতি আমাদের দেশেও সেই উত্তাপ আছড়ে পড়ছে প্রতি মুহূর্তে। প্রিয় দল ঘিরে স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন ভাঙা, আবারও স্বপ্ন বোনা চলছে…চলবেই। এটাই বোধ হয় ফুটবলের, তথা খেলাধুলার অনন্য শক্তি।
দুই
একেকটি খেলা চলে দুই দলে। সমর্থনও ভাগ হয়ে যায়। পক্ষে ও বিপক্ষে। এটাই স্বাভাবিক। তবে বেশির ভাগ ফুটবল-সমর্থকেরই সব ছাপিয়ে থাকে একটি প্রিয় দল। আমাদের দেশে এই দলের তালিকায় যথারীতি শীর্ষে থাকে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি [এবারের বিশ্বকাপে সুযোগ হয়নি যদিও], ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড প্রভৃতি। প্রিয় দলের জার্সি ও পতাকায় ছেয়ে যায় জনপদ। এবারও ব্যতিক্রম নয়। আর তা এক অন্যতর সৌন্দর্যের হাজিরা এনে দেয়, অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু প্রতিবারই বিশ্বকাপ ডেকে আনে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সমর্থনের নামে অনেকের মধ্যে প্রকাশ পায় মারাত্মক উগ্রতা। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে চোখে পড়ে ‘প্রতিপক্ষে’র বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর নোংরা খেলা। প্রত্যক্ষভাবেও মারামারি-হানাহানির ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। অথচ, ফুটবল তো দিন শেষে কেবলই একটি খেলা; আর তা উপভোগই শ্রেয়। অন্যদিকে, একে ঘিরে ঘটছে দুর্ঘটনাও। এবারও দেশে প্রিয় দলের পতাকা টানাতে গিয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে কিংবা উঁচু জায়গা থেকে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আবেগকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখলে, একটু সচেতন থাকলে এমন দুর্ঘটনা সম্ভবত এড়ানো সম্ভব।
তিন
‘লোকে উদ্যাপনের শক্তি হারিয়ে ফেলছে। উদ্যাপন করার বদলে আমরা বরং পুলকিত কিংবা বিনোদিত হতে চাইছি। উদ্যাপন হলো একটি সক্রিয় অবস্থা; সম্মান কিংবা প্রশংসা প্রকাশের একটি কর্ম। অন্যদিকে, বিনোদিত হওয়া একটি নিষ্ক্রিয় অবস্থা; এ হলো কোনো পুলক দেওয়া কর্ম কিংবা প্রদর্শিত কিছু দেখে আনন্দ লাভের বিষয়।…উদ্যাপন হলো একটি বোঝাপড়া; কারও কোনো কাজের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপার’—বিশ শতকের পোলিশ-আমেরিকান দার্শনিক আব্রাহাম জসুয়া হেসেলের উপলব্ধি এমনই ছিল। একুশ শতকে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই সময়কালে এসে অবস্থার কি খুব বেশি বদল ঘটেছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই উত্তরটি—‘না’। অন্যদিকে, উদ্যাপন যদি উগ্রতায় রূপ নেয়, তা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়। সামাজিক অশান্তি বাড়ার পাশাপাশি শারীরিক তো বটেই, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও হানিকর হয়ে ওঠে তা।
চার
অন্যকে হেয় না করে গোল বলে গোল দেওয়া ঘিরে চলা টান টান উত্তেজনার রোমাঞ্চকর খেলা ফুটবল যদি উপভোগ করতে পারি ঠিকঠাক, তাহলে বিশ্বকাপ আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই পরম এক প্রাপ্তির আয়োজন হয়ে ধরা দেবে। কেননা, নানা সংকটের মধ্য দিয়ে আমাদের দিন কাটছে। জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানান কারণে সামনের দিনগুলো কেমন যাবে—সেই দুর্ভাবনা না চাইলেও ঘিরে ফেলছে কম-বেশি সবাইকে। এমন প্রতিকূল লগনে ক্ষণিকের জন্য হলেও মনোজগতে বেশ প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেওয়ার দারুণ সক্ষমতা রাখে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’খ্যাত বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। তাই একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ না করে বরং বিষাদে পরিণত করা, নেতিবাচক প্রবৃত্তির উচ্ছৃঙ্খল প্রকাশের হাতিয়ার করে তোলা নিশ্চিতভাবেই কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
পাঁচ
প্রিয় দলের খেলা উপভোগের পাশাপাশি চাইলে প্রিয় প্রতিপক্ষের পরাজয়ও উপভোগ করা যায়। কিন্তু তা ঘিরে হানিকর কোনো পদক্ষেপ আমাদের মানুষের কাতার থেকে নামিয়ে দিতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। অন্যদিকে, হার-জিত খেলারই অংশ। প্রিয় দলের হেরে যাওয়া কিংবা প্রতিযোগিতা থেকে বিদায় নেওয়ায় মুষড়ে পড়ার কিছু নেই; বরং বাস্তবতা মেনে নিতে শেখার এটিও এক বিরাট সুযোগ।
শুধু ফুটবল নয়, সব ক্ষেত্রেই উগ্রতাকে ‘না’ বলুন; জয় হোক মনুষ্যত্বের।