ছুটিরঘণ্টা I তুষারের ভূমি ও বরফের সমুদ্রে
যত দূর চোখ যায়, আদিগন্ত বরফের কোমল চাদর। বাতাসে হিমশীতল ঘ্রাণ। পৃথিবীর বুকে যেন স্বর্গীয় আবহের কাব্যিক খেলা। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
পাহাড়ি সুন্দরীদের দেখার জন্য, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ভারতের জয়গাঁও থেকে সিকিমের পেলিংয়ে যাব। হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তে বরফ পড়ার দৃশ্য না দেখলে জীবন বৃথা! আশপাশের জেলায় কোথাও এখনো সেভাবে বরফ পড়তে শুরু করেনি; ঠান্ডা অবশ্য জাঁকিয়ে পড়েছে। আমাকে কয়েক দিন আগে একজন গ্রামবাসী বলেছিলেন, সিকিমের কাটাও সারা বছর বরফে আবৃত থাকে। ট্যুরিস্ট খুবই কম যায় সেখানে। আমি ট্যাক্সি ঠিক করেছিলাম পেলিংয়ে যাবার জন্য; কিন্তু মত পরিবর্তন করে কাটাও যাব শুনে ট্যাক্সিচালক মহা খাপ্পা আমার ওপর! পারমিশন নিতে হবে আমার ও গাড়ির। এ রকম আপদ ডেকে আনা ট্যুরিস্ট নাকি তিনি জীবনেও দেখেননি! কিন্তু কী করা। ঠিক এই মুহূর্তে আমার তাজা বরফ ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে এমন জায়গায় যেতে, যেখানকার বরফ আগে খুব বেশি পর্যটক দেখেননি। এমন জায়গা ভূ-ভারতে আর আমার কাছাকাছি সিকিমেই আছে।
কাটাও যাবার অনুমতি জোগাড় করার পর আমি যেন উড়াল দিলাম বরফের ঘ্রাণের হাওয়ার সঙ্গে, পাহাড়ি মানুষদের হাসির সঙ্গে। ভারতের যেকোনো পাহাড়ি এলাকার মানুষের মন পাহাড়ি নদীর মতোই নির্মল, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এমনটাই দেখেছি। ট্যাক্সি চলছে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে। একটু একটু করে ঠান্ডা বাড়ছে; কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। জানালা খুলে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে সকালের মিঠে রোদ। যদি মুঠো ভরে পাহাড়ি আনকোরা সুগন্ধ আটকে ফেলা যেত, তবে তা-ই করতাম। চারদিকে এখনো সবুজ পাহাড় আর দূরে চূড়ায় মেঘের সঙ্গে তুষার মিলেমিশে খেলা করছে।
কাটাও শহরটা ভারত-চীন সীমান্তে। তাই বাড়াবাড়ি রকমের নিরাপত্তাব্যবস্থা আমাদের মতো ভ্রমণার্থীদের জন্য। থাকার ব্যবস্থাও নেই। থাকতে হবে পাশের লাচুং গ্রামে। এ গ্রামে খুব বেশি হোটেল নেই। কটেজ ভাড়া করা যায়। সে রকমই একটি কটেজে উঠব আমি। এখানকার জনসংখ্যাও বেশ কম। দুর্গম, নিরাপত্তার কড়াকড়ি আর বরফের কারণে সাধারণত কেউ এখানে বসবাস করতে চায় না। ইদানীং অবশ্য কিছু ভ্রমণার্থীর আনাগোনার কারণে হোটেল ও কটেজে মাইনে দিয়ে লোক রাখা হচ্ছে।
অবশ্য কাটাও সম্পর্কে এখনো জানার অনেক বাকি। ট্যাক্সি থেকে অপরূপ এক জলাধার চোখে পড়ল। সে জলাধারের পানিকে পাহাড় যেন আয়না বানিয়ে নিয়েছে। খুব মুখ দেখছে উছলে উছলে। কিছুদিন পর এসব জলাধার জমে যাবে বরফে, ঢেকে যাবে পথঘাট, যান চলাচল হবে বন্ধ। তখন পাহাড় নেবে বিশ্রাম। চোখ মুদে হেলান দেবে আকাশের গায়ে। এমন কিছু ঘটার আগেই আমি দেখে ফেলব দিনের প্রথম ভাগের জন্য রেখে দেওয়া মিহি বরফের কণা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো অনুগত বরফ, কোমল সাদায় মাখামাখি হয়ে যাওয়া পাহাড় ও গাছপালা।
কটেজে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে এলো প্রায়। কটেজের কেয়ারটেকার বাঙালি। পরিবার নিয়ে এখানেই থাকেন। কাঠের দোতলা কটেজে আমার প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে কলকাতার এক বাঙালি যুগল। খুব হাসিখুশি আর মিশুক। নিচে খাবার ঘরে খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন কেয়ারটেকার মিঠুন। এই জনমানবহীন জায়গায় আশপাশে রেস্তোরাঁ দূরের কথা, একটা দোকানও নেই। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তিন কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে। দুপুরবেলার তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে হেঁটে কোথাও যাবার মানেই হয় না। কটেজের সামনে ছোট্ট কাটাও নদী। সবুজ, স্বচ্ছ পানি নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ি পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলছে। আমার জানালা দিয়ে বেশ খিলখিল করে হেসে হেসে বয়ে চলছে যেন। জানালার সামনে বসে সারা দিন এর রূপ দেখতে দেখতে সময় কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। আগামী কয়েক দিন সে রকম কিছু করা যায় কিংবা পদব্রজে দেখে নেওয়া যায় এই পাহাড়ি সবুজ, পাথুরে সোনালি গ্রাম।
রাতের খাবার খেতে খেতে আরও জানলাম, কটেজে রুম হিটার আছে, তবে তাতে রুম আরামদায়ক হবে কি না, সে নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এখানে রুম হিটার চালাবার মতো পর্যাপ্ত ভোল্টেজ থাকে না। রুম হিটার ছাড়া বরফের দেশে বসবাস করা আমার জন্য এই প্রথম। বাঙালি যুগল অন্তরা ও সৌমিতের সঙ্গে গল্প করতে করতে ওরা জানালেন, ব্র্যান্ডি পান করে ঘুমিয়ে পড়লে নাকি তেমন ঠান্ডা লাগে না। কাটাওয়ের সীমানাঘেঁষা এ গ্রামে এখন বরফ পড়ছে না, তবে ক্ষণে ক্ষণে থেমে থেমে পড়ে সাধারণত। পাহাড়ের সামান্য ওপরে সারা বছরই বিরাজ করে বরফ। সেখানেই যেন এখন আটকে আছে আমার মন।
আরও মজার তথ্য দিলেন মিঠুন। সূর্যোদয় উপভোগ করতে এবং দিনের প্রথম, তাজা বরফ ছুঁয়ে দেখতে চাইলে আমাকে বের হতে হবে ভোর চারটায়। তাই মাঝরাতে উঠে হাতমুখ ধোবার জন্য কলে পানি না থাকলে যেন রাগ না করি। কেননা তখন প্রচ- ঠান্ডায় পাইপের পানি জমে বরফ হয়ে যায়। বেশ মজার তো! অবশ্য এই আমুদে হাসি-আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমি রুমে ঢুকে ঘুমানোর আয়োজন করতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। এ গ্রামে বিদ্যুৎ চলে গেলে কখন আসে, ঠিক নেই। তার ওপর নেই মোবাইলে নেটওয়ার্ক। ভারত-চীন সীমান্তে হওয়ার কারণে সেনাবাহিনীর কড়া নজরদারির ভেতরে এখানে কাটাতে হয় জীবন।
যোগাযোগবিচ্ছিন্ন কিংবা দুর্গম জায়গায় থাকতে আমার তেমন অসুবিধা হয় না। মাঝেমধ্যে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন থাকা আমার পুরোনো অভ্যাস। তবে ঘুমাতে গিয়ে দেখলাম নতুন উপদ্রব। উপদ্রবটা আবহাওয়া। প্রচ- ঠান্ডা পড়েছে। তিনটা কম্বলেও কিছুতেই পায়ের পাতা ঠান্ডায় জমাট বাঁধা থেকে স্বাভাবিক হচ্ছে না। আফসোস হচ্ছে, অন্তরার পরামর্শ মেনে দু-এক ঢোঁক ব্র্যান্ডি গিলে নিলেই পারতাম!
এমনিতেই এই গ্রামে স্থানীয় কোনো অধিবাসী দেখিনি। এখন এই রাতের বেলায় সবকিছু ধূসর হয়ে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। বাইরে আলো নেই কোনো। গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে দুলছে। পাইন, দেবদারুগাছের পাতাদের এলোমেলো নাচ দেখতে দেখতে তিনটা বেজে গেল। বিদ্যুৎ এসে গেছে। এর মধ্যে মিঠুন গরম পানি দিয়ে গেলেন হাত-মুখ ধোবার জন্য। কলে এখন সত্যিই পানি আসছে না। বাইরের পথেও হালকা সাদা কুচি কুচি বরফের চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে আকাশ। বরফের আস্তর পুরু হতে হতে বিছানা করে শুয়ে পড়তে চাইছে যেন চাঁদ।
আমি এখন যাব বরফে ডুবে যাওয়া রাজ্য দেখতে। জিপচালক তৈরি ছিলেন। বরফের আবরণ আর পাহাড়ি চড়াই-উতরাইয়ের কারণে ট্যাক্সি চালানো মুশকিল, তাই জিপই ভরসা। এই পথে আজ বরফ পড়ার পর এটিই প্রথম গাড়ি যাচ্ছে; আগের গাড়ি এখনো চাকা বিছিয়ে পথ করে রাখেনি। যতই ওপরের দিকে উঠছি, রজনীগন্ধা হচ্ছে চারপাশ। ফুলের মতো সফেদ বরফে ঢেকে গেছে পাইনগাছের পাতা। ঝিরিঝিরি বরফের ছাটে ছিটকে পড়ছে হাওয়া। খিলখিল করে হাসতে চাইছে পাহাড়। সে হাসি দেখা যাচ্ছে না। খানিক বাদে সূর্য উঠলে এই হাসিখুশির রাজ্য আরও স্পষ্ট হবে। পথের দুপাশে গতকালের বরফ স্তূপ হয়ে পাহাড়ের বরফরাশির সঙ্গে মিশতে চাইছে। চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা। এর মাঝে ধীরে ধীরে গাঁদা ফুলের মতো হলুদ আলো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায়, পুব দিক থেকে।
নিজেকে বললাম, জিপ থেকে নেমে দিনের প্রথম বরফ ছুঁয়ে দেখার, গায়ে মাখার ইচ্ছা কোনোমতেই দমন করা ঠিক হবে না। কাটাওয়ে আমার মতো উল্টো পথে হাঁটা ভ্রমণার্থীরা আসেন এই নিষ্পাপ, তাজা বরফ দেখার আশায়। এ বরফ পড়ার মাঝে যে নীরবতা, সেই নৈঃশব্দ্য এক যোগাযোগ তৈরি করে রাখে সমস্ত চরাচরের সঙ্গে। গাছের সব পাতায় সাদা বরফে আলোর খেলা। সূর্য এবার পলাশ ফুলের রং ছড়াচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। ধাক্কা মেরে যেন ভাঙিয়ে দিতে চাইছে পাহাড়ের ঘুম। আধো আলো, আধো অন্ধকারে টুপটাপ ঝরে পড়া বরফের মুকুট মাথায় নিয়ে, সফেদ পোশাক পরে পাহাড়, গাছ, পথ- সব যেন নতজানু হয়ে আছে সূর্যের পূর্ণরূপের।
আমিও চেয়ে আছি সূর্যের উথলে ওঠার পানে। কিন্তু পাহাড়ি সূর্যের মর্জি বোঝা দায়। কখনো উচ্ছল, কখনো গম্ভীর। পাহাড়ে ওঠার পায়ে চলা পথের নিশানা নেই, শুধুই বরফ। সেদিকে পা রাখলে হাঁটু অবধি ডুবে যেতে হয় বরফের কোমল সমুদ্রে। আবার ইচ্ছে করলে গড়াগড়িও করা যায়।
আমার পরে আরও কয়েকটি গাড়ি ভরতি করে বাঙালি ট্যুরিস্টরা এসেছেন এখানে। তারা বরফে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, হিন্দি সিনেমার দৃশ্যের মতো বরফের বল বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুড়ে মারছেন। মানুষের আনন্দ, উচ্ছলতা দেখার চেয়ে বড় আনন্দ আর নেই।
এই খেলা দেখার পর আমাকে জিপচালক নিয়ে গেলেন ভারত-চীন সীমান্ত দেখাতে। এখানেও বরফের রাজ্য পার হতে হবে। কাটাও অবশ্য সারা বছরই বরফে আবৃত থাকে। সাদাকালো চিত্রকর্মের মতো প্রকৃতিও এখানে সব সাজিয়ে সৌন্দর্য মেলে ধরেছে। কিছুদূর চলার পর জিপ থেমে গেল। জানা গেল ভারী তুষারপাতের কারণে সামনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। আর আগানো যাবে না।
আমার সামনে অনেকগুলো জিপ আটকে রয়েছে। বরফ আগেই পুরু স্তর করে রেখেছে। সেনাসদস্যরা নেমে পড়েছেন স্নো মুভিং ইক্যুইপমেন্ট, মানে ট্রাক্টর ও বিশেষ ব্লেড দিয়ে পথ থেকে বরফ সরানোর কাজে। রাস্তার দুপাশের বরফের উচ্চতা এখন ১২ ফুটের মতো। অন্য জিপগুলো থেকে বাচ্চাদের পাশাপাশি বড়রাও নেমে বরফে লুটোপুটি করছেন। যেন তাদের সব আনন্দ এখানেই লুকিয়ে ছিল এত দিন। মানুষকে সুখী করতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না আসলে। এই যেমন আমি যদি জিরো পয়েন্ট বা সীমান্তে না যাই, তাহলে তেমন ক্ষতি হবে না। মানুষের আনন্দ দেখার, তাদের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখার যে আনন্দ, তা জগৎ দেখে নেবার সমান। এই নির্মল সাদা বরফের দেশের নিসর্গ দেখার যে তাড়না নিয়ে এসেছি, তা মানুষের আনন্দ দেখে অনেকখানি পূরণ হয়ে গেল।
এই তুষারের ভূমিতে তাই সাদা পরির ডানা হয়ে ওড়ে বরফের কণা, অনেক ঠান্ডায় সূর্যের ঝিলিক হয়ে যায় আমার স্বর্গ, আর হাওয়া ঠিক সেই সময়ে ঢেলে দেয় আমার মতো সাধারণ পথিকের মনের সব রং।
ছবি: লেখক