ফিচার I গৃহবাসী গাছের যত্নে
হাউসপ্ল্যান্ট। গৃহশয্যার দারুণ অনুষঙ্গ। প্রাচীনকাল থেকেই। নানা রূপে ও বৈচিত্র্যে। ওদেরও চাই যত্নআত্তি
ইট-পাথর-কংক্রিটে ঘেরা শহুরে জীবনে ঘন বৃক্ষরাজির দেখা মেলা ভার। তবু অক্সিজেনের এই সেরা উৎসের সান্নিধ্য পেতে, দেহ ও মনের ক্লান্তি হরণে, এমনকি ইন্টেরিয়র সৌন্দর্যবর্ধনে অনেকেই ঘরের ভেতর বিবিধ গাছের সমাহার ঘটান। এসব গাছ ইনডোর প্ল্যান্ট নামে পরিচিত। কেউ কেউ হাউসপ্ল্যান্টও বলেন। গৃহবাসী এই গাছগুলো বেশ আদরখেকো! করতে হয় বিশেষ যত্নআত্তি। নয়তো নেতিয়ে পড়ে, অথবা মরে যায়।
হাউসপ্ল্যান্ট যতেœ রাখা অবশ্য খুব বেশি ঝক্কির নয়। চাই একটু নিয়ম মানা। কিছু বিশেষ প্ল্যান্টের জন্য নেওয়া চাই বিশেষ খেয়াল। তবে তেমন সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদের প্রসঙ্গে না গিয়ে, সার্বিকভাবেই বরং দেখে নেওয়া যাক বিষয়টি। কোন কোন যত্ন আসলে কম-বেশি সব হাউসপ্ল্যান্টেরই দরকার, তা জানার আগে চলুন ইতিহাসে একটু ঢুঁ মারি।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে, পটেড প্ল্যান্ট বা পাত্রে গাছ লালনের মাধ্যমে ইনডোর গার্ডেনিং চর্চার প্রথম দেখা মেলে প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের মধ্যে। মিসর, চীন ও ভারতের মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলোতেও পটেড প্ল্যান্টের প্রচলন ছিল; তবে তারা মূলত তা দিয়ে গৃহের অভ্যন্তর নয়, বরং বহিরাঙ্গন ও উঠোন সাজাত। সেই সময়ে উদ্ভিদ ধারণের সেই পাত্রগুলো সাধারণত হয়ে থাকত পোড়ামাটির। অবশ্য প্রাচীন রোমানদের পাত্রগুলো ছিল ব্যতিক্রম। তারা সেগুলো মার্বেল দিয়ে বানাত।
অন্যদিকে, জাপানি, ভিয়েতনামি ও চীনা সংস্কৃতিতে উদ্ভিদকে অলংকারের শোভা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বামন করার এক অনন্য রেওয়াজ রয়েছে। ক্ষেত্র অনুযায়ী সেগুলো হন নন বো, পেনজিং ও বনসাই নামে পরিচিত। অবশ্য, আপনার ঘরে জায়গা পাওয়া প্ল্যান্টগুলো বনসাই ধরনের হোক, কিংবা হোক কোনো লতাপাতা কিংবা ফুলের গাছ, সেগুলোর যত্ন কীভাবে নেবেন, সেটাই মোদ্দা কথা। দুশ্চিন্তা এড়িয়ে চলুন, জানি কিছু সহজ কৌশল।
পানিতে প্রাণ
জানা কথা, হাউসপ্ল্যান্টের বেড়ে ওঠার জন্য পানি দরকার। তবে একেক ধরনের উদ্ভিদ ও এর পাত্রের জন্য পানির মাত্রা একেক রকম হতে পারে। ঘরে নতুন কোনো উদ্ভিদ আনার সময় আগে থেকেই জেনে নেওয়া চাই, সেটির পানির চাহিদা ও এর প্রয়োগবিধি। অবশ্য সার্বিকভাবে, পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা যথাযোগ্য আকারের একটি পাত্রে যখন ওপরের দিকের আধা থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ মাটি শুষ্ক হয়ে উঠবে, তখনই সেটিতে পানি দেওয়া ভালো। ক্যাকটাস ও রসাল জাতীয় উদ্ভিদের জন্য অবশ্য পানির প্রয়োজন কম; সেই তুলনায় ফুলগাছগুলো একটু বেশি পানিখেকো। তবে সাবধান! অতিরিক্ত পানি দিয়ে হাউসপ্ল্যান্টের সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেন অনেকেই। কোন উদ্ভিদের কখন কতটুকু পানি দরকার, তা যদি আপনার একান্তই না জানা থাকে, তাহলে পাত্রকে পানিতে না চুবিয়ে বরং মাটির শুষ্কতা উপলব্ধি করে সামান্য পানি দেওয়া শ্রেয়- এমনটাই অভিমত যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও বাগান বিশেষজ্ঞ এবং ‘বেটার হোমস অ্যান্ড গার্ডেনস’ ম্যাগাজিনের সাবেক সম্পাদক অ্যান্ড্রিয়া বেকের।
উর্বরতার উৎকর্ষ
পানি দেওয়ার মতোই উর্বরতা যাচাইয়ের সহজ কোনো উপায় নেই। এটি নির্ভর করে উদ্ভিদটির বৃদ্ধির হার ও বয়স এবং বছরের কোন সময়কাল চলছে, তার ওপর। বেশির ভাগ উদ্ভিদেরই দারুণ বৃদ্ধি ঘটে বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে। তাই এ সময়েই এগুলোতে প্রয়োজনীয় সার দেওয়া ভালো বলে অভিমত বেকের। তিনি আরও জানান, বছরের বাকি দিনগুলোতে এর খুব বেশি প্রয়োজন সাধারণত হয় না। আরও জেনে রাখুন, অতিরিক্ত পানির মতো অতিরিক্ত সার বা প্ল্যান্ট ফুড দেওয়াও আপনার অনেক শখের হাউসপ্ল্যান্টটির জন্য আখেরে ডেকে আনতে পারে বিপদ। তা উদ্ভিদটির শিকড় পুড়িয়ে দিতে পারে। থামিয়ে দিতে পারে স্বাভাবিক বৃদ্ধি। অন্যদিকে, এ ধরনের উদ্ভিদে সাধারণত তিন ধরনের সার সমপরিমাণে ব্যবহার করা হয়- নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম। যদি নাইট্রোজেনের মাত্রা বেশি পড়ে যায়, তাহলে ওই উদ্ভিদে হয়তো প্রচুর পাতা জন্মাবে ঠিকই, কিন্তু ফুল ধরবে বেশ কম।
অদল-বদল
আপনার হাউসপ্ল্যান্টের পাত্রটি পাল্টানোর দরকার আছে কি না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারলে শিকড় প্রণালি পরখ করে নিন। শিকড়গুলো যদি পাত্রের ভেতর বৃত্তাকারে পেঁচিয়ে যেতে শুরু করে, বুঝে নিন, সময় হয়েছে পাত্র বদলের। অন্যদিকে, উদ্ভিদটি যদি পাত্রের ধারণক্ষমতার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, সে ক্ষেত্রে ওটাকে আরেকটু বড় পাত্রে স্থানান্তর করাই মঙ্গল। তবে যদি ওই পাত্রেই রাখতে চান, তাহলে পাত্র থেকে উদ্ভিদকে তুলে, কিছু শিকড় ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিন। তারপর পাত্রে নতুন মাটি ভরে তাতে রোপণ করুন। বলা হয়ে থাকে, পাত্র বদলের জন্য বসন্ত ও গ্রীষ্মই ভালো সময়।
ধূলির জঞ্জাল
শহরের বাতাসের পরতে পরতে ধুলো ওড়ে- এ কথা কারই-বা অজানা? ধূলির আস্তর পড়তে থাকে হাউসপ্ল্যান্টেও; বিশেষত পাতায়। তাই এগুলোকে নিয়মিত ধূলিমুক্ত করা দরকার। সে ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন কোনো নরম কাপড়। তা দিয়ে আলতো করে মুছে নিতে পারেন ধূলিকণা। তাহলে আপনার প্ল্যান্ট আরও সতেজ থাকবে।
হলুদ হাপিত্যেশ
অনেক যত্নে রাখার পরও কোনো না কোনো কারণে হাউসপ্ল্যান্টের কিছু পাতা হলুদ হয়ে উঠতে পারে, কিছু ফুল মরেও যেতে পারে। উদ্ভিদটির শুশ্রুষার জন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে এমন ধরনের পাতা ও ফুল ছেঁটে ফেলতে হবে। অন্যথায় তা ছড়িয়ে যেতে পারে সজীব অংশগুলোতেও। তবে এ ক্ষেত্রে একান্ত দরকার না পড়লে কোনো ধরনের ওষুধ ব্যবহার না করাই উত্তম।
পোকার উপদ্রব
হাউসপ্ল্যান্টে পোকামাকড়ের উপদ্রব হরদমই ঘটে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবহার করতে পারেন ইনসেক্ট পেস্ট। কত দিন ব্যবহার করবেন, তা জেনে নিন। সাধারণত এক মাস ধরে সপ্তাহে এক দিন ব্যবহারের পরামর্শই দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। মাকড়সা জাতীয় কোনো পতঙ্গ যদি প্ল্যান্টকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেই জালগুলো আলতো করে সরিয়ে নিন। অন্যদিকে, মাটি স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলে হাউসপ্ল্যান্ট ঘিরে গুনগুনিয়ে উড়তে দেখা যায় ছোট ছোট মাছিকে। ওরা খুবই বিপদ বয়ে আনতে পারে। তাই মাটি যেন স্যাঁতসেঁতে না হয়, খেয়াল রাখুন।
বিপদ-বার্তা
হাউসপ্ল্যান্টের জন্য বিপদ-ঘণ্টি বেজে যেতে পারে হুট করেই। তবে কিছু ব্যাপারে আগাম সতর্ক থাকলে ক্ষেত্রবিশেষে তা এড়ানো সম্ভব। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং ম্যানহাটান অর্কিড সোসাইটির বোর্ড মেম্বার ক্রিস্টোফার স্যাচের কিছু পরামর্শ জানা যাক:
মাটি যদি বেশি নরম ও ভেজা থাকে, বুঝতে হবে আপনি মাত্রাতিরিক্ত পানি দিয়েছেন। তাহলে শিকড়গুলো পাত্রের বাইরে বেরিয়ে যেতে শুরু করতে পারে। ফলে পচন ধরতে পারে শিকড়ে।
প্ল্যান্টের প্রান্তগুলো কালো হতে শুরু করলে অনেকেই ভাবেন, আর্দ্রতা কম থাকাই বুঝি এর কারণ। অথচ সব সময় তা ঠিক নয়। কখনো কখনো এর পেছনে ভূমিকা রাখে ফাংগাসও।
পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া মানেই বিপৎসংকেত। এমনটা অতিরিক্ত গরমের কারণে ঘটতে পারে, আবার অতিরিক্ত ঠা-ার কারণেও। অতিরিক্ত ভেজার কারণে ঘটতে পারে, আবার অতিরিক্ত শুষ্কতার কারণেও। তাই কারণ খুঁজে বের করুন। তবে উদ্ভিদের বেশির ভাগ পাতা যদি সবুজই থাকে, সে ক্ষেত্রে দু-একটি হলুদ হলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। অনেক সময় এমনটা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিকভাবেই ঘটে।
পাতা যদি কুঁচকে যেতে কিংবা ঝরে পড়তে শুরু করে, বুঝে নিতে হবে, আপনি পর্যাপ্ত পানি দিচ্ছেন না। আপনার উদ্ভিদটি তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছে!
উদ্ভিদের নিচের দিকের পাতাগুলো হলদেটে হতে শুরু করলে জেনে রাখুন, মাত্রাতিরিক্ত পানি দিয়ে পচন ধরিয়ে দিচ্ছেন আপনি!
পাতা ঝরার আরও অনেক কারণের মধ্যে একটি হলো, পর্যাপ্ত আলো না পাওয়া। গৃহবাসী উদ্ভিদ এমনিতেই খুব বেশি আলোর দেখা পায় না। অথচ আলো থেকেই খাদ্য সংশ্লেষ করে এরা। তাই ওগুলোকে যতটা সম্ভব আলোতে রাখুন, অন্তত দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে।
প্ল্যান্টের আশপাশে যদি ডাঁশ মাছি ধরনের পতঙ্গের আনাগোনা বেশি দেখতে পান, ধরে নিতে হবে, আগে দেওয়া পানি শুকানোর সুযোগ না দিয়েই আবারও পানি দেওয়ার বদ-অভ্যাস রয়েছে আপনার।
মনে রাখবেন, গাছের আসলে সরাসরি সূর্যের আলোর দরকার পড়েই। তাই আলো পাক আপনার ঘরে জায়গা নেওয়া হাউসপ্ল্যান্ট।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট