skip to Main Content

টেকসহি I ছয় বিন্দুর আলো

৪ জানুয়ারি। ওয়ার্ল্ড ব্রেইল ডে। অন্ধের চোখে আলো ছড়ানোর এই যুগান্তকারী লেখন পদ্ধতির কথা জানাচ্ছেন জাসিয়া শামীম

নানা রঙে আঁকা রঙিন এই পৃথিবী আমাদের কতই-না পছন্দের! প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা লাখো জিনিস দেখি ও পড়ি চোখ দিয়ে। একবার ভাবুন তো, আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। হয়তোবা শুধু অল্প একটু আলোর ছটা? ভয় পাবেন না। এই লেখা পড়তে পারছেন কিংবা আশপাশে সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন মানে আপনার দৃষ্টি যথেষ্ট ঠিকঠাক। অথচ সারা বিশ্বে ৩৯ মিলিয়নের বেশি মানুষ দৃষ্টিহীনতায় ভুগছে। তাদের মধ্যে কেউ জন্মগত, কেউ দুর্ঘটনার শিকার, কেউ আবার কোনো রোগে হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। তারাও যেন আমার-আপনার মতো লিখতে-পড়তে জানেন, সে জন্য আধুনিক বিজ্ঞান এনে দিয়েছে এক বিশেষ সুবিধা। ব্রেইল। নেপথ্য গল্পটা বেশ হৃদয়স্পর্শী।
১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি, প্যারিসের পাশর্^বর্তী কুভ্রে নামক গ্রামে জন্ম নেন লুই ব্রাইল (ইংরেজি উচ্চারণে ব্রেইল)। সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিলেও তিন বছর বয়সে একদিন বাবার দোকানের ভারী জিনিসপত্র নিয়ে খেলার সময়, কাঠ ফুটো করার সুচ হাত থেকে ফসকে পড়ে তার ডান চোখে ঢুকে যায়। তাতে দুই চোখের সংবেদনশীলতা মারাত্মক বিঘিœত হয়ে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেন দৃষ্টিশক্তি। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে ওঠেন একজন প্রতিশ্রুতিশীল মিউজিশিয়ান। ১৮১৯ সালে স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে যান প্যারিসের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড চিলড্রেনে। সেখানেই চার্লস বারবিয়েরের নাইট রাইটিং বা নৈশকালীন লেখন পদ্ধতির প্রতি আগ্রহ জাগে তার। সে সময়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পড়তে ও লিখতে পারতেন।
ব্রেইলের গল্পে ফেরার আগে বারবিয়েরের কাছে যাওয়া যাক একটু। ১৮০০ সালে চার্লস বারবিয়ের জগদ্বিখ্যাত যুদ্ধবাজ ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেনাদলে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি লক্ষ করেন, ফ্রেঞ্চ সেনারা রাতে কমব্যাট মেসেজ পড়তে ল্যাম্প জ্বালালেই প্রতিপক্ষ সেই আলো দেখে তাদের অবস্থানে গুলি ছোড়ে। তাতে প্রাণ যায় অসংখ্য সৈন্যের। এই সমস্যার সমাধানে ১২ বিন্দু ব্যবহারের মাধ্যমে একধরনের লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন চার্লস বারবিয়ের। পাশে ২ বিন্দুর এবং নিচে ৬ বিন্দুর ঘর ছিল এই পদ্ধতিতে। বিন্দুগুলো একেকটি অক্ষর বোঝাত। রাতে আলো না জ্বালিয়ে মিলিটারি কমব্যাট মেসেজ পড়া গেলেও সেটা বুঝতে অসুবিধা হতো প্রায়ই। কারণ, আঙুলের ডগা একবার ছুঁয়েই ১২ বিন্দু অনুভব করতে পারা ছিল বেশ মুশকিলের কাজ।
লুই ব্রেইল ১৫ বছর বয়সে সেই ১২ বিন্দুর পদ্ধতিকে ৬ বিন্দুর কোডে রূপান্তর করেন। তার নামেই এই লিখন পদ্ধতির নামকরণ হয় ‘ব্রেইল’। ১৮২৬ সালে তিনি সেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড চিলড্রেনে শিক্ষকতা শুরু করেন, অন্যান্য দৃষ্টিহীন মানুষকে পড়ালেখা শেখানোর জন্য। ১৮২৭ সালে তিনি প্রথম ব্রেইল পদ্ধতির বেশ মোটা একটি বই প্রকাশ করেন। অবশ্য, সেটি খুব একটা ব্যবহারবান্ধব কিংবা বোধগম্য ছিল না। ১৮৩৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো আধুনিক যুগের বিকশিত ছোট ব্রেইল পদ্ধতির বই প্রকাশ পায়।
আয়তাকার প্লেটের মতো কাগজে ব্রেইল দুই সারিবিশিষ্ট ছয়টি বিন্দুর সমষ্টি। কাগজের ওপর এই বিন্দুগুলো ভিন্নভাবে সাজিয়ে একেকটা অক্ষর বা বর্ণ বোঝানো হয়। এভাবে মোট ৬৩টি নকশা তৈরি করা যায়, যা দিয়ে লেখা হয় একেকটি অক্ষর, সংখ্যা বা যতিচিহ্ন। মোট ছয়টি বিন্দুর মধ্যে কতগুলো বিন্দু কীভাবে উন্নীত আর সমতল আছে, তা স্পর্শের মাধ্যমেই করা যায় পাঠোদ্ধার। যেমন যদি শুধু বাম পাশের একটি বিন্দু উন্নীত এবং বাকি পাঁচটি বিন্দু সমতল থাকে, তাহলে সেটি ইংরেজির প্রথম বর্ণ ‘এ’। বলে রাখি, ব্রেইল পড়তে হয় বাম থেকে ডান দিকে।
দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল একটি বৈপ্লবিক আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। এটি কোনো ভাষা নয়; শুধুই একটি লিখন পদ্ধতি। সবাইকে শুরুতে ব্রেইল পড়া শিখতে হয়। তারপর শিখতে হয় এর লিখন পদ্ধতি। ব্রেইল পদ্ধতিতে লিখতে হয় উল্টা করে, যাকে আমরা বলি মিরর ইমেজ। কেন? কারণ, ব্রেইল লিখতে হয় মোটা কাগজের ওপর একটু চোখা সরু ধাতব দিয়ে, দাবিয়ে দাবিয়ে। যাকে আবার এম্বোস করা লেখাও বলা হয়ে থাকে।
ব্রেইল রাইটার বা ব্রেইলার নামে একটা যন্ত্র বা টাইপ মেশিন আছে। দেখতে টাইপরাইটারের মতোই। সেই মেশিনে ছয়টি বাটন, একটি স্পেস বার, ক্যাপিটাল লেটার বা বড় হাতের অক্ষর ও সংখ্যা লেখার জন্য আলাদা দুটি বাটন এবং ব্যাকস্পেস ও পরের লাইনে যাওয়ার জন্য আলাদা দুটি বাটন রয়েছে। এই মেশিনে খুব শক্ত কাগজ ব্যবহার করা হয়, যেন উন্নীত অক্ষরগুলো ছিঁড়ে না যায়। আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ব্রেইলের চাহিদা কিছুটা কমেছে। সেই জায়গা দখলে নিচ্ছে অডিও বুক। তবে অডিও বুক কিংবা রেকর্ডিং শুনে সব খবর পেলেও একজন দৃষ্টিহীন মানুষের পক্ষে তাতে লেখা শেখা সম্ভব নয়। ফলে ব্রেইলের প্রয়োজন এতটুকুও কমেনি। কেননা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে এটি খুবই দরকারি।
যাত্রার শুরুতে শুধু ইংরেজি ভাষায় লিখন শিখিয়েছে ব্রেইল। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় এর ব্যবহার ঘটছে। রয়েছে বাংলায়ও। আমাদের দেশে ব্রেইল প্রকাশনার মাধ্যমে অমর একুশে বইমেলায় একদম বিনা মূল্যে বিভিন্ন ধরনের ব্রেইল প্রকাশনা বিতরণ করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই ডিজিটালাইজড হচ্ছে। ঘরে বাজার আনা থেকে শুরু করে দেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে অংশগ্রহণ- কী না করা যায় আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে? স্বভাবতই ব্রেইলও থেমে থাকবে না শুধু বই ও খাতার ভাঁজে। বুলগেরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী ক্রিস্তিয়ানা সেভেতানোভাকে একবার তার এক দৃষ্টিহীন বন্ধু অনলাইন ক্লাসে সাইন-আপ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে বলেছিলেন। এ ঘটনা ক্রিস্তিয়ানাকে বেশ নাড়া দেয়। তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। টেকনোলজির কাছ থেকে দৃষ্টিহীনদের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি ভেবে অসাধারণ একটা বুদ্ধি বের করে ফেলেন। ২০১৪ সালের ঘটনা। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় গিয়ে বিটল্যাব টেকনোলজি নিয়ে কাজ শুরু করেন ক্রিস্তিয়ানা। বিটল্যাব হলো এমন একটি ট্যাব, যা শুধু দৃষ্টিহীনদের ব্যবহারের জন্য। দেখতে অনেকটা ল্যাপটপের মতো এই ট্যাবের নিচের অংশে থাকবে ব্রাউজিং সিস্টেম, যেখানে ভয়েস সিস্টেম ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে। আর এর ওপরের অংশে থাকবে স্ক্রিনে ছিদ্রযুক্ত গ্রিড। সেই স্ক্রিনের স্মার্ট লিকুইড অ্যালার্ট সেই ছিদ্রযুক্ত গ্রিডে গিয়ে বার্তাকে ব্রেইল পদ্ধতির অক্ষর, ম্যাপ কিংবা ছবিতে রূপান্তর করবে। বিটল্যাব অবশ্য এখনো আপগ্রেড ও ম্যানুফেকচার করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগির বাজারে আসবে।
শুধু দৃষ্টিহীনেরাই নন, চাইলে দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষও ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করে লিখতে পারবেন খুব সহজে! এর জন্য গুগল থেকে জেনে নিতে হবে ব্রেইলের অক্ষর, সংখ্যা আর যতিচিহ্নগুলো। কম্পিউটার বা ল্যাপটপে ডট বা ফুলস্টপ ব্যবহার করে লিখে ফেলুন যা মনে আসে। তারপর সেই লেখাকে মোটা কাগজে (সাধারণত ১৪০-১৬০ জিএসএম) প্রিন্ট করুন। এরপর কাগজটি উল্টিয়ে একটু চোখা সরু ধাতব দিয়ে, দাবিয়ে দাবিয়ে তৈরি করে ফেলুন আপনার ব্রেইল!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top