skip to Main Content

মনোযতন I অনিদ্রা অত্যাচার

ইনসমনিয়া। নিদ্রাহীনতার ব্যাধি। অনেকেই ভুগছেন জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতে। সমাধান কীভাবে? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনে যারা ঘুমাতে শিখেছেন, তাদের বলি, একই মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো ঘুমের খোঁজে ছুটে চলা মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। শুনে আশ্চর্য হবেন, বয়সভেদে বিশে^র প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই নিদ্রাহীনতা বা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন; বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী ও নতুন মায়েদের ৫০ শতাংশই পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত। আজকাল শিশু-কিশোরেরাও এতে বেশ ভুগছে। আর করোনা এসে বাড়িয়ে দিয়ে গেছে এই রোগ তাড়িয়ে বেড়ানো মানুষের সংখ্যা।
অনিদ্রা পরিচয়
সময় হওয়ার পরও যদি আপনার ঘুম না আসে কিংবা ঘুমে সমস্যা হতে থাকে, অথবা এলেও একটু পর ভেঙে যায়, একবার ঘুম ভাঙলেই আর আসতে চায় না- এমন সমস্যায় প্রতিনিয়ত ভুগতে থাকাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রাব্যাধি। সাধারণত এটি তিন ধরনের হয়ে থাকে:
 হঠাৎ কোনো এক রাত ঘুমহীন কাটানো কিংবা মাসের কোনো এক বা দুদিন ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া; এ ধরনের অনিদ্রার ক্ষেত্রে সাধারণত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না।
 সপ্তাহপ্রতি অনধিক তিন রাত নিদ্রাহীন কাটানো; এ ধরনের সমস্যা কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেলে সাধারণত ঠিক হয়ে যায়।
 দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা কিংবা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব। এ ক্ষেত্রে রোগীরা অন্তত তিন মাস ধরে সপ্তাহে তিন বা ততোধিক রাত অনিদ্রার যন্ত্রণায় ভোগেন। এই অবস্থার রাজ্যের কারণ থাকতে পারে। তাই সমাধানের বেলায়ও মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পথে হাঁটা চাই।
উপসর্গের দাঁড়ি-কমা
ইনসমনিয়ার কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে; যেমন-
 রাতে ঘুম না আসা;
 শারীরিক দুর্বলতা;
 মাথাব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করা;
 দিনেও ঘুম ঘুম ভাব;
 ঘুম ঘুম ভাব থাকলেও দিনে ঘুমানোর চেষ্টা করলে ঘুম না আসা;
 দিনভর শরীরে ক্লান্তি ভর করা;
 ক্লান্তির ফলে দিনে কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা;
 শরীর ম্যাজম্যাজ করা;
 আচরণজনিত সমস্যা, মেজাজ রুক্ষ হয়ে যাওয়া কিংবা মনমরা ভাব থাকা;
 মনোযোগ এবং স্মরণশক্তি কমে যাওয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে সতর্ক হোন; প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
বাসা বাঁধার কারণ
বলা হয়ে থাকে, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তাই ইনসমনিয়ার মূল কারণ। এ ছাড়া অনেক কারণে বাসা বাঁধতে পারে ইনসমনিয়া নামের পাগলাটে দানব। চলুন, কারণগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিজেকে সতর্ক করে নিই-
 মানসিক চাপ, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও বিষণœতায় ভোগা;
 শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটা;
 ব্যক্তিগত জীবনে কলহ কিংবা পারিবারিক, সামাজিক বা চাকরি ক্ষেত্রে কোনো বিষয় নিয়ে বিষণœ অথবা বিচলিত থাকা;
 জীবনধারায় শৃঙ্খলার অভাব;
 মদ ও মাদক সেবন;
 কোনো ওষুধের পাশর্^প্রতিক্রিয়া;
 বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের উপসর্গের হানা;
 কাজের এলোমেলো সময়;
 পরিবেশগত সমস্যা;
 ঘুমে ব্যাঘাত…প্রভৃতি।
প্রতিরোধের গতিপথ
লাইফস্টাইলে পরিমার্জন এনে তাড়ানো যেতে পারে অনিদ্রার ভূত। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
 ডিভাইসকে টা টা: ঘুমের আগে দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলোর আলোর প্রতিফলন আপনাকে ঘুম থেকে দূরে রাখতে পারে!
 দিনের শেষাংশে ক্যাফেইন-অ্যালকোহলকে লাল কার্ড: অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না! বুঝতেই পারছেন কী বোঝাতে চেয়েছি! তাই বলি, দিনে যা-ই করুন না কেন, রাতের বেলা ক্যাফেইন, নিকোটিন, অ্যালকোহল ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন। ক্যাফেইন ও নিকোটিন ঘুমকে তাড়িয়ে বেড়ায়! অ্যালকোহলের কারণে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি রাতে ঘুম ভালো না-ও হতে পারে; মাঝরাতে ভেঙে যেতে পারে ঘুম।
 নিয়মিত ও রুটিনে ব্যায়াম: রুটিন করে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। তবে ঘুমের আগে ব্যায়াম করবেন না, অন্যথায় ঘুম আসতে সমস্যা হবে। রাতে ব্যায়াম করলে ঘুমাতে যাওয়ার তিন-চার ঘণ্টা আগে করুন।
 খাবারে লাগাম: রাতের খাবারে লাগাম টানুন। পেটে অতিরিক্ত খাবার যাওয়া মানেই ঘুমের গ-গোল!
 এয়ার প্লাগে দম: ভালো ঘুমের জন্য বেডরুমকে আরামদায়ক করে তুলুন। ঘরটা যেন পর্যাপ্ত অন্ধকার ও শব্দহীন থাকে এবং খুব বেশি গরম অথবা ঠান্ডা না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখুন। যদি শব্দের সমস্যা থাকে, তাহলে এয়ার প্লাগ পরে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
 পজিশন বদল ও বইয়ের পাতায় ঘুমের খোঁজ: শোয়ার পর ঘুম না এলে বিভিন্ন পজিশনে শুয়ে দেখুন। যে পজিশনে আরাম অনুভব করেন, সেটাকেই বেছে নিতে পারেন। তা ছাড়া শোয়ার পর ঘুমের আগে রিলাক্স হওয়ার জন্য বই পড়তে পারেন। শুনতে পারেন গানও।
 যেমন খুশি তেমন: চাইলে ঘুমের আগে শাওয়ার নিতে পারেন। এ ছাড়া আপনার শরীর-মন উত্তেজিত না হয়, এমন যেকোনো কাজ করতে পারেন। ঘুম ঘুম ভাব এলে ফের বিছানায় পিঠ ঠেকাতে পারেন। শোয়ার পরে যদি পরের দিনের কাজ নিয়ে চিন্তা হয়, তাহলে একটা কাগজে সেগুলোর লিস্ট করুন। এতে দুর্ভাবনা কমে আসবে।
সমাধান সন্ধান
পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারেন। ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খেতে হবে- এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হকের মতে, স্লিপ হাইজিন বলে একটা ব্যাপার আছে, যা মেনে চললে হারানো ঘুম অনেকটাই ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মনে রাখবেন, ইনসমনিয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর প্রতিকার দরকার। তাই প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আরও মানতে পারেন যা
 দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম: সুস্থ জীবনের জন্য দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। যারা রাতে কাজ করেন, তারা দিনে আট ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন।
 সুষম খাবার, হাঁটা ও শরীরচর্চা: খেতে হবে সুষম খাবার। সেই সঙ্গে আধঘণ্টা করে হলেও নিয়মিত হাঁটা বা শরীরচর্চা করা চাই।
 সময় ধরে ঘুম: দৈনিক একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করা ভালো। এমনকি ছুটির দিনেও মানা ভালো এই রুটিন।
 ভাবনায় লাগাম: ঘুমের সময় দিনের অন্যান্য কাজ, সমস্যা, ঘটনা কিংবা পরদিনের পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকুন।
 ঘড়িতে মানা: ঘুম না এলে বারবার ঘড়ি দেখা কিংবা ঘড়ির টিকটক শব্দ শোনার জন্য অস্থির হয়ে পড়া যাবে না। শুধু তা-ই নয়; ঘড়ি দেখে ঘুম না এলে এ জন্য ঘুমের ওষুধ হিসেবে যেকোনো কিছু খেয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
 নিয়ন্ত্রণে থাক ডায়াবেটিস: দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা মানবদেহে বিভিন্ন গুরুতর জটিলতার জন্য দায়ী। কারও ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে আনুন।
 ওষুধ ও কাউন্সেলিং: অপর্যাপ্ত ঘুমের ধরন ও তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেতে হবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কাউন্সেলিংয়েও পেতে পারেন সমাধান।
 যা করবেন না: বিভিন্ন রকম সাইকোথেরাপি যখন সম্পূর্ণভাবে কাজ না করে বা ব্যর্থ হয়, তখন অবশ্যই ফার্মাকোথেরাপি বা ওষুধের প্রয়োজন পড়ে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা স্বল্পমেয়াদি অথবা ক্রনিক ইনসমনিয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই কোনো ওষুধ খাবেন না!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top