যাপনচিত্র I প্রকৃতির পরশে
সারাহ্ আলম। সম্প্রতি অমিতাভ রেজার ‘বোধ’ ওয়েব সিরিজে অভিনয় করে আলোচিত। ক্যারিয়ার শুরু রেডিও জকি হিসেবে। প্রতিশ্রুতিশীল এই মডেল, অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা ও ভয়েস আর্টিস্টের একান্ত জীবন কেমন?
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার ওপর নির্ভর করে সকালে ঘুম ভাঙে সারাহর। একমুখ হাসি ও লম্বা এক ঘুম তার কাছে সেরা নিরাময়। সুযোগ পেলে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা ঘুমোতে চান। তবে সাধারণত ৮টা-৯টার মধ্যেই উঠে পড়তে হয়। তারপর করেন ইয়োগা। একসময় নিজের পোষা কুকুর দুটিকে নিয়ে সকালে হাঁটার অভ্যাস ছিল। ইদানীং রাস্তা অনেক ব্যস্ত থাকায় তা করা হয় না। ইয়োগা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে সারেন ব্রেকফাস্ট। দেশে প্রচলিত খাবারই বেশি পছন্দ। সকালে পাতে রাখেন রুটি ও আলুভাজি। তবে তাড়াহুড়ো থাকলে স্যান্ডউইচই সই। আরও কম সময় থাকলে বেছে নেন সিরিয়াল [খাদ্যবিশেষ]। গ্রীষ্মকালে ফ্রেশ ফলের জুস ফ্রিজে প্রস্তুত করা থাকে। শীতকালে জুসের বদলে রাখেন দুধ; সঙ্গে ডিম।
একসময় করপোরেট জীবনের বেশ চাপ সামলেছেন। এখন চাকরি না করায় আগের চেয়ে বেশি সময় পাচ্ছেন সৃজনশীল কাজে মগ্ন হওয়ার। বলে রাখি, শিক্ষাজীবন থেকে ফুলটাইম জব করার অভিজ্ঞতা থাকায় কাজের চাপ সামলাতে সুনিপুণ সারাহ্; টাইম ম্যানেজমেন্ট স্কিলও দারুণ তার। টিভিসি থেকে শুরু করে ওয়েব সিরিজসহ বিভিন্ন কাজে অমিতাভ রেজাকে পেয়েছেন অভিভাবক হিসেবে। উপস্থাপনায় অনুপ্রেরণা অপরাহ উইনফ্রে, হানিফ সংকেত, দেবাশীষ বিশ্বাস, নাবিলা, মুনমুন প্রমুখ। হেলেনা বনহাম কার্টার, এমা ওয়াটসন, এমা স্টোনদের ভয়েস তার বেশ প্রিয়। সার্বিকভাবে অভিনয়ে অনুপ্রেরণা নাটালি পোর্টম্যান ও অ্যান হ্যাথাওয়ে। ভালো লাগে এলিয়ট পেজকেও। অবসরে পছন্দ করেন টিভি সিরিজ দেখতে। পছন্দের টিভি সিরিজের তালিকা বেশ দীর্ঘ: ইনটু দ্য ওয়াইল্ড, এন্টার দ্য ভয়েড, মাইন্ড হান্টার, দিল্লি ক্রাইম, মির্জাপুর, ঘৌল, স্ট্রেঞ্জার থিংস, ক্রাউন, বেটার কল সোল, ফ্রেন্ডস, বিগ ব্যাং থিওরি, দ্য পলিটিশিয়ান, হাউ আই মেট ইওর মাদার, দ্য আইটি ক্রাউড, ব্রেকিং বেড, নারকোস, দ্য ব্ল্যাক মিরর, ডার্ক, ওজার্ক প্রভৃতি। দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস, ভাত দে, আগুনের পরশমণি প্রভৃতি তার পছন্দের সিনেমা।
সারাহর দুপুরের খাবার গ্রহণের সময় নির্ভর করে ব্যস্ততার ওপর। ফাস্ট ফুড একদমই পছন্দ করেন না। এ সময় মেনুতে থাকে ভাত, শাকসবজি ও মাছ। ফ্রি টাইমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডাবাজি ভালো লাগে। আড্ডার বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন প্রকৃতি, লাবণ্য, মালিহা, আনুশকা, রুমি প্রমুখ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সারাহকে সব সময় মুগ্ধ করে। বাসার ইন্টেরিয়রে তা স্পষ্ট। পুরো বাসা সাজিয়েছেন গাছপালা দিয়ে। অন্ধকারাচ্ছন্ন শেডের লাইট পছন্দ করেন। দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে তার ঘর। সারাহ্ বেশ ভ্রমণপিয়াসী। ভ্রমণ মানেই বেঁচে থাকা তার কাছে। ভুটান, নেপাল, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে ঘুরেছেন। হাতে সময় নিয়ে ভ্রমণ পছন্দ। চেষ্টা করেন একটি জায়গা ঘুরে দেখতে অন্তত ১৫ দিন সময় নিতে। সলো ট্রিপই বেশি দেন। ব্যাকপ্যাক নিয়ে হেঁটে বেড়াতে এবং কোনো জায়গা মনে ধরলে সেখানে বসে বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণের জায়গাটিকে অনুভব করতে স্থানীয়দের মতো জীবনযাপনও করেন কখনো কখনো। ইন্দোনেশিয়ার কুটা, নুসা পেনিদার টিং টিং, আতুহ, ডায়মন্ড, লুমানগানসহ বিভিন্ন সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সমুদ্রের চেয়ে পাহাড় তাকে টানে বেশি। হয়তো এ কারণেই ভ্রমণে ভুটান তার সবচেয়ে পছন্দের দেশ। সেখানকার ত্রংসা নামক এক গ্রামে কাটিয়ে এসেছেন স্মরণীয় কিছু মুহূর্ত। চারপাশে পাহাড়ের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কারের নিমিত্তেই সেখানে যাওয়া তার।
রেডিওতে কাজ করার ফলে গানের সঙ্গে সারাহর সম্পর্ক বেশ নিবিড়, মূলত শ্রোতা হিসেবেই। জেমস, নেমেসিস, ভাইব, তাশফী, মাশা, নোরা জোন্স, পরকুপাইন ট্রি, ওপেথ, কিংস অব লিওন, পার্ল জ্যাম ও এডি ভেডারের গান বেশি টানে। সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী জেমস। এই রকস্টারের তোলা ছবিতে নিজেকে দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ হয়ে আছে তার স্মৃতিতে।
স্টাইল বলতে সারাহ্ বোঝেন কমফোর্ট। নিজের সঙ্গে মানালে ট্রেন্ড ফলো করতে দ্বিধা নেই। স্মার্ট ক্যাজুয়ালেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য; সেটা ডেনিমের সঙ্গে শার্ট, টি-শার্ট হতে পারে, সঙ্গে থাকতে পারে স্টিলেটো ও জ্যাকেট। সারাহর প্রিয় রং নীল, সবুজ ও লাইলেক। কাপড় পরেন পরিবেশ-পরিস্থিতি, সময়, কমফোর্টকে প্রাধান্য দিয়ে, দেশীয় ঐতিহ্যের শাড়ি থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্ন যেকোনো কিছু। অ্যাকসেসরিজ হিসেবে ব্যবহার করেন ঘড়ি, এয়ার রিং ও ফিঙ্গার রিং। পছন্দের পারফিউম ব্র্যান্ড টমি গার্ল, এলিজাবেথ আরডেনের ফিফথ অ্যাভিনিউ, গুচি ফ্লোরা, ক্যারোলিনা হেরেরার গুড গার্ল, মার্ক জ্যাকবসের পারফেক্ট, ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার লাইট ব্লু।
ট্যাটুকে নিজের স্টাইলের অংশ মানতে নারাজ সারাহ্। একে ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে গণ্য করেন। তার শরীরে থাকা বিভিন্ন ট্যাটুতে ফুটে থাকা থিমগুলো এসেছে নিজের ধারণ করা বিশ্বাস থেকে। ডান হাতের কনুইতে করা ট্যাটুতে আছে লর্ড বায়রনের চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ কবিতার পঙ্ক্তি, ‘আই লাভ নট ম্যান লেস বাট নেচার মোর’। বাম হাতের ট্যাটুতে লেখা, ‘ট্রি অব লাইফ’। পিঠের ট্যাটুতে দেখানো হয়েছে জীবনের শুরু, ভালো ও খারাপের মাঝে ভারসাম্য, মৃত্যুক্ষণে জীবনের ইচ্ছে ঘিরে লাইফ জার্নি। এই কনসেপ্টে ভালো-মন্দের ভারসাম্যের ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। ডান হাতের কনুইয়ে আছে ‘দ্য বি’ নামে আরেকটি ট্যাটু, যেখানে প্রকৃতি থেকে মৌমাছি হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একধরনের সচেতনতামূলক অভিব্যক্তির ঘটেছে প্রকাশ। সারাহ্ বৃষ রাশির জাতিকা। এ রাশির প্রতিচ্ছবি ফুটে আছে তার আরেকটি ট্যাটুতে।
সময় পেলে রান্না করতে ভালোবাসেন তিনি। করোনার দিনগুলোতে বাসায় বসে থাকায় অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রান্না নিয়ে। কলার মোচা দিয়ে চিংড়ি, কাচ্চি, চিকেন রোস্ট, রসগোল্লা থেকে শুরু করে নানা পদের বাহারি সব রন্ধনে দক্ষতা আছে তার। মেকআপ, হেয়ার কাট ও নখের ব্যাপারে সারাহ্ বেশ সচেতন। হেয়ার কাটের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ও মানুষের কাছ থেকে এই সেবা নিয়ে থাকেন। হেয়ার কালার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন না; বরং ন্যাচারাল কালারেই রাখেন ভরসা।
সারাহ্ জানালেন, বই পড়ার অভ্যাস পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে। সাইফাই থেকে শুরু করে উপন্যাস, ছোট গল্প- সবকিছুতেই চোখ বোলাতে ভালোবাসেন। সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসের দীপাবলি চরিত্রটি তাকে বেশ প্রেরণা জোগায়। হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘গ্রিন হিলস অব আফ্রিকা’, জেমস প্যাটারসনের ‘কিস দ্য গার্ল’ তার বিশেষ পছন্দের বই। ‘তিন গোয়েন্দা’ও প্রিয়। আরও প্রিয় ফ্রানৎস কাফকার লেখা।
রাত দশটার মধ্যেই খাবার সেরে ফেলতে চান সারাহ্। পাতে রাখেন ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। ফ্রেশ ও হোম মেড খাবারেই সব সময় আস্থা তার। জীবনদর্শন প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমার কাছে মানসিক প্রশান্তির গুরুত্ব সবকিছুর ওপরে। পোষা কুকুর আজলান ও আলায়লার সঙ্গে সময় কাটানো থেকে শুরু করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে একান্তে ভ্রমণের মতো যেকোনো কিছুই আমাকে দিতে পারে সেই মানসিক প্রশান্তি।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন