ফিচার I পাতে পূর্বাভাস
আয়ের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের একটি যোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার মতো যুদ্ধ ও জলবায়ুর প্রভাবেও খাবারের ধরন বদলায়। ভূমিকা রাখে রোগ ও কৃষির অগ্রগতিও। সব মিলিয়ে ২০৫০ সাল নাগাদ কোন খাবারগুলোর প্রতি নজর দেবে মানুষ?
খাবারের সংকট মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ। দিন যত গড়াচ্ছে, খাদ্যের অভাব প্রকট হয়ে উঠছে। এই সংকটের কিছু মনুষ্যসৃষ্ট, কিছু প্রাকৃতিক। তা ছাড়া আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না থাকলে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাসে কিছু পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন পরিবার ছেড়ে রাষ্ট্র এবং বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের খাবার কী হতে পারে, সেই আলাপের আগে জানতে হবে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা খাদ্যাভ্যাসে কেনই-বা পরিবর্তন আসবে? খাবারের মেনুতে নতুন পদের গ্রহণ-বর্জন নিয়মিতই চলে, কিন্তু সেগুলো ঘটে স্বেচ্ছায়। কোনো চাপে পড়ে নয়; অভাব, দুর্ভিক্ষ কিংবা যুদ্ধবিগ্রহের কারণেও নয়। বর্তমানে মানুষের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বৈশ্বিক যেকোনো গ-গোলকেই অনেকে এখন সেই যুদ্ধের ইঙ্গিত বলে ধরে নেয়। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনবে কি না, তা নিশ্চিত না হলেও এটি সমগ্র পৃথিবীর খাদ্যভা-ারে প্রভাব ফেলেছে। এই প্রভাবের রেশ থাকতে পারে বছরের পর বছর, যা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মানুষের পাতে আসতে পারে নতুন পদের খাবার ও ফলমূল। যেগুলো এত দিন পৃথিবীতেই ছিল, কিন্তু মানুষ হয়তো ব্যাপক হারে তা খাওয়ার কথা চিন্তা করেনি।
ইউক্রেন বিশ্বের চতুর্থ খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ। ফলে ওই দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকলে তা বিশ্বের গোটা খাদ্য শিকলে প্রভাব ফেলবে, স্বাভাবিক। হচ্ছেও তা-ই। তা ছাড়া ইউক্রেনকে বলা হয় ইউরোপের ‘ব্রেড বাস্কেট’ তথা রুটির ঝুড়ি। ব্রেড বাস্কেট এমন এক অঞ্চল, যেখানে উৎপাদিত ফসল দিয়ে বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষের খাবারের জোগান দেয়। শোনা যায়, বিশ্বে এমন ব্রেড বাস্কেট আছে ছয়টি। এর যেকোনোটি আক্রান্ত হলেই বিশ্বের খাদ্যশৃঙ্খল আক্রান্ত হয়, দাম বাড়ে; ফলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে।
২০৫০ সাল নাগাদ খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের আরও তিনটি কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, মহামারি ও ফল-শস্যের আদান-প্রদান। করোনা অতিমারির পর খাদ্যাভ্যাসে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়- এমন খাবারের দিকে দীর্ঘ কয়েক বছর ঝুঁকে ছিল মানুষ। ২০৫০ সাল আসতে এখনো ২৭ বছর বাকি। এত দিনে হয়তো আরও নতুন নতুন অণুজীবের সঙ্গে লড়াই করতে হবে মানুষকে। সেগুলো থেকে রেহাই পেতে বিভিন্ন খাবারের গ্রহণ-বর্জন চলতে পারে খাদ্য মেনুতে। অন্যদিকে তাত্ত্বিকেরা বলছেন, বড় রকমের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বিশ্ব। এতে দারিদ্র্য বাড়তে পারে। ফলে প্রয়োজনীয় প্রোটিন ও ভিটামিনের অভাবে পড়তে পারে বিশ্ব-জনসংখ্যার বড় একটি অংশ। এ ক্ষেত্রে বিকল্প খাদ্য খোঁজা ছাড়া উপায় থাকবে না। তৃতীয়ত, আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে এখন এক দেশের ফল-ফসল অন্য দেশে ফলানো সম্ভব হচ্ছে। আবার কিছু ফসল অভিযোজিত হতে না পেরে বিলুপ্তও হয়ে যাচ্ছে। এক দশক আগেও কে জানত, বাঙালিদের স্যালাডে ‘ড্রাগন’ নামে একটি ফল নিয়মিত যুক্ত হবে! কিন্তু এখন তা হরহামেশা হচ্ছে। তা ছাড়া সারা বিশ্বে এখন নতুন আতঙ্কের নাম স্থূলতা। পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই, এর প্রকোপে পড়েছে প্রাচ্যেও। ফলে এখন খাবার সম্পর্কে উদাসীন হলে চলে না; মানতে হয় ডায়েট। নতুন নতুন স্যুপ ও খাবারের সঙ্গে যুঝতে-যুঝতে বাঙালি তার প্রধান খাবার ভাত থেকে কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
যাহোক, মূলত অর্থনৈতিক বিপর্যয়, যুদ্ধবিগ্রহ, রোগ, জলবায়ুর পরিবর্তন, কৃষি সম্প্রসারণের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের খাদ্যাভ্যাস এখনকার সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। ২৭ বছর পর খাবার কেমন হবে, তা অনুসন্ধানে কাজ করছেন লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের বিশেষজ্ঞরা। মূলত ভবিষ্যতের খাবার ও মানুষের খাদ্যাভ্যাস নিয়েই চলছে তাদের কর্মকাণ্ড।
ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষক স্যাম পিরিননের ভাষ্য, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য ভোজ্য উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এগুলো খায়। ফলে ভবিষ্যতের বৈশ্বিক খাদ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ভিন্ন কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পৃথিবীতে খাদ্যযোগ্য ৭ হাজারটি উদ্ভিদ থাকলেও সেগুলোর মধ্যে মাত্র ৪১৭টি ব্যাপকভাবে জন্মায় ও চাষ হয়। অর্থাৎ, এখনো খাদ্যভা-ারে অসংখ্য নতুন খাবার যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কয়েক যুগের মধ্যেই যে খাবার মানুষের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হতে পারে, সেগুলোর একটি হচ্ছে পান্ডানাস। ছোট আকারের গাছ এটি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ফিলিপাইন উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত জন্মাতে দেখা যায়। এ গাছের পাতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে খাওয়া হয়। পান্ডানাসের ফল দেখতে আনারসের মতো। কাঁচা কিংবা রেঁধে খাওয়া যায়।
লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের রিসার্চ ফেলো মেরিবেল সোটো গোমেজ জানিয়েছেন, পান্ডানাস গাছ খরা, প্রবল বাতাস ও লবণাক্ত পরিবেশেও ঠিকঠাক জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে। এটি জলবায়ুসহনীয় গাছ। এর ফল পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বজুড়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে গাছটি জন্মাতে সক্ষম। মানুষের খাদ্যতালিকায় পান্ডানাস ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে পারে বলে মনে করেন মেরিবেল। তার মতে, এই গাছ যদি টেকসইভাবে কাজে লাগানোর ইচ্ছা থাকে, তাহলে আরও ব্যাপকভাবে এর চাষ করা উচিত।
ভবিষ্যতে মানুষের খাবারে আরও একটি উপাদান হতে পারে ভোজ্য বীজ। এগুলো হবে সস্তা। তবে তাতে মিলবে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন ও ভিটামিন বি। জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম এমন বীজ, যেমন মটরশুঁটি ও শিম চাষ হবে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। এমনটাই অনুমান করছেন খাদ্যবিশারদেরা। পৃথিবীতে মটরজাতীয় বীজ আছে ২০ হাজার প্রজাতির। তবে অল্প কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে আমাদের খাদ্যতালিকায়। বনে-বাদাড়ে এখনো খাদ্যোপযোগী অসংখ্য মটর বীজ জন্মায়। সেগুলো ব্যাপক হারে খাওয়ার প্রচলন হতে পারে আগামী দশকগুলোতে।
মোরামা বিন নামের একধরনের বীজ বতসোয়ানা, নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে প্রধান খাদ্য হিসেবে প্রচলিত। ওসব জায়গায় এসব বীজ সেদ্ধ করে খাওয়া হয়। অনেকে তা শুকিয়ে গুঁড়া করে পরে জাউ রেঁধে খান। কেউ কেউ তা দিয়ে পানীয় তৈরি করেন। তবে মটরজাতীয় সব বীজই ভোজ্য নয়। যেগুলো খাওয়ার উপযোগী এবং পুষ্টি সরবরাহে সক্ষম, তা অনুসন্ধান করে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০৫০ সাল নাগাদ অনুসন্ধানপ্রাপ্ত অনেক মটর বীজই মানুষের খাবার টেবিলে পাকাপাকি জায়গা করে নিতে পারে।
প্রকৃতিতে একধরনের শস্য দানা রয়েছে, যা ঘাস থেকে জন্মায়। এগুলো সিরিয়াল নামে পরিচিত। পৃথিবীতে ১০ হাজারের বেশি প্রজাতির শস্য দানা আছে। নতুন খাদ্যের উৎস হিসেবে ২০৫০ সাল নাগাদ সেগুলো মানুষের পাতে উঠে আসার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আফ্রিকার পুষ্টিকর একটি সিরিয়াল হলো ফোনিও। স্থানীয়রা এটির তরকারি, জাউ ও পানীয় তৈরি করে খান। সেখানে এটির চাষও হয়। এটি খরাসহনীয় একটি উদ্ভিদ।
কলার মতো একধরনের ফল রয়েছে ইথিওপিয়ায়। স্থানীয়ভাবে এনসেট নামে পরিচিত। সেই কলা খাওয়া যায় না। তবে এর কা- ও শিকড় গাঁজন করে খাওয়া সম্ভব। তা দিয়ে জাউ ও রুটি তৈরি করে খান স্থানীয়রা। এটিও ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের খাদ্যতালিকায় নিয়মিত হবে বলে বিজ্ঞদের ধারণা।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট