মনোজাল I ড্রেস টু ইমপ্রেস
কনফিডেন্স বুস্ট আপ- সে নাকি কাপড়ের কারসাজি! ব্র্যান্ডগুলোর সাজানো মার্কেটিং প্লট নয়, রয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি
স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন পরনে কী ছিল, মনে না থাকারই কথা। কারণ, বয়সটা তখন খুবই অল্প। কিন্তু যে স্কুলে শৈশব কেটেছে, সেখানে পরার জন্য নির্দিষ্ট করে তৈরি ড্রেসটির কথা নিশ্চয় মনে আছে। প্রথম স্কুলের প্রথম পোশাক সবার জীবনেই একটি বিশেষ অর্থ বহন করে, যেটা প্রায় কেউ ভোলে না বললেই চলে। আচ্ছা, প্রতিটি স্কুলের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলড্রেস থাকে কেন? খুব সহজ উত্তর। সবাই জানেন, এই পোশাকের মাধ্যমেই ছাত্র-ছাত্রীরা ওই বিদ্যালয়ের পরিচিতি বহন করে, অন্যদের চেয়ে নিজেদের আলাদা করে তোলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জীবনের সঙ্গেও ব্যাপারটার মিল আছে। স্কুলড্রেসের মতোই যখন যে পোশাক পরা হয়, তার মাধ্যমে সবাই আসলে নিজেকে চেনানোর চেষ্টা করে। মানুষ তার পোশাকের মাধ্যমে অন্যের কাছে একধরনের বার্তা পাঠাতে চায়। সেই বার্তার মাধ্যমে অন্যরা তাদের সামাজিক, মানসিক এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে দেশের পরিচয়ও পেয়ে যায়।
অনেকেরই জানা আছে, থেরাপিস্টরা তাদের পোশাকের ওপর ভিত্তি করে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বলতে পারেন। উদাহরণ দেওয়া যাক। বলা হয়, জামাকাপড়ের প্রতি অতিরঞ্জিত আগ্রহ দেখানোর সঙ্গে অভাবের সম্পর্ক আছে। আবার, গবেষণায় দেখা গেছে, যে মানুষ কোনো না কোনো সময় বৈরী সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে, তারা সেটিকে আড়াল করার জন্য পোশাকের ওপর নির্ভর করে। দামি দামি চোখধাঁধানো পোশাকের শৈলীর ওপর ভিত্তি করে অন্যের প্রশংসা কুড়ানো এবং এই প্রশংসা চাওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদের সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করে। কারণ, বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্যাশন হলো ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির একটি রূপ, যা আসলে মানুষ মনোযোগ পেতে ব্যবহার করে। এ জন্যই চট করে সেলিব্রিটিদের পরা পোশাক ও ফ্যাশনে আমরা খুব সহজে অভিভূত হয়ে যাই। তারা কোনো না কোনোভাবে সাধারণ মানুষের কাছে লক্ষণীয় ফ্যাশন শৈলীর একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। যেমন, বেড়াতে যাওয়া বা বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় সবাই অপেক্ষাকৃত ভালো পোশাক পরে। কেননা তারা অন্যের চোখে নিজেকে লক্ষণীয় করে তুলতে চায় বা নিদেনপক্ষে একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করে। গবেষকেরা ধারণা করেন, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার এই চেষ্টার মাধ্যমে মানুষ আসলে তার কদর নিশ্চিত করার চেষ্টা করে সব সময়। পোশাক তখন প্রতীকী উপায়ে আত্মসম্মানকে সংজ্ঞায়িত করে। যার সঙ্গে মূল্যবোধেরও সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে। যেকোনো পোশাক পরার পর বেশির ভাগ মানুষই অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা চেয়ে এটিকে পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা করে।
প্রতিটি পোশাকের কিছু কিছু ব্যঞ্জনা আছে। সাধারণত মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে এবং যে ধরনের পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তার বাইরে ভিন্ন পোশাকে নিজেকে উপস্থাপন করতে সংকোচবোধ করে। এ জন্য কারও সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেতে তার পরিহিত পোশাক ভালোভাবে খেয়াল করলেই হয়। কারণ, পরিধেয় কাপড়চোপড় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের ব্যক্তিগত রুচিবোধ ও পছন্দজ্ঞানের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। মানুষ পরিপাটি, মানানসই, যুগের চাহিদানির্ভর পোশাক পরতে চায় এ কারণেই। যাতে পোশাক তার মর্যাদার বাহনে পরিণত হয়। এমনকি আত্মবিশ্বাস বাড়াতেও এটি চমৎকার ভূমিকা পালন করে। কীভাবে? একটি চমৎকার পোশাক পরার পর, আশপাশের সবাই যখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, শুধু এই ফিলিংসেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণ। পোশাকের কল্যাণে অন্যের ওপর ব্যক্তি প্রভাবের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, তা আশপাশে সবার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতেও সহায়তা করে। কোনো অনুষ্ঠানে বা কাজের পরিবেশে পরে যাওয়া পোশাক নিয়ে যদি শতভাগ আত্মবিশ্বাস না থাকে বা যদি মনে হয় এই পোশাকে ভালো দেখাচ্ছে না, সে অনুভূতি নিজের অজান্তেই আচার-আচরণ এবং কাজে-কর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নার্ভাস হওয়া থেকে শুরু করে বেড়ে যেতে পারে উদ্বেগ ও হতাশা। এটি কেন হয়? কারণ সেই একটাই। পরিহিত পোশাক সম্পর্কে অন্যদের ইতিবাচক মন্তব্য উত্থান ও উৎপাদনশীল কিছু করার আত্মবিশ্বাস জোগায়। এ জন্যই ফ্যাশনবিশ্বে আত্মবিশ্বাস অর্জনের একটি উপকরণ হিসেবে পোশাকের নাম উল্লেখ করা হয়।
এবার আসা যাক বেসিক সেই প্রশ্নে। আসলে মানুষ পোশাক কেন পরে? এককথায় বেশির ভাগ মানুষের উত্তর হবে লজ্জা নিবারণের জন্য। ভুল। যদি লজ্জার কথা বলা হয়, তবে এটি নিবারণের জন্য পোশাকের নাম আসা উচিত সবার শেষে। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক। পোশাকের উদ্ভব কিংবা পোশাক পরা মানুষ আসলে কেন শুরু করেছিল? নিজেকে টিকিয়ে রাখা এবং বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। প্রশ্ন আসতে পারে, টিকিয়ে রাখা বা বাঁচিয়ে রাখা আসলে কিসের থেকে? বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে বৈরী পরিবেশ, আবহাওয়া ও প্রকৃতি থেকে। শীত কিংবা প্রখর রোদে ত্বক বাঁচানোর জন্য পোশাক যদি না থাকত, তাহলে কী অবস্থা হতো? ঠিক একইভাবে কাউকে যদি পোশাক ছাড়া কোনো মেরু বা মরু অঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব? কাপড়ের তৈরি পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি।
প্রথম দিকে শিকার করা পশুর চামড়া জড়িয়ে ত্বক বাঁচাত মানুষ। বর্তমান সময়ে এসেও কিন্তু পোশাক পরার প্রধান কারণে এটিই আছে। ত্বক বাঁচিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। করোনাকালীন ডাক্তারদের জন্য তৈরি বিশেষ পোশাক পিপিইর কথা মনে আছে? এর জন্য কেন এত হাহাকার হয়েছিল? করোনা থেকে বাঁচার জন্য, জীবন রক্ষার জন্য। ঠিক একইভাবে জীবনের বিভিন্ন ঝুঁকি থেকে বাঁচার জন্যই কিন্তু আমাদের পোশাকের প্রয়োজন পড়ে। মূলত, মানুষের পোশাক পরার কারণকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত শারীরিক প্রয়োজন। যার মধ্যে পড়ে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কারণে পোশাকের প্রয়োজনীয়তা। দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে সোশ্যাল নিড বা সামাজিক প্রয়োজন। আমরা যে সমাজে বাস করি, সে সমাজের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, উপযুক্ত প্রমাণ করার জন্য পোশাকের প্রয়োজন হয়। যা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মানুষ সব সময়ই নিজেদেরকে তার নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তৃতীয় কারণ হলো সাইকোলজিক্যাল নিড বা মনস্তাত্ত্বিক কারণ। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন বা সুন্দর দেখার তীব্র ইচ্ছা থেকে এই প্রয়োজন উদ্ভব হয়। কারণ, সে সব সময় অন্যের সামনে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে চায়। আর তার জন্য প্রয়োজন পড়ে পোশাকের। তা ছাড়া প্রত্যেক মানুষই চায় নিজস্ব একটা আইডেনটিটি তৈরি হোক। নিজেকে আর দশজনের থেকে আলাদা দেখাক। আর এই নিজস্বতা বজায় রাখার অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে তার পোশাক। যার মাধ্যমে সে অনন্য হয়ে ওঠে, সুন্দর হয়ে ওঠে নিজের এবং অন্যের চোখে।
রায়া ফাতিমা
ইলাস্ট্রেশন: সংগ্রহ