যাপনচিত্র I আবেগের অবতার
নুসরাত ফারিয়া। ঢাকা ও কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় অভিনেত্রী। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সদা হাস্যোজ্জ্বল এই তারকার একান্ত জীবন কেমন?
সুযোগ পেলে একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন নুসরাত ফারিয়া। তারপর সময় দেন নিজের দুই পোষা বিড়াল গুড্ডু ও রোমিওকে। তিনি বলেন, ‘বিড়াল দুটি আমাকে মনে করিয়ে দেয়, নিজ জীবনের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।’ একাধারে উপস্থাপিকা, অভিনেত্রী, মডেল, গায়িকাসহ নানা গুণ ফারিয়ার। বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মজীবনে আয়েশ করে ঘুমোনোর ফুরসত অবশ্য বিরল। কাজের জন্য প্রয়োজনে ভোর ৫-৬টায় উঠে পড়েন। শুটিং থাকলে বেশির ভাগ সময় তার থাকা হয় দেশ-বিদেশের হোটেলে। সে ক্ষেত্রে সকালে গরম পানিতে লেবু মিশিয়ে পান করেন। এরপর একটা কফি শট নিয়ে চলে যান ওয়ার্কআউট করতে। তবে কাজ না থাকলে এবং ঢাকায় অবস্থান করলে জিমে যান বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে। সেখানে কার্ডিও থেকে শুরু করে সব ধরনের শারীরিক কসরত চলে তার। ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা কার্ডিও ওয়ার্কআউট করেন, যার মধ্যে ট্রেডমিলে ১২-১৫ ইনক্লাইন দিয়ে হাঁটা অন্যতম। এ সময় হেডফোনে শুনতে থাকেন পছন্দের সব আপবিট গান। ব্যাটেল রোপ, রোয়িংসহ যাবতীয় কার্ডিও করেন, যার মাঝে কিছু কার্ডিও করেন আপার বডিকে টোন্ড রাখতে। শুধু কার্ডিওতে সীমাবদ্ধ নয় এই রূপসীর ওয়ার্কআউট। কার্ডিও শেষ হলে করেন ফুল বডি এক্সারসাইজ।
ফিমেল সেলিব্রিটিদের মাঝে হেভি লিফটিংয়ে নুসরাত ফারিয়ার মতো মুনশিয়ানার জুড়ি মেলা ভার! তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন, শুটিং মানেই সাজগোজ করে এক্সপ্রেশন দেওয়া; অথচ ব্যাপারটি আদৌ তা নয়; বরং এর পেছনে যথেষ্ট বডি স্ট্রেন্থ প্রয়োজন। যেমন ধরুন, গানের শুটিংয়ে হাই হিল পরে নাচা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে লোয়ার বডি স্ট্রং থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ট্রেইনারের দিকনির্দেশনা নিয়ে কাজ করি আমি।’
ফারিয়ার ওয়ার্কআউট বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। পিলাটিজ, ড্যান্স, ইয়োগার মাধ্যমেও নিজেকে ফিট রাখার চেষ্টা করেন। প্রথম দিকে ভাবতেন, শুধু ডায়েটের মাধ্যমেই ফিট থাকা সম্ভব। তবে রুসলান তাকে প্রথম ওয়ার্কআউটের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। বলে রাখা ভালো, রুসলান হলেন ফারিয়ার ফিটনেস গুরু এবং ঢাকার একটি অভিজাত জিমের স্বত্বাধিকারী। মূলত তার জিমেই ওয়েট লিফটিং করেন ফারিয়া। এ ছাড়া মাসে চার-পাঁচবার করেন পিলাটিজ।
ফারিয়া বেশ ভ্রমণপিয়াসী। জীবন উপভোগ করতে ঘড়ির মতো নয়, বরং কম্পাসের মতো ঘুরে বেড়ান! এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কয়েকবার করে গিয়েছেন; সেই সঙ্গে ইউরোপও দেখা হয়ে গেছে অনেকটাই। কোনো জায়গায় ঘুরতে গিয়ে প্রেমে পড়ে গেলে, সেখানে বারবার যেতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি তুরস্কে মুগ্ধ তিনি। ইস্তাম্বুল হয়ে উঠেছে ভ্রমণের জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় শহর। যেখানেই অবকাশ যাপন কিংবা পেশাগত কাজে যান, চেখে দেখতে ভোলেন না স্থানীয় কুজিন। নিজেকে তাই ফুডি হিসেবে দাবি করেন। অবশ্য, ভারত ও থাইল্যান্ডেই ট্রিপ দেওয়া হয় বেশি। সে সময় ইয়োগা রি-ট্রিট দিতে পছন্দ করেন। ‘এটি মেডিটেশন, অ্যাংজাইটি প্রতিরোধ ও সার্বিক মেন্টাল হেলথের জন্য বেশ উপকারী। ওয়ার্কআউট না করতে পারলে কাছের কোনো বন্ধুর সঙ্গে বসে পড়ি ইয়োগা করতে,’ বললেন এই তারকা।
কাজ না থাকলে যেহেতু একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন, তাই সে সময় সকালের নাশতা সারেন বেলা ১১-১২টার মধ্যে। তবে পেশাগত কাজ থাকলে সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মাঝেই তা সেরে নেন। ব্রেকফাস্ট মেনু বেশ হালকাই পছন্দ তার। পাতে রাখেন পিনাট বাটার ব্রেড, ডিম; সঙ্গে চেষ্টা করেন প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট রাখার। খুব তাড়াহুড়ো থাকলে অবশ্য প্রোটিন শেকেই তৃপ্তি মেটান।
বহুমাত্রিক গুণ ফারিয়ার। ফলে তার কাজে থাকে বৈচিত্র্য। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সমন্বয় করতে হয় সুচারুরূপে। তিনি বলেন, ‘আমি সবকিছু সামলাই অর্গানিকভাবে। যারা ৯-৫টা চাকরি করেন, তাদের চেয়ে আমার চিন্তাভাবনা খুব একটা ভিন্ন নয়। তবে ব্রেক ও ব্রিদিং স্পেসকে সৃষ্টিশীল কাজের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ৪৫-৬০ দিন কোনো কাজ করলে চেষ্টা করি এক মাসের একটা বিরতি নেওয়ার। রিস্টোরেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।’
সারা দিনের মধ্যে দুপুরের খাবার সবচেয়ে পছন্দ তার। এ বেলা বাসার খাবারই রাখার চেষ্টা করেন পাতে। তাতে থাকে মাছ, সবজি, ভর্তার সঙ্গে সীমিত পরিমাণ ভাত। পোশাকের ব্যাপারে ফারিয়া বেশ সংবেদনশীল। খানিকটা ব্র্যান্ড আসক্তিও রয়েছে। পছন্দের ব্র্যান্ড বেবে, গেজ, এইচ অ্যান্ড এম, জারা। ড্রেস নির্বাচনে নিজ ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিকে প্রাধান্য দেন। মুভি প্রিমিয়ার, প্রেস কনফারেন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইভেন্টে সব সময় ড্রেসআপে নিজেকে আলাদাভাবে ফুটিয়ে তুলতে চান।
ফারিয়ার প্রিয় অ্যাকসেসরিজ জুয়েলারি; তবে তা সীমিত পরিমাণ ও পরিসরে পরতে পছন্দ করেন। খুব পছন্দ ফিঙ্গার রিং, কানের দুল ও গলার গয়না। স্টাইলের ব্যাপারে তার অভিমত, ‘আমি চাইলেই অনেককে অনুসরণ করতে পারি; কিন্তু এখানে বিগার গেম বা ট্রিক হচ্ছে, নিজেকে এমনভাবে তুলে ধরা, যেন অন্যরা আমাকে অনুসরণ করে। প্রতি ছয়-সাত মাস পর স্টাইল পরিবর্তন করি। নিজেকে যেকোনো স্টাইল কিংবা লুকে ফিট ইন করানোর ব্যাপারে একধরনের পারদর্শিতা আছে আমার।’
মিনিমাম মেকআপ পছন্দ ফারিয়ার। অতীতে হেভি মেকআপ করলেও, বোন মেকআপ আর্টিস্ট মারিয়া মৃত্তিক ও তিনি মিলে উপলব্ধি করেছেন, ন্যাচারাল বিউটিই সবচেয়ে সুন্দর। ইভেন্টের মতো জমকালো আয়োজনে গেলে গ্ল্যামারাস মেকআপ নিয়ে থাকেন। হেয়ার কালার হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ ব্ল্যাক; তবে এই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পেতে যাওয়া তার চতুর্থ মিউজিক ভিডিওর জন্য হেয়ার কালারে কিছুটা ভিন্নতা এনেছেন। ফারিয়ার আরেকটি পছন্দের জিনিস পারফিউম। এ ক্ষেত্রে পছন্দের ব্র্যান্ড আরমানি সি, ভারসাচি, গুচি। হেয়ার পারফিউমও বেশ পছন্দ তার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছোটবেলায় ফারিয়া হতে চাইতেন হাউজওয়াইফ। পরবর্তীকালে দাদাকে দেখে হতে চেয়েছিলেন আর্মি অফিসার। ফারিয়া যে দারুণ গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, এর পেছনে বড় অবদান বিতার্কিক হিসেবে তার অভিজ্ঞতা; সেই সঙ্গে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড। তা ছাড়া আর জে হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। বলে রাখা ভালো, নুসরাত ফারিয়া ছিলেন ন্যাশনাল ডিবেটে টানা কয়েকবারের বেস্ট স্পিকার। সেই থেকে যুক্তিকে প্রমাণের তাড়না রয়েছে তার মাঝে। ঠিক যেন যুক্তিতে মুক্তি, তর্কে বহুদূর…। তবে কথা এখানেই শেষ নয়; আবেগ আর যুক্তির মধ্যে প্রাধান্য বেশি দেন প্রথমটিকেই। তাতেও থাকে যুক্তির উপস্থিতি। তার মতে, ‘আর্টিস্টরা সাধারণত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন। আবেগ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণও।’ যেকোনো বৈরী পরিস্থিতিতে নিজের মেন্টাল হেলথ নিয়ে সচেতন ফারিয়া। খারাপ সময়ে কাছের মানুষদের কাছে মনের অভিপ্রায় প্রকাশে কোনো দ্বিধা থাকে না তার।
অন্যদের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পান এই তারকা। কোভিডের সময় নিজের এই সুপ্ত সত্তাকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। তারকা খ্যাতির আছে নানা দিক। তবে তা উপভোগ করেন তিনি। সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা, মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা পাওয়াকে জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি মনে করেন।
অবসর পেলে টিভি চ্যানেল, নেটফ্লিক্স, ইউটিউবে দিব্যি সময় কাটিয়ে দেন। ঐতিহাসিক বিভিন্ন টিভি সিরিজ দেখতে ভালো লাগে তার। সম্প্রতি দেখেছেন ‘দ্য ক্রাউন’ সিরিজটি। সদ্য রিলিজ পাওয়া সিনেমাও দেখে ফেলেন সময় পেলে।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে সিজনের ওপর নির্ভর করে কাঁচা আম, জাম্বুরা, আমড়াসহ যাবতীয় টক ফক খাওয়ার ক্রেভিং অনুভব করেন ফারিয়া। রাতে খাবার পাতে রাখেন গ্রিল চিকেন, ভেজিটেবল, স্যালমন স্যালাড, স্যুপ প্রভৃতি। ইনসোমনিয়া থাকায় রাতে ঘুমাতে সাড়ে তিনটা-চারটা বেজে যায়। তবে পরের দিন কাজ থাকলে একটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন।
জীবনদর্শনের ব্যাপারে নুসরাত ফারিয়ার ভাষ্য, ‘হিলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক—যা-ই হোক।’ টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার—কথাটার সঙ্গে অবশ্য পুরো একমত নন তিনি। লাইফ জার্নিতে নিজেকেই নিজ হিলিং প্রসেসের উদ্যোগ নিতে হবে—উপলব্ধি তার। কেননা, ‘অন্যথায়, অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।’
i ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন