এডিটর’স কলাম I ভাষার বাঁচা
বাংলাদেশে বাংলার পাশাপাশি আরও কিছু ভাষা রয়েছে; একজন আদর্শ বাংলাদেশি হিসেবে সেগুলোরও নেওয়া চাই যত্ন
মানবশিশুকে পরম যত্নে বড় করে তুলতে হয়। একমুহূর্তের অসতর্কতা তাকে ঠেলে দিতে পারে ঝুঁকিতে। মানুষমাত্রই কম-বেশি তা জানে। অনেকটা প্রাকৃতিকভাবে, অনেকটা বিজ্ঞানের আলোকে। যথাযথ যত্ন না পেলে কোনো চারা গাছও ঠিকঠাক টিকে থাকতে পারে না। সেই যত্ন সাধারণত প্রকৃতিই নিয়ে থাকে। তবে জগতের সকল প্রাণসত্তার টিকে থাকার জন্য যত্ন লাগেই। মানুষের মুখের ভাষাও তেমনই। যথাযোগ্য যত্ন না পেলে তা কালের গর্ভে একদিন হয়তো অগোচরেই হারিয়ে যায়। মাতৃভাষা হারিয়ে যাবে—এমনটা সচরাচর কেউ না ভাবলেও, পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষা অসংখ্য।
দুই
ভাষার আয়ুষ্কাল সাধারণত খুব বেশি হয় না। দুই হাজার বছরের বেশি টিকতে পেরেছে—এমন ভাষার সংখ্যা হাতে গোনা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তামিল, বাস্ক, মিসরীয়, চায়নিজ, গ্রিক, হিব্রু, সংস্কৃত, ফার্সি প্রভৃতি। ভাষার বিলুপ্তিও নতুন কিছু নয়। প্রাচীনকাল থেকে ঘটে আসছে। আদিকাল থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ হাজার ভাষার জন্ম ঘটেছে; কারও মতে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশি। সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে টিকে থাকা ভাষার সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। আশঙ্কার কথা, এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভাষা রয়েছে, সেগুলোতে কথা বলা মানুষের সংখ্যা ১০ হাজারের কম। আবার, এক হাজারের কম মানুষ কথা বলেন—এমন ভাষার সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। একে আশঙ্কা বলার কারণ, কমপক্ষে এক লাখ মানুষের মুখের ভাষা হিসেবে চালু না থাকলে সেই ভাষা টিকে থাকা মুশকিল বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ইতিহাসবিদদের ভাষ্য, গত সহস্রাব্দে ভাষা বিলুপ্তির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে উপনিবেশ মানসিকতা। ইউরোপের উপনিবেশ বিস্তারের প্রভাবে ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে ভাষাগত বৈচিত্র্য। গত তিন শতকে শুধু ইউরোপেই চিরতরে হারিয়ে গেছে কমপক্ষে ১২টি ভাষা। অন্যদিকে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় প্রচলিত ছিল প্রায় আড়াই শ ভাষা, যে সংখ্যা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র বিশে। আবার, পর্তুগিজরা ১৫৩০ সালে উপনিবেশ স্থাপনের পর ব্রাজিল থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ ভাষা, সংখ্যায় ৫৪০টির মতো। এদিকে, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে বর্তমানে ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা ৭৮০, এগুলোর মধ্যে বিলুপ্তির কিনারে প্রায় ৬০০টি—সম্প্রতি সেখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এমনটাই জানিয়েছেন ভারতীয় গবেষক গণেশ নারায়ণ দেবি। তিনি আরও জানান, দেশটিতে গত ছয় দশকে হারিয়ে গেছে প্রায় আড়াই শ ভাষা। দুনিয়াজুড়ে হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলো সাধারণত নানাভাবে সংখ্যালঘুদেরই, সে কথা বলা বাহুল্য।
তিন
জানি, ভাষার বিলুপ্তিসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত মনে উৎকণ্ঠা বাড়াবে। আবার, বাংলাভাষী কেউ কেউ হয়তো তৃপ্তির ঢেকুর তুলবেন এই ভেবে, ব্যবহারকারীর সংখ্যায় বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষাটি ঘিরে এমন আশঙ্কার কোনো মানে নেই! আপাতদৃষ্টে হয়তো নেই; কিন্তু বাংলাও যদি যথাযথ যত্ন না পায়, কে জানে ভবিষ্যতে এর নিয়তিতে কী ঘটবে। তা ছাড়া, শুধু বাংলাকে নিয়ে ভাবলেই তো চলবে না; ভাবা চাই প্রতিটি ভাষা ঘিরে। বাংলাদেশে বাংলার পাশাপাশি আরও কিছু ভাষা রয়েছে; একজন আদর্শ বাংলাদেশি হিসেবে সেগুলোরও নেওয়া চাই যত্ন।
চার
মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে যে বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষ, বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলনের মর্মার্থ শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা পৃথিবীর সকল মাতৃভাষা, তথা সকল ভাষার জন্যই প্রযোজ্য। আর তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়। কিন্তু আমরা কি খেয়াল করে দেখেছি, এ দেশে থাকা অন্য ভাষাভাষী মানুষগুলো তাদের ভাষা কতটুকু টিকিয়ে রাখতে পারছে? আমরা কি তাদের মাতৃভাষাকে দিতে পেরেছি যথাযোগ্য মর্যাদা? না, বিষয়টি শুধু রাষ্ট্রীয় নয়; বরং ব্যক্তিমানুষের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। উত্তর যদি ‘না’ হয়ে থাকে, তার দায়ভার আমরা এড়াতে পারি না। কেননা, বলা হয়ে থাকে, ‘যখন একটি ভাষা হারিয়ে যায়, তখন বিশ্বকে দেখার একটি পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গিই হারিয়ে যায়।’ নিশ্চয় আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই বৈচিত্র্যের সন্ধান না পাওয়ার বেদনাবোধ তৈরি হওয়ার ঝুঁকিতে রাখতে পারি না।
পাঁচ
পৃথিবীর সকল ভাষা বেঁচে থাকুক যথাযোগ্য যত্ন ও মর্যাদা নিয়ে।