স্বাদশেকড় I পাস্তা প্রচার
যদিও আজ এটি জনসাধারণের দৈনন্দিন খাবার, তবে পাস্তা একসময় শুধুই ইতালীয় অভিজাতদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকানরা এর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মার্কস ব্রাদার্স নাইট অ্যাট দ্য অপেরা (১৯৩৫), ডিজনি’স লেডি অ্যান্ড দ্য ট্রাম্প (১৯৫৫) এবং গুডফেলাস (১৯৯০)-এর মতো ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্রগুলোর দৃশ্যে স্প্যাগেটির উপস্থিতি একে জনপ্রিয় করে তুলতে রাখে দারুণ ভূমিকা
কালের পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্রের রেস্তোরাঁর মেনুতে ক্রমবর্ধমান হয়ে উঠেছে পাস্তা। তবে এ খাদ্যের সঙ্গে ইতালীয়দের প্রেমের সম্পর্কের রয়েছে একটি দীর্ঘ, জটিল ও আবেগপূর্ণ ইতিহাস। যেভাবে স্প্যাগেটি, রাভিওলি ও টর্টেলিনি বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালির খাবার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, তার ইতিহাস কয়েক শতাব্দী পুরোনো। সেই ইতিহাসে নানা সময়ে এসেছে অবাক করা সব বাঁক।
পাস্তা সাধারণত ডুরুম গমের ময়দা দিয়ে বানানো হয়। মেশানো ময়দার পেস্টি টেক্সচারাল রূপ থেকে পাওয়া যায় পাস্তার পরিণত রূপ। বিভিন্ন ধরনের পাস্তার রয়েছে বিভিন্ন নাম। মূলত পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয় এর জন্য প্রয়োজনীয় ময়দা। তাজা পাস্তা প্রায়শই মিশিয়ে রান্না করে সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া যায়। তবে পাস্তা সেঁকা সংরক্ষণ করার জন্য শুকানো হয়। তারপর ফুটন্ত পানিতে রান্না করে এটিকে প্রস্তুত করা হয়।
পাস্তার উৎপাদন প্রক্রিয়া সহজ; তবে সব উপাদান ব্যবহারের পর এটি হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়। পাস্তার রয়েছে বিভিন্ন আকার। চারকোনা করে কাটা, টিউবের মতো ঘূর্ণায়মান আকৃতি, লম্বা সুতোর মতো প্যাঁচানো এবং স্পাইরালের মতো প্যাঁচানোসহ অন্তত ২০০ ধরনের পাস্তা পাওয়া যায়, যার যেকোনো একটি সস ও অন্যান্য অনুষঙ্গ সহযোগে খাওয়া যায়। তবে সবই নির্ভর করে এর স্থানীয় বৈচিত্র্যের ওপর।
পাস্তার জাতিগত শিকড় নিয়ে রয়েছে সুদীর্ঘ বিতর্ক। অনেক তত্ত্বের মাঝে কয়েকটি বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে সুদূরপ্রসারী। ত্রয়োদশ শতাব্দীর অভিযাত্রী মার্কো পোলোর লেখার ওপর ভিত্তি করে একটি স্থায়ী পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে, যেখানে চীন থেকে ইতালিতে পাস্তা আনার উল্লেখ ছিল। পোলোর ভ্রমণকাহিনিমূলক বই দ্য ট্রাভেল’স অব মার্কো পোলোর এক অনুচ্ছেদের ভুল ব্যাখ্যা থেকে কথিত এই ভুল ইতিহাস ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে পোলো এমন একটি গাছের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যেটি থেকে পাস্তার মতো কিছু একটা তৈরি করা হয়েছিল। সেটি সম্ভবত ছিল সাগো পামগাছ, যা থেকে পাস্তা নয়, বরং কার্বোহাইড্রেটযুক্ত গ্লুকোজ তৈরি করা হতো। খাবারটি দেখতে অনেকটা পাস্তার মতো, যা ভেনিস ভ্রমণকারীদের নিজ দেশের পাস্তার কথা মনে করিয়ে দিত। এমনকি ১২৭০ সালে পোলো ভ্রমণের কারণে দূরে থাকার সময় উত্তর ইতালীয় শহর জেনোয়াতে একজন সৈনিকের কথা উল্লেখ করেছেন, ম্যাকারনির একটি ঝুড়ির মালিক ছিলেন যিনি। তারও এক শতাব্দী আগে, ইতালির সিসিলিতে উৎপাদিত পাস্তা দেখে নিজ অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন মুসলিম ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসি।
এদিকে, অনেক ইতালীয় লেখক যুক্তি দিয়েছেন, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর একটি সমাধিক্ষেত্র থেকে ত্রাণ হিসেবে পাস্তা তৈরির সরঞ্জাম দেওয়া হতো। সেই হিসাবে তারা মনে করেন, খাবারটি প্রাক-রোমান ইতালিতে উপভোগ করা হয়েছিল। অনেক খাদ্য ইতিহাসবিদ অবশ্য ত্রাণের এই ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। তাদের ধারণা, রোমান যুগে পাস্তার মতো কোনো খাবারের অস্তিত্ব ছিল না; বরং মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের কারণেই সম্ভবত ইতালিতে পাস্তা ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে পাস্তাসদৃশ ম্যাকারনি, রেভিওলি, গনোচি, ভার্মিসেলির প্রাপ্যতা ইতালীয় উপদ্বীপজুড়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
যাহোক, পাস্তার জনপ্রিয়তার কথা চতুর্দশ শতাব্দীর লেখক বোকাচ্চিও উল্লেখ করেছেন। দ্য ডেক্যামেরন নামক আর্থি টেলে তিনি একটি পাহাড়ে মুখরোচক পারমেসান পনিরের সঙ্গে পানি মেশানোর কথা বর্ণনা করেছেন। তবে সেখানে পাস্তা শেফরা ম্যাকারনি ও রাভিওলি রোল করে প্রস্তুত করতেন ভোজনরসিকদের জন্য।
১৩৯০-এর দশকে আরেকজন কবি ও গল্পকার ফ্রাঙ্কো সাচেতি লিখে গেছেন দুই বন্ধুর ম্যাকারনি খাওয়ার উদ্দেশ্যে দেখা করার কথা। সে সময়ের রীতি অনুযায়ী তারা দুজনেই একই ধরনের ম্যাকারনি খেতেন; তবে স্বভাবতই একজনের চেয়ে অন্যজনের ক্ষুধা ছিল বেশি: ‘দুজন নড্ডো ম্যাকারনি একসঙ্গে রীতিমতো গিলতে শুরু করতেন। জিওভানি প্রথম বাটি শেষ করার আগেই আরেক বন্ধুর ছয় বাটি শেষ হয়ে যেত।’
নড্ডোর পাস্তার স্বাদে কী এমন ছিল, যার ফলে এটি এতটা মুখরোচক হয়ে উঠেছিল? ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর কাল পর্যন্ত, মধ্যযুগ জুড়ে পাওয়া যাওয়া পাস্তাগুলো বর্তমানকালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন ছিল। সে সময় পাস্তাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রান্না করতে হতো। আধুনিক যুগের পাস্তা আল দেন্তের ক্ষেত্রে একালে প্রচলিত কোনো উপাদান ছিল না; বরং এটি এমন উপাদানের সঙ্গে মেশানো হতো, যা শুনতে অবাকই লাগবে। মিষ্টি, সুস্বাদু ও মসলাদার স্বাদের সমন্বয়ে তা তৈরি হতো।
রেনেসাঁর সময়ে অভিজাত ভোজসভায় পাস্তাকে ধনীদের খাবার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উদাহরণ হিসেবে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের পোপ শেফ বার্তোলোমিও স্কাপির নাম উল্লেখ করা যায়। ভোজসভার পাস্তার জন্য সেদ্ধ মুরগির সঙ্গে সেদ্ধ শূকরের পেট, গরুর উদর, শূকরের মাংসের রোস্ট, পারমেসান চিজ, পেস্ট দিয়ে ভরা রাভিওলি তৈরি করতেন তিনি। সেই সঙ্গে যোগ করতেন তাজা পনির, চিনি, সবজি, মসলা ও কিশমিশ।
ম্যাকারনি আল্লা রোমানেস্কার জন্য স্কাপির রেসিপি একইভাবে বিস্তৃত ছিল। প্রথমে ময়দা ও ব্রেড ক্রাম্ব ময়দা ছাগলের দুধ ও ডিমের কুসুমের সঙ্গে মেশানো হতো। এরপর প্যানে তা চ্যাপ্টা করে নুডলস তৈরি করতে রোলার কাটার (বুসোলো) দিয়ে পাতলা স্ট্রিপে কাটা হতো। তারপর শুকানোর জন্য রেখে দিয়ে, ম্যাকারনিকে আধা ঘণ্টা সেদ্ধ করা হতো। এরপর ছেঁকে নেওয়া সেই ম্যাকারনির সঙ্গে গ্রেট করা পনির, মাখনের টুকরো, চিনি, দারুচিনি, প্রোভাতুরার টুকরো, মোজারেলা পনিরের সমন্বয়ে একটি রোমান রূপ দেওয়া হতো। অবশেষে থালাটি চুলায় আধঘণ্টার জন্য অল্প গোলাপ জল দিয়ে বেক করা হতো, যেন পনির গলে গিয়ে মসলার স্বাদে মিশে যায় ওই ম্যাকারনি। যেসব খাবার খেলে মানুষ স্থূলকায় হয়ে ওঠে, সেই তালিকায় ষোড়শ শতাব্দীর লেখক গিউলিও সিজার ক্রোস যে ম্যাকারনির নামও রেখেছিলেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এদিকে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে নেপলসে পাস্তা খুবই প্রচলিত ও প্রধান খাদ্য হয়ে উঠেছিল। তারও আগে, পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নেপোলিটানদের ডাকা হতো পাতাহারী বা ম্যাঙ্গিয়াফোগলিয়া বলে। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে তাদেরকেই বলা শুরু হয় ম্যাকারনি-ইটার (মঙ্গিয়ামাচেরোনি)। এর পেছনে ছিল বেশ কিছু কারণ। যেগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা, অভাব এ সময়কার নেপোলিটানদের জন্য মাংসভক্ষণ সীমিত করেছিল। তা ছাড়া সে সময়ে নেপলস বা সিসিলি রাজ্যের বড় জমির মালিকেরা তুলনামূলকভাবে সস্তায় গম বিক্রি করেছিলেন। ধর্মীয় বিধিনিষেধেরও প্রভাব পড়েছিল ওই পরিবর্তনশীল খাদ্যের ওপর। কেননা, মাংস খাওয়া অনেক ধর্মেই নিষিদ্ধ ছিল তখন। ফলে সেই দিনগুলোতে পাস্তা পরিণত হয় একটি আদর্শ খাবারে। তবে পাস্তার নাটকীয় বিস্তারের প্রধান কারণ সম্ভবত ছিল, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে নুডলস বা ভার্মিসেলি তৈরির জন্য যান্ত্রিক প্রেস টর্চিও মেশিনের ব্যবহার, যা খাবারের জগতে পাস্তা উৎপাদনে বিকাশ ঘটায়।
নেপলসে এক সময় পাস্তা ছিল ভিক্ষুক বা লাজারোনদের খাবারের সমার্থক। একজন ভ্রমণকারীর ভাষ্যমতে, কোনো লাজারোন যদি চার বা পাঁচটি কয়েন জমাতে পারতেন, তাহলে পরের দিনের উপার্জনের ভাবনা থামিয়ে দিয়ে, সেই পয়সায় ম্যাকারনি খেতেন। তবে এসবের পরেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাস্তা আবারও সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের মন জয় করে নেয়। যেমন ধরুন, ম্যাকারনিকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন নেপলসের রাজা চতুর্থ ফার্দিনান্দ। শোনা যায়, তিনি তার আঙুল দিয়ে মুখে নিয়ে সেগুলোকে চেখে দেখেছিলেন। আর এর স্বাদে এতটাই বিভোর ছিলেন, যা তাকে ছুরি, কাঁটাচামচ ব্যবহার প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করেছিল।
সময়ের পরিক্রমায় পাস্তায় যোগ হওয়া স্বাদে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। মিষ্টির জায়গা দখল করে নেয় ঝাল ও লবণাক্ত স্বাদ। চিনির বদলে শাকসবজি ব্যবহার পাস্তাকে পুষ্টির দিক থেকে ভালো খাবারে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাস্তায় যোগ হয় টমেটো। ১৮৪৪ সালে টমেটো সসের সঙ্গে স্প্যাগেটি পরিবেশন করা শুরু হলে তা এককথায় সর্বজনীন রূপ নেয়। সেই চল এখনো আছে।
ু ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট