লেবেল অ্যালার্ট I বোকা বাক্স
মূলত হাতে বানানো গয়না নিয়ে কাজ করা দেশীয় ব্র্যান্ড। জ্যামিতিক নকশা প্রাধান্য পাওয়া বোকা বাক্স তৈরির পেছনের কারিগর শুধু একজন। অর্ণব সাহা। তিনি পুঁথিগত বিদ্যা শেষ করেছেন স্থাপত্যের ওপর। আর গয়না নকশার পাঠ শুরু করেছিলেন ঢাকা শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। সে পাঠ চলছে এখনো।
উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে অর্ণব ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য উচ্চশিক্ষা। কুষ্টিয়ায় কেটেছে ছেলেবেলা। তাই শহর পরিবর্তনের পর জীবনের পার্থক্যগুলো অনুভব করেন অর্ণব। বাবা-মায়ের আদর-শাসনের বালাই নেই। একা জীবনে চূড়ান্ত স্বাধীনতা। শহুরে রাস্তায় হেঁটে আর ছবি তুলে কাটতে থাকে উপভোগ্য সময়। ইট-কাঠ-পাথরকে খুব ভালো করে চিনতে থাকেন আর্কিটেকচারের ক্লাসরুম আর ঢাকার রাস্তায় ঘুরে। সিলেবাসের পড়াশোনা শেষে সার্টিফিকেট অর্জন। হলো কিছুদিন চাকরি। কিন্তু রুটিন জীবনে মনমতো ঘুরে বেড়ানোর সময়ের বড় অভাব বোধ করলেন অর্ণব। কনক্রিট, পিচ ঢালা রাস্তার টান আর সেই সঙ্গে নিজের একটা কিছুর খোঁজে চাকরি ছাড়েন। নিজেকে নিয়ে ভেবে দেখলেন, নকশা করতে জানেন। যা তার একান্ত আপন। একে পুঁজি করেই শুরু করেন ব্র্যান্ড গড়ার কাজ।
বোকা বাক্সের প্রথম পণ্য স্কেচ বুক। নাম বোকা বাক্স রাখার পেছনের গল্পে জানা গেল, অর্ণবের মনে হয়, মানুষ দিন দিন প্রকৃতির সান্নিধ্য হারাচ্ছে। সঙ্গে হারাচ্ছে নতুনের সঙ্গে পরিচয়ের গল্প। অর্ণবের ভাষায়, ‘বোকা হচ্ছে মানুষ’! আর এর সঙ্গে বাক্স যোগ করেছেন তার উচ্চশিক্ষার অনুপ্রেরণায়, আর্কিটেকচারের দালানকোঠা থেকে। অর্ণবের চোখে এগুলো সবই বাক্স। আর নাগরিক জীবনে সবাই বাক্সবন্দি। তাই লেবেলের রেখেছেন এমন নাম।
বোকা বাক্স মূলত গয়না নিয়ে কাজ করছে। প্রডাক্ট লাইনে আছে নেক পিস, ইয়ার রিং, ফিঙ্গার রিং। নকশা করার ক্ষেত্রে জ্যামিতিক ধারার প্রভাব বেশি। আর উপাদানের উৎস শহুরে জীবনের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানান কিছু। এই দেশি জুয়েলারি ব্র্যান্ডটি মূলত নন-কমার্শিয়াল চিন্তাধারা মেনে কাজ করে। গয়নার শুরু থেকে শেষ অবধি সৃজনশীলতা গুরুত্ব পায়। কাজ সম্পন্ন হয় বোকা বাক্সের স্টুডিওতে। ওয়ান ম্যান আর্মি অর্ণব সেখানে জুয়েলারি ডিজাইনের পাশাপাশি প্রডাক্ট ফটোগ্রাফি করে পেইজে আপলোড করেন। এখানে অর্ণব সব্যসাচী।
বোকা বাক্সের গয়নার ডিজাইনে ঢাকা শহরের জীবনের নানান উপাদান দেখা যায়, সঙ্গে প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয় নজর কাড়ে। প্রিয় শহরের প্রতি ভালোবাসা থেকে তার নকশায় সুউচ্চ দালানকোঠার ছন্দ দেখা যায় নেক পিসের লকেটে, কানের দুলে। আকাশছোঁয়া জানালাগুলো যেন এক টুকরো আকাশ দেখার স্বাধীনতা। সেই জানালা অর্ণব নিয়ে এসেছেন গলার গয়নাতে। কাঠের মাঝে সাদা আর কালো মুখোশের অবস্থান যেন নাগরিক জীবনের চিত্র। গৌতম বুদ্ধকে মনে রেখে সে থিমেও কাজ হয়েছে এই লেবেলে। টাই-ডাই ফ্যাব্রিকের ব্যবহারেও বেশ কিছু গয়না অলংকরণ করা হয়েছে। রাঙানো হয়েছে বন্ধন রঞ্জনে। এগুলোতে ব্যবহৃত উজ্জ্বল ও কোমল—দুই ধরনের রংই মন মাতায়। কাঠ আর মেটালের মাঝে রঙিন কাপড় যেন প্রাণ জোগায় গয়নাগুলোকে। সঙ্গে পিতলের দারুণ ব্যবহারে তৈরি হয় আলাদা আভিজাত্য। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেয় বাঙালির শিকড়ের গল্প।
থিমেটিক কাজেও পারদর্শিতা আছে এই ব্র্যান্ডের। মাদারহুড নামের গয়নায় ফুটে উঠেছে মাতৃত্বের গল্প। ওস্তাদ শিরোনামে আছে চাবির নকশার গয়না। জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির শ্রোতাদের জন্য এই থিমেও কাজ করেছেন বোকা বাক্সের অর্ণব। মিলবে হাতের অলংকারও। যার মধ্যে বাজু একটি। পিতলের বাজুও পাওয়া যাবে এগুলোর মধ্যে।
হ্যান্ডমেইড গয়নাগুলোর বিনিময় মূল্য ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। সুখবর হচ্ছে, অনলাইন এই ব্র্যান্ডের গয়না এখন অফলাইনেও পাওয়া যাবে। ফ্যাশন ব্র্যান্ড অরণ্যের জুয়েলারি সেকশনে।
বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যত নিয়েও ভাবেন অর্ণব। দেশের নানান জায়গা আর বিশ্বজুড়ে প্রদর্শনী করতে চান তিনি। সীমানা পেরিয়ে যেতে চান বোকা বাক্সের গয়না নিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখাতে চান বোকা বাক্সের চমক। বিদেশি ক্রেতাদেরকেও জানাতে চান ইট-কাঠ-পাথর-ধাতুতে আঁকা ঢাকা শহরের গল্প।
i সারাহ্ দীনা
ছবি: বোকা বাক্সের সৌজন্যে